একবগ্গা এক তামিল ব্রাহ্মণ, যাঁর কাছে ভারতের ভোটাররা চিরকৃতজ্ঞ

একবগ্গা এক তামিল ব্রাহ্মণ, যাঁর কাছে ভারতের ভোটাররা চিরকৃতজ্ঞ


ভারতের দশম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষনের বিরোধিতায় ডান কিম্বা বাম- সকলের‌ই ছিল এক সুর। শেষনকে পাগল পর্যন্ত বলেছিলেন জ্যোতি বসু। তিনি একগুঁয়েমি না করলে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র চালুই হত না। একবগ্গা সেই তামিল ব্রাহ্মণ দেখিয়েছিলেন শিরদাঁড়া টান টান থাকলে ব্যবস্থাকে অনেকটাই শোধরানো সম্ভব। টিএন শেষনকে নিয়ে কাহিনী। কাহিনীটা ইনফোয়ানার এমবেডেড ভিডিওতেও দেখে নিতে পারেন আপনি-

ইনফোয়ানা ফিচার: বছর সাড়ে চার আগে চেন্নাইয়ের এক বৃদ্ধাবাসে নীরবে-নিভৃতে জীবনের রঙ্গশালা থেকে চিরকালের মতো প্রস্থান করেছেন তিনি। কিন্তু দেশে নির্বাচন আসলেই তাঁর নাম ওঠে। এবার‌ও উঠেছে। ভবিষ্যতেও উঠবে। মানুষটার নাম তিরুনেল্লাই নারায়ণ আইয়ার শেষন। দেশের মানুষ তাঁকে চেনেন টি এন শেষন নামে। ১৯৫৫ ব্যাচের এই আইএএস ক্যাডার নিজের সুদীর্ঘ আমলা জীবনে ক্যাবিনেট সচিব সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করলেও ইতিহাস হয়ে থাকবেন ভারতের দশম ‘মুখ্য নির্বাচন কমিশনার’ হ‌ওয়ার সুবাদে ।

টি এন শেষন। একাধারে নন্দিত এবং নিন্দিত। যে কারণে এক বগ্গা এই তামিল ব্রাহ্মণ দেশের জনগণ দ্বারা নন্দিত সেই এক‌ই কারণে জীবদ্দশায় রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা বহু নিন্দিত হয়েছেন তিনি। শেষনকে বলা হয় ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার মহান সংস্কারক। আরেক প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএস কৃষ্ণমূর্তি তাঁর Miracle of Democracy: India’s Amazing Journey নামক ব‌ইটিতে শেষন সম্পর্কে যথার্থ‌ই লিখেছেন, ‘যদি কোন‌‌ও দিন নির্বাচন কমিশনের ইতিহাস লেখা হয় তবে তাকে দুটি ভাগে ভাগ করতে হবে। একটি ‘প্রি-শেষন যুগ’, যখন কমিশন সরকারের‌ই একটি বিভাগ হিসেবে কাজ করত। আরেকটি ‘পোস্ট-শেষন যুগ’, যখন কমিশন অনেক বেশি স্বতন্ত্র হয়ে উঠল।‘

দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলঙ্কমুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এই দুঁদে আমলা। সংবিধান নির্বাচন কমিশনের হাতে যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, তার বাইরে অতিরিক্ত কিছুই দাবি করেন নি শেষন। নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যেই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এনেছিলেন টিএন শেষন। কাজটা শেষনের জন্য মোটেই সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া।ক্ষমতাসীনরা পদে পদে বাধা দিয়েছে। সরকার ও বড় বড় রাজনৈতিক দলগগুলির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন বারে বারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের জয় ছিনিয়ে এনেছেন একরোখা মানুষটি। একটা কথা জেনে রাখুন, টি এন শেষনের আগে দেশের আর কোনও মুখ্য নির্বাচন কমিশনার‌ই সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে গিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শোধরানোর ঝুঁকি নেন নি ।

টি এন শেষন ছিলেন জেদি, একরোখা অথচ ঠান্ডামাথা। ছিলেন স্পষ্টবক্তা কিন্তু রসবোধের অভাব ছিল না। ছিলেন আপাদমস্তক সৎ। নজর ছিল তীক্ষ্ণ। চরম চাপের মুখেও নিজের লক্ষ্যে থাকতেন অবিচল। একজন আমলা হিসেবে শেষনের সবথেকে বড় গুণ ছিল তিনি আইনটা খুব ভালো বুঝতেন এবং সংবিধান গুলে খেয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও সাহসের অভাব থাকলে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একের পর এক ঝাঁকুনি দিতে পারতেন না টিএন শেষন।

নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার চাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল শেষনের।‌ ছবি: সংগৃহীত

