মাথা গরম হলে মানুষ মুখ দিয়ে যা নয় তাই বলে। বিচারবুদ্ধি লোপ পেলে মানুষের মাথা গরম হয়। বিপদকালে মানুষের বিচারবুদ্ধি লোপ পায়। তবে বুদ্ধির জোরে চরম বিপদ থেকেও পার পাওয়া যায়। ভাল সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে সবথেকে খারাপ পরিস্থিতিতেও বুদ্ধিভ্রষ্ট হন না। সাধারণ মানুষ দিনের মধ্যে দশবার মেজাজ হারিয়ে আকথা-কুকথা বলে ফেলে। কিন্তু যাঁরা সাধারণ মানুষকে চালান, তাঁরাও যদি সহজেই রিপুর দাস হয়ে পড়েন, তবে তো ভারী চিন্তার কথা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল নামক দলটার প্রধান কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি খুব ভেবেচিন্তে কথা বলেন, এমন আরোপ মমতার উপর তাঁর চরম শত্রুও করতে পারবেন না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এমন সব কথা তিনি বলে দিচ্ছেন, একজন মুখ্যমন্ত্রীর যা বলার আগে কমপক্ষে দশবার বিবেচনা করা উচিত। ভোটের সময় প্রচারের উত্তেজনায় সব দলের নেতাই কমবেশি বেফাঁস বলেন। কিন্তু যাঁর পদ যত ভারী, তাঁকে তত সংযমের পরীক্ষা দিতে হয়। দুঃখের হলেও সত্যি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে বাক সংযমের খুব অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রতিপক্ষের সমালোচনা করতে গিয়ে দু’একটি সভায় অসংসদীয় শব্দ পর্যন্ত প্রয়োগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেক সভায় বিরোধী নেতাদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে তাঁর রুচিতে আটকায় নি। বিধানসভার বিরোধীদল নেতাকে তাঁর পিতৃদেব তুলেও খেউড় করেছেন মমতা।
এই পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। ভোট মানেই নেতায় নেতায় যুদ্ধ। ‘বিলো দ্য বেল্ট’ আঘাত কাঙ্ক্ষিত না হলেও রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে যাঁদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই, যাঁরা কোনও রাজনৈতিক দলেরই নেতা নন, তাঁদের রাজনীতির মধ্যে টেনে এনে কটূবাক্য বলা কি উচিত? ভোটের প্রচারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্ন্যাসী স্বামী প্রদীপ্তানন্দের নামে বিরূপ সমালোচনা কেন করলেন? ভারত সেবাশ্রম সংঘ চরিত্রগতভাবে একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন। হুগলির সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বামী প্রদীপ্তানন্দ ওরফে কার্তিক মহারাজ সম্পর্কে যা বলেছেন- “সব সাধু সমান হয় না। সব স্বজন সমান হয় না। আমাদের মধ্যেও কি আমরা সবাই সমান? এই যে বহরমপুরের একজন মহারাজ আছেন। আমি শুনেছি অনেক দিন ধরে, কার্তিক মহারাজ। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। আমার শ্রদ্ধার্ঘ্যের তালিকায় তারা দীর্ঘ দিন ধরে আছে। কিন্তু যে লোকটা বলে, তৃণমূল কংগ্রেসের এজেন্ট বসতে দেব না, সেই লোকটাকে আমি সাধু বলে মনে করি না। তার কারণ, সে ডাইরেক্ট পলিটিক্স করে দেশটার সর্বনাশ করছে।’’
অথচ কার্তিক মহারাজের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সংশ্রব নেই । তিনি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙার মঠটির দায়িত্ব সামলান। কার্তিক মহারাজ মুর্শিদাবাদে ভোটগ্রহণের সময় বুথে তৃণমূলের এজেন্ট বসতে দেবেন না বলে হুমকি দিয়েছিলেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে এমন অভিযোগ শোনা গেল! নিজের বক্তব্যের সমর্থনে কোনও প্রমাণ দেন নি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। তাঁর কাছে তথ্যপ্রমাণাদি আছে কিনা আমরা জানি না। তবে নির্বাচন কমিশনের কাছে কেউ স্বামী প্রদীপ্তানন্দের নামে এমন অভিযোগ জানায় নি। মুখ্যমন্ত্রীর আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন কার্তিক মহারাজ। ৩৮ বছর ধরে তিনি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় নানা জনহিতকর কাজ ও সেবাকর্মের সঙ্গে জড়িত। এই জেলায় ভারত সেবাশ্রম সংঘ পরিচালিত অবৈতনিক স্কুলগুলিতে দুঃস্থ মুসলমান পরিবারের সন্তানেরাও পড়ালেখা করার সুযোগ পায়।
স্বামী প্রদীপ্তানন্দের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার সব দলের লোকেদেরই সুসম্পর্ক আছে বলে জানা গেছে। একজন সন্ন্যাসীর জন্য সেটাই স্বাভাবিক। সন্ন্যাসীর ধর্মই তো সবাইকে সমদৃষ্টিতে দেখা। যাঁরা নিজ কর্মগুণে জনপ্রিয়, রাজনৈতিক দলগুলিই তাঁদের কাছে আসে, ভোটে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কার্তিক মহারাজের কাছেও এরকম প্রস্তাব গিয়েছিল বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীর মতো প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই লুফে নেন নি এই সন্ন্যাসী। তিনি রাজনীতিতে আসতে ইচ্ছুক নন বলে সংবাদ মাধ্যমের সামনে জানিয়েছেন কার্তিক মহারাজ। কার্তিক মহারাজকে দোষারোপ করে খামোখা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। রাজনীতির বাইরে থাকা একজনকে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে টেনে এনে অন্যায় করেছেন তিনি। লোকসভা নির্বাচন নিয়ে মমতা চাপে আছেন বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু চাপের মুখে রাজ্যের কান্ডারী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছেন, এই দৃশ্য রাজ্যবাসীর জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। রাজ্যের কান্ডারী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললে রাজ্যবাসী যাবে কই?
Feature graphic is representational and created by NNDC.