পৌরুষ কিম্বা নারীবাদ নয়, 'লাপাতা লেডিস'-এর সাফল্যের রসায়ন স্রেফ সরল প্রেম

পৌরুষ কিম্বা নারীবাদ নয়, ‘লাপাতা লেডিস’-এর সাফল্যের রসায়ন স্রেফ সরল প্রেম


পুরুষবাদ কিম্বা নারীবাদে নয়; শেষ পর্যন্ত নারী-পুরুষের বোঝাপড়া ভালবাসায়- এটা দেখিয়েই বাজার মাত করেছে ‘লাপাতা লেডিস’। মুভি রিভিউতে ঋতুপর্ণা কোলে-

আজকাল একটা সিনেমা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল। সকলেই সিনেমাটার প্রশংসা করছে। সিনেমার টুকরো টুকরো ডায়লগের ছবি বা ভিডিও তো বটেই চাইলে গোটা সিনেমাটাই দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে। নির্মাতাদের এসব আটকানোর তেমন কোনো গরজ চোখে পড়ছে না। যেন মানুষ দেখুক তাতেই শান্তি। সিনেমাটার নাম ‘লাপাতা লেডিস’। আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই আড়াই মাস আগে যখন হলে এসেছিলো তখন মানুষ খেয়ালই করেনি কখন এল আর কখন গেল। গোটা বিশ্ব জুড়ে মাত্র দশ কোটি মতো অর্থ তুলতে সক্ষম হয়েছিলো মুভিটি।

মজাটা শুরু হলো সিনেমাটি যখন OTT তে এল। ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিলো ‘12th Fail’ সিনেমার ক্ষেত্রে। বর্তমানে ভাল গল্প মানুষকে সিনেমামুখী করলেও সিনেমা হলমুখী করছে না। ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতির হিসাব করলে বলা যায় বর্তমানে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে ‘আলফা মেল’রা। সে’কারণেই পাঠান, অ্যানিম্যাল, গদরের মতো সিনেমাই বাঁচাচ্ছে বক্সঅফিসের মান সম্মান। সমাজের জন্য অবশ্যই তা ভাল বার্তা কখনোই নয়। কিন্তু যখন ‘লাপাতা লেডিস’-এর মতো সিনেমাগুলি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল হচ্ছে, মানুষ দেখছে তখন বোঝা যায় আশার আলো এখনও নিভে যায় নি।

প্রসঙ্গে ফেরা যাক। কিরণ রাও পরিচালিত একগাদা নতুন মুখ নিয়ে হাজির হয়েছে ‘লাপাতা লেডিস’ নামের সিনেমাটি। গোটা সিনেমায় পরিচিত মুখ পুলিশ অফিসারের চরিত্রে রবি কিষাণ। সহযোগী পুলিশের ভূমিকায় দুর্গেশ কুমার যিনি বর্তমানে পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজের কারণে বেশ জনপ্রিয় মুখ। সিনেমার প্রেক্ষাপটে আছে নির্মল প্রদেশের একটি গ্রাম ও একটি স্টেশন। সময়টা ২০০১ সালের জানুয়ারি মাস। সিনেমাটিতে বেশকিছু বিষয় সমান্তরালভাবে চলেছে। ভালো -খারাপ, নারীবাদ- পুরুষতন্ত্র, শিক্ষা-কুসংস্কার, আদর্শবাদ-অন্ধকার। সবই রেললাইনের দুই পাতের মতো এগিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়েই সমাজ। সেই সমাজে শেষপর্যন্ত জিতে গেছে ভালোবাসা।

অনেকের হয়তো মনে হতে পারে এই সিনেমাটা ফুল ও জয়া দুই নব বিবাহিত বধুর হারিয়ে যাওয়ার গল্প। শিরোনামও তাই বলতে চায়। কিন্তু আমার কাছে গল্পটা দীপকের গল্প। একটা সাধারণ ছেলের প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অসাধারণভাবে তুলে ধরার গল্প। সূর্যমুখী গ্রামের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সহজ সরল ছেলে দীপক। বিয়ে করেছে পরিবারের দেখে দেওয়া ফুল কুমারী নামের একটি মিষ্টি মেয়েকে। বাইরের জগত সম্পর্কে একেবারেই অপরিচিত ফুল। তাই দীপক তাকে পরম যত্নে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসছে। যে ট্রেনে তারা আসছে সেখানে আরও কিছু নব বিবাহিত দম্পতি আছে। সেখানেই জানা যায় পণ না নিয়ে বিয়ে করেছে দীপক। বাকি দম্পতির পরিবারের কাছে হাসির খোরাক হয় সেকারণে। একজন তো বলেই বসে, নিশ্চিত ছেলের মধ্যে খুঁত আছে। দীপক যেন সে কথা গায়েই মাখে না। দীপককে চেনার সুত্রপাত এখান থেকেই।