১৯৯০ এর ১২ ডিসেম্বর দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার পদে ভি এস রামাদেবীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন টি এন শেষন। চন্দ্রশেখর তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শেষনের খিটিমিটি যখন প্রায় প্রতিদিনই মিডিয়ার খোরাক তখন চন্দ্রশেখরকে বলতে শোনা গিয়েছে , প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার সবথেকে বড় ভুল ‘সিইসি’ পদে টি এন শেষনের নাম সুপারিশ করা। চন্দ্রশেখরের মতো রাজনীতিকের জন্য যা ছিল অভিশাপ দেশের গণতন্ত্রের জন্য তাই হয়ে উঠল পরম আশীর্বাদ। নির্বাচন পরিচালনায় অনমনীয়তার জন্য নেতাদের চক্ষুশূল হলেও জনগণের কাছে শেষন হয়ে উঠলেন আইকন।

ভোটে ছাপ্পা, হিংসা ও রক্তপাত দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন দেশের মানুষ। আর ছিল টাকা ছড়িয়ে, মদ বিলিয়ে ভোট কেনা। সিইসির দায়িত্ব পেয়েই ভারতীয় গণতন্ত্রের দেহ থেকে এইসব রোগ সারাতে একের পর এক কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন শেষন। রাজনৈতিক দলের রথী-মহারথীরা গোঁসা হলেন। কিন্তু পরোয়া করলেন না তিনি। ভোটের সময় আদর্শ আচরণবিধি লাগু করলেন কঠোরভাবে। আজ ভোটদান কালে সচিত্র পরিচয় পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এটা চালু করেছিলেন শেষন‌ই। কোনও সন্দেহ নেই টি এন শেষন গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলোর মধ্যে সবথেকে নির্ণায়ক সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র বা ইলেকশন ফটো আইডেন্টিটি কার্ডের প্রবর্তন।

ভোটদান কালে ভোটার আইডি কার্ড দেখানো এখন বাধ্যতামূলক। ভোটার কার্ড চালু করতে কম বেগ পেতে হয় নি শেষনকে। ছবি: সংগৃহীত

সচিত্র ভোটার কার্ড চালু করাটাকে একটি ধর্মযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছিলেন টিএন শেষন। এপিক নিয়ে শেষনের পরিকল্পনায় যত রকমের বাগড়া দেওয়া সম্ভব তার সব‌ই করেছিল বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। সেই সময় বিহারে স্বচ্ছতার সঙ্গে ভোট পরিচালনা ছিল নির্বাচন কমিশনের জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ । সচিত্র পরিচয়পত্র চালুতে সবথেকে বেশি বাধা এসেছিল লালুপ্রসাদ যাদবের কাছ থেকে। এড়ে শেষনের সঙ্গে পেড়ে না উঠে লালু শেষে বলে বসলেন, পরপুরুষেরা ঘুঙ্ঘুট খুলিয়ে দেহাতি ঘরের মেয়ে-ব‌উদের ফটো তুলবে তাও আবার হয় নাকি!”

সাংবাদিকেরা শেষনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই জ্যোতি বসু বলতেন, “ও একটা পাগল।” যদিও সব বাধা অতিক্রম করে, নেতাদের কটূক্তি-বিষোদগার জামার আস্তিন থেকে ধুলো ঝাড়ার মতো করে ঝেড়ে ফেলে পদে আসীন থাকতে থাকতেই সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র প্রণয়নের কাজটি প্রায় নব্বই শতাংশ সেরে ফেলেছিলেন টি এন শেষন। টি এন শেষনের আমলেই ভোটে অনিয়মের ১৫০টি তালিকা প্রস্তুত করেছিল নির্বাচন কমিশন।

দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে মশাল জ্বালিয়ে গেছেন শেষন, সেই মশাল যেন না নেভে। গ্রাফিক্স: এ‌এনডিসি

নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন‌ই যে শেষ কথা এবং নির্বাচন কমিশন চাইলে যে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব, তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন শেষন। ‘প্রি শেষন যুগের’ নির্বাচন কমিশনের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী ‘পোস্ট শেষন যুগের’ নির্বাচন কমিশন। নাগরিকদের অনেক বেশি আস্থার‌ও। গোলগাল, স্থূলকায় ভীষণ জেদি তামিল ব্রাহ্মণ‌টি যে মশাল জ্বালিয়ে গেছেন, সেই আলোতেই পথ চলেছেন তাঁর উত্তরসূরীরা। সেই মশাল যেন না নেভে। ভারতের ভোটদাতা নাগরিকবৃন্দ টিএন শেষনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।‌

Feature graphic is representational and created by NNDC.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *