নিয়োগ দুর্নীতি মামলা: বিচারপতিরা ন্যায় বিমুখ হন নি, তাই সমাজের প্রভাবশালীদের কত্ত উষ্মা!

নিয়োগ দুর্নীতি মামলা: বিচারপতিরা ন্যায় বিমুখ হন নি, তাই সমাজের প্রভাবশালীদের কত্ত উষ্মা!


সমাজের সর্বোচ্চ প্রভাবশালীরা যখন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বিচারপতিদের বাপান্ত করেন, তখন জনসাধারণের কাছে তাঁরা উপহাসের চেয়ে আর বেশি কিছু প্রত্যাশা করতে পারেন না। লিখলেন উত্তম দেব-

২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ইস্যুতে কোর্ট-কাছারিতে তো কম সময় ও অর্থ ব্যয় করে নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। অভিষেক মনু সিংভি ও কপিল সিব্বলের মতো সুপ্রিম কোর্টের দুই নামজাদা উকিল রাজ্য সরকারের পকেটে। নবান্ন থেকে ইশারা পাওয়া মাত্রই আদালতে সরকারকে রক্ষা করতে নেমে পড়েন সিংভি-সিব্বল। মমতার ঘরের লোক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়‌ও আইনজীবী হিসেবে কম দক্ষ নন। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল পদে যাঁরা বসেন, তাঁরাও কেউ বটতলার উকিল নন।‌ রাজ্য সরকার গত ১৩ বছরে অ্যাডভোকেট জেনারেল পদে রদবদল করেছেন অন্তত ১০ বারের কম নয়। ভাল ভাল উকিল লাগিয়ে করদাতাদের ঘর থেকে ভাল অর্থ খরচ করেও হাইকোর্ট তো বটেই সুপ্রিম কোর্টেও বহু মামলায় সুবিধে করতে পারে নি রাজ্য। আবার ডিএ মামলা সহ অনেক মামলায় আদালতের অবস্থানে স্বস্তিতে নবান্ন। সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত মামলাতেই যেমন সুপ্রিম কোর্টে টাটাদের বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছে রাজ্য সরকার।

ভারতের বিচার ব্যবস্থা অবশ্যই ত্রুটিহীন নয় কিন্তু তার জন্য ভোগে সাধারণ জনগণ, যাদের অর্থ নেই। কিন্তু রাজ্য সরকার, তৃণমূল কংগ্রেস, মমতা বা অভিষেক- কার‌ও অর্থের অভাবে সুবিচার না পাওয়ার সমস্যা নেই। পঁচিশ-তিরিশ কোটি টাকা দিয়ে যাঁরা এক-একটি মামলার আইনজীবী ফিট করেন, বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাঁদের পবিত্র ক্রোধ জাহির করতে দেখে সত্যিই হাসি পাচ্ছে। দিনের পর দিন মর্ত্যের বিচারশালায় ন্যায় না পেয়ে দরিদ্র বিচারপ্রার্থী যখন চোখের জল মুছতে মুছতে উপর‌ওয়ালার আদালতে নালিশ জানায়, তখন তার কষ্টটা না বোঝার মতো নিষ্ঠুর যেনো আমরা না হ‌ই। কিন্তু সমাজের সর্বোচ্চ প্রভাবশালীরা যখন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বিচারপতিদের বাপান্ত করেন, তখন জনসাধারণের কাছে তাঁরা উপহাসের চেয়ে আর বেশি কিছু প্রত্যাশা করতে পারেন না। ল্যাজে পাড়া পড়লে ল্যাজবিশিষ্ট প্রাণী মাত্রেই খ্যাঁক করে ওঠে। স্বার্থের ল্যাজে পাড়া পড়লে মানুষ‌ও।

কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি গেছে। ঘটনাটা নিঃসন্দেহে একটা বিরাট বিপর্যয়। এর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া অনেক গভীর পর্যন্ত যাবে। কিন্তু এই বিপর্যয়ের ক্ষেত্রটা কি আদালত তৈরি করেছে? হ্যাঁ; আদালত একটা কাজ করতে পারত। তা হল ন্যায়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রায় দেওয়া, যা করলে মুখ্যমন্ত্রী খুশি হতেন। দাগি অপরাধীও সাজা থেকে রেহাই পেয়ে গেলে খুশি হয়। কিন্তু বাদী-বিবাদী, কাউকেই খুশি করা তো বিচারকের কাজ নয়। বিচারকের কাজ উত্থাপিত অভিযোগের সত্যাসত্য বিচার করা। গত সোমবার এস‌এসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলার রায়দান কালে বিচারপতি দেবাংশু বসাকের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। জাস্টিস বসাক বলেছেন, “এ ছাড়া (চাকরি বাতিল করা) কোনও উপায় ছিল না।’’