অন্ধকার ছাড়া যেমন আলোর গুরুত্বকে বোঝা যায় না, তেমনি ভালোকে ততক্ষণ অনুধাবন করা যায় না যতক্ষন না খারাপ তার বিকট চেহারা নিয়ে না দাঁড়ায়। এই সিনেমায় দীপকের উল্টো দিকে আছে প্রদীপ। জয়া ট্রেন থেকে নেমেই বুঝেছিলো যার সঙ্গে সে নেমেছে সে তার স্বামী নয়। তবু জয়া দীপকের সঙ্গে সঙ্গে যায়। অন্যদিকে ফুল কুমারী যখন স্টেশনে প্রদীপের সঙ্গে নামে এবং বোঝে ভুল জনের সঙ্গে নেমে পড়েছে তখন প্রদীপ ফুলকে সাহায্য করতে চাইলে ফুল বুঝে যায় এর সাহায্য নেওয়া যায় না। কিরণ রাও এখানেই অনন্য‌। যিনি দীপকের মতো একটা চরিত্রকে নির্মাণ করেছেন, যে তার বিবাহিত স্ত্রীকে সীমাহীন ভালোবাসে, হারিয়ে যাওয়া অন্য মেয়েটিকে প্রতিজ্ঞা করে তাকে ঘরে ফিরিয়ে দেবে, মাত্র দুদিনের স্ত্রী সম্পর্কে খারাপ কথা শুনে বাল্যকালের সব বন্ধুদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে, সামাজিক কুসংস্কারকে নিজের মতো করে প্রতিবাদ করে। কখনও ঘোমটা প্রথার বিরুদ্ধে কিংবা কখন‌ও পণপ্রথার বিরুদ্ধে। কেবল এটুকুই চাওয়া বর্তমানের আলফা মেল মার্কা নায়কের ভিড়ে দীপকরা যেন হারিয়ে না যায়।

মেল কিম্বা ফিমেল ইগো নয় সম্পর্কের ভিত্তি ভালোবাসা, বোঝালো ‘লাপাতা লেডিস’ এবং এই সহজ দর্শন দর্শক নিলেন‌ও।

লাপাতা লেডিস সিনেমায় নায়ক দীপক হলেও ভিলেন কিন্তু প্রদীপ নয়। এ সিনেমার ভিলেন কুসংস্কার। ব‌উ হারায় ঘোমটার জন্য। এক হাত লম্বা ঘোমটা থাকার কারণে দীপক জয়াকে ফুল কুমারী ভেবে ফেলে। কুসংস্কারের জন্যই ফুল কুমারী শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা জেনে উঠতে পারে না। গ্রাম্য কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে লাখ টাকা পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়াকে মেয়ের পড়াশোনার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। পুরুষতন্ত্রের আস্ফালনও এক প্রকারের কুসংস্কার। সেকারণে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা যে অপরাধ তা জানে না বা বোঝে না প্রদীপ। জীবন কোনো নির্দিষ্ট আদর্শবাদে বাঁধা নয়। মঞ্জু মাসি জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে বুঝেছে পুরুষ মানুষ বিশ্বাসের অযোগ্য। ফুলকুমারীকে একা বাঁচার পাঠ পড়ায়, স্বাবলম্বী হতে শেখায়। একপ্রকার উগ্র নারীবাদের ঝলক প্রতিফলিত হয় তার ভেতর থেকে।

সিনেমার প্রায় শেষ দিকে পুলিশ যখন জয়াকে চোর হিসাবে গ্রেফতার করে জয়া পুলিশকে জানায় “তুমি পুলিশের দৃষ্টিতে দেখছো তাই আমাকে চোর ভাবছো”। আসলে কোনো ঘটনাকে যে যেভাবে দেখতে চায় ঘটনা তার কাছে সেভাবেই ধরা দেয়। নারীবাদী দৃষ্টিতে দেখা মঞ্জু মাসি ভেবেছিলো দীপক ফুলকুমারীর গয়না নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। প্রদীপের উগ্র পৌরুষের মতো মঞ্জু মাসির নারীবাদও হার শিকার করে দীপক ফুলকুমারীর নির্মল প্রেমের কাছে। অন্যদিকে প্রদীপ হেরে যায় জয়ার নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে দিয়ে।

নির্মল প্রদেশের নির্মল সরলতাই এই সিনেমার আদি মধ্য এবং অন্ত। অতি সাধারণ সংলাপ, অতি সাধারণ ঘটনাও দর্শককে নির্মল হাস্যরস উপহার দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,/ সহজ কথা যায় না বলা সহজে”। সংলাপ নির্মাতারা অসাধ্য সাধনের মতই সহজের প্রকাশ সহজভাবেই ঘটিয়ে ফেলেছেন। “একবার ঘুঙ্ঘট লে লিয়া আগে নেহি নীচে দেখ কর চলনা শিখো”, “ফেস ঢাক দেনা মতলব পেহচান ঢাক দিয়া”, “কোই খানে কা ভি তাড়িফ করতা হ্যা”?, “তো কা আব অউরতো কি পসন্দ কা খানা বানেগা”? এবং “বুরবাক হোনা শরম কা বাত নেহি হ্যা, বুরবক হোনে পে গর্ব করনা ই শরমকা বাত হ্যা” প্রতিটা ডায়লগে সোশ্যাল মিডিয়া আজকাল উত্তাল হয়ে আছে। বহুদিন পর সিনেমার গল্প, সংলাপ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হচ্ছে। বক্স অফিস জয়ের থেকেও এটা অনেক বড়ো জয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *