বিশেষ প্রতিবেদন: কলকাতা হাইকোর্টের সোমবারের রায়ের পর থেকেই বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তৃণমূল। এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ২০১৬ সালের পুরো প্যানেলটাই বাতিল করে দিয়েছে হাইকোর্ট। এর ফলে ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি গেছে। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়াই যায় এবং ইতিমধ্যেই কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য সরকার ও স্কুল সার্ভিস কমিশন। যদিও সুপ্রিম কোর্টের উপরে তৃণমূল নেতৃত্ব আস্থা রাখতে পারছেন বলে মনে হয় না। রাখতে পারলে রায়ের সমালোচনা করার নামে হাইকোর্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারতেন না তাঁরা।
বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে এমন কুৎসিত মন্তব্য দেশে বিরল
নিয়োগ দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার পরপরই নির্বাচনী প্রচারসভা থেকে হাইকোর্টের তীব্র সমালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রায় ঘোষণার পর থেকে যতগুলি সভা মমতা করেছেন, প্রত্যেকটিতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাইকোর্টের বিচারপতিদের প্রতি বিষ উগড়ে দিয়েছেন তিনি। বুধবার পূর্ব বর্ধমান লোকসভা কেন্দ্রের আউসগ্রামে প্রচারে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘হাইকোর্টকে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে বিজেপি। সুপ্রিম কোর্টের কথা আমি বলছি না। সেখানে এখনও আমরা বিচারপ্রার্থী। কিন্তু হাইকোর্টে বিজেপি চাইলেই শুধু বিচার হয়। ওরা যা চায়, হয়ে যায়। আর কেউ বিচার পায় না।’’ তবে বৃহস্পতিবার মমতা সহ তৃণমূলের বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরুলিয়ায় প্রচারে গিয়ে অভিষেকের দাবি, “দেশ থেকে কলকাতা হাইকোর্ট তুলে দেওয়া উচিত।”
রাজনৈতিক মহল বলছে, বিচার বিভাগ এবং বিচারপতিদের সমালোচনা দেশে এর আগে অনেকেই করেছেন কিন্তু কারও মুখে এত মারাত্মক কথা শোনা যায় নি। এদিন অভিষেক বলেন, “বিজেপির সঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিদের যোগসাজশ রয়েছে। ক্রিকেটে যেমন ম্যাচ ফিক্সিং হয়, বিজেপি তেমনি কোর্ট ফিক্সিং করেছে। বিজেপি নেতাদের নির্দেশ অনুযায়ী কলকাতা হাইকোর্ট একের পর এক রায় দিয়ে যাচ্ছে। এই কলকাতা হাইকোর্ট দেশ থেকে তুলে দেওয়া হোক।”
বেটিং চক্রের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে বিচারপতিদের তুলনা!
এখানেই না থেমে অভিষেক বলেন, “হাই কোর্টের অর্ডারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিজেপির স্ট্যাম্প রয়েছে। ক্রিকেটে যেমন ম্যাচ ফিক্সিং হয়, যাঁরা বেটিং করেন, আগে থেকেই বলে দেন পরের বলে ছক্কা হবে না কি উইকেট পড়বে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এগুলো আসলে অর্ডার ফিক্সিং! কোর্ট ফিক্সিং! বেটিংয়ে নতুন মাত্রা যোগ করছে কলকাতা হাই কোর্টের একাংশ। বিজেপি বেটিং করছে। তার দোসর হচ্ছেন বিচারের আসনে থাকা বিচারপতিরা। মানুষ এর জবাব দেবে।’’ তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড আরও বলেন, ‘‘আদালত বলছে, কয়েক জন প্যানেলের বাইরে থেকে চাকরি পেয়েছেন, তাই পুরো প্যানেলটাই বাতিল। তা হলে সেই যুক্তি অনুযায়ী এক জন বিচারপতি বিজেপিতে যোগদান করেছেন, অর্থাৎ, সব বিচারপতিই বিজেপি হয়ে গিয়েছেন! আদালতের যুক্তিতে তো তা-ই হচ্ছে।” হাইকোর্টকে কটাক্ষ করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এসএসসি মামলা যে বিচারপতি শুনছিলেন, তিনি এখন বিজেপির প্রার্থী। তিনি বিচারপতি থাকাকালীন বলেছেন, বিজেপি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল এবং তিনিও বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগে ছিলেন। সেই বিচারপতি যদি বিজেপিতে যান, তা হলে তো দেশ থেকে কলকাতা হাই কোর্টটাকেই তুলে দেওয়া উচিত!”
উল্লেখ্য নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একাধিক মামলা হয়েছে। বিচারপতি পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার আগে এক সময় নিয়োগ দুর্নীতির কয়েকটি মামলার শুনানি হত জাস্টিস অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চে। পরে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত সকল মামলাই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিচারপতির আসনে বসে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যখনই কোনও নির্দেশ দিয়েছেন বা মন্তব্য করেছেন, তা পছন্দ না হলেই তাঁকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তমলুক আসনে বিজেপির প্রার্থী। শুধুমাত্র এই যুক্তিতেই হাইকোর্টের রায় বিজেপির সঙ্গে ফিক্সিং করে দেওয়া, এমন ভয়ঙ্কর মন্তব্য করতে পিছপা হচ্ছেন না অভিষেক!
সাংসদ হয়ে সাংবিধানিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ!
তৃণমূলের নেতা ছাড়াও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও একটা পরিচয় আছে। তিনি ভারতের সংসদের একজন সদস্য। একজন সাংসদ কীভাবে ক্রিকেটের বেটিং চক্রের সঙ্গে হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের নাম জুড়ে দিয়ে কটাক্ষ করতে পারেন? প্রশ্ন রাজ্যের আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞ মহলের। হাইকোর্ট বিজেপি নেতাদের সঙ্গে ফিক্সিং করে গড়াপেটা রায় দিয়েছে কিম্বা হাইকোর্টের রায়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিজেপির স্ট্যাম্প রয়েছে- অভিষেকের এই মন্তব্যে আদালতের মর্যাদাহানি হয়েছে বলেই মনে করছেন আইনজীবীরা।
ভারতের আইনসভার একজন আইন প্রণেতা বলছেন, কলকাতা হাইকোর্ট দেশ থেকে তুলে দেওয়া হোক। তার মানে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের উচ্ছেদ চাইছেন! অভিষেকের এই মন্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল স্তম্ভিত। বিচার বিভাগের উপর আস্থা হারিয়ে একজন সাংসদ যদি দেশ থেকে উচ্চ আদালতের উচ্ছেদ চাইতে পারেন, তবে তো তিনি দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলেন। অনেকেই মনে করছেন, এরপরেও আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিষেককে ঘাড়ে ধরে হাইকোর্টের কাঠগড়ায় না তুললে জনগণের মনে বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে যে সম্ভ্রম রয়েছে,তা ক্ষুণ্ন হবে।
Feature graphic is representational and created by NNDC.