নিয়োগ দুর্নীতি মামলার মূল অভিযোগের জায়গা দুটি। এক, অসংখ্য প্রার্থী যোগ্যতা থাকার পরেও চাকরি পান নি। দুই, অজস্র প্রার্থী অযোগ্য হয়েও নিয়োগপত্র পেয়ে গেছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকলে এই দুই অভিযোগ‌ই তোলার প্রেক্ষিত থাকত না। বা কেউ তুললেও নিয়োগকর্তাদের তরফে অভিযোগ খন্ডনের জোরালো সুযোগ থাকত। রাজ্যে প্রাথমিক ও এস‌এসসি-র নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অনেকগুলি মামলা হয়েছে। একাধিকজন মামলা করেছেন। মামলাকারীদের প্রত্যেকের অভিযোগ, যোগ্যতা থাকার পরেও মেধা তালিকায় স্থান পাই নি। মেধা তালিকায় গণহারে কারচুপি ব্যতিরেকে গণহারে যোগ্যদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা অথবা গণহারে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সরকারকে বাঁচানোর একটাই রাস্তা খোলা ছিল মামলাকারীদের অভিযোগকে আদালতের সামনে ভিত্তিহীন প্রমাণ করা। রাজ্যের কৌঁসুলিরা সে কাজে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই মামলায় সরকারের পরাজয় হয়েছে।

যথা সময়ে মুখ্যমন্ত্রী পার্থদের রাশ টেনে ধরলে এই দিন তাঁকে দেখতে হত না। প্রতীকি ছবি

সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের, মামলায় শোচনীয়ভাবে হেরে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বিচারপতিদের সম্পর্কে মুখে যা আসছে তাই বলছেন। যখন তাঁর মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সদলবলে কাছা খুলে ঘোটালায় ব্যস্ত ছিলেন, তখন রাশ টেনে ধরলে মুখ্যমন্ত্রীকে এই দিন দেখতে হত না। এখন তিনি বলছেন, কোনও একটা দফতরে কিছু অনিয়ম হয়ে থাকলে আমি জানব কীভাবে? দলের কেউ একটা সর্ষে গিললেও যিনি ঘরে বসে টের পান, তিনি কিনা বলছেন আমি কিছু জানি না! বাংলার একটা রাস্তার পাগল‌ও বিশ্বাস করবে, তাঁর অগোচরে নিয়োগ নিয়ে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে? এস‌এসসি-র ২০১৬-র নিয়োগ প্রক্রিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এত অনিয়ম হয়েছিল যে কে যোগ্যতার জোরে চাকরি পেয়েছে আর কে অযোগ্য হয়েও চাকরি পেয়েছে, তা খুঁজে বের করা এস‌এসসির পক্ষেও দুঃসাধ্য। বহু যোগ্য‌ও টাকা ছাড়া নিয়োগপত্র হাতে পায় নি বলে গুঞ্জন।

লোভে অন্তর্দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গেলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। ২০১৪ থেকে ১৬- যখন প্রাথমিক ও এস‌এসসি-র নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছিল; তখন রাজ্যের শাসকদলের লোকেরা ভেবেছিলেন, এমন সুযোগ আর কবে আসবে কে জানে, এ বেলা হাত খুলে কামিয়ে নি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর মাথায় নেত্রীর হাত; তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং নিয়তি তাঁর বাঁধা রাঁড়ের চাইতে বেশি কিছু নয়। কর্মের ফল যে নিজের কাছেই ফিরে আসে, মানুষ এই সত্য বিস্মৃত হয় বলেই পাপাচারের সময় ক্ষণিকের ক্ষমতার দর্পে মাটিতে তার পা পড়ে না। সময় যখন শোধ তুলতে নামে তখন ভয়ে-আতঙ্কে তষ্করের মুখে খেউড় ছোটাটাই স্বাভাবিক।

আদালতের নির্দেশে ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি নাশ! পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা আগে কখনও ঘটে নি। অযোগ্যদের ক্ষমা নেই কিন্তু একজন যোগ্যের‌ও চাকরি চলে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আদালতের চোখে এস‌এসসি-র গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই বৈধতা হারিয়েছে। কেন হারিয়েছে, ডিভিশন বেঞ্চের ২৮২ পাতার রায়েই তা স্পষ্ট। নিয়োগ প্রক্রিয়া অবৈধ প্রমাণিত হ‌ওয়ার পর ‘প্যানেল’ কীভাবে বৈধ থাকে। এর সম্পূর্ণ দায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের, রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রকের। দায় এড়ানোর সুযোগ নেই রাজ্য ক্যাবিনেটের মাথার‌ও। ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়’- এই প্রবাদ তো মিছে নয়।

Feature graphic is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *