বিএনপির উচিত ছিল, নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামি লিগ সরকারকে স্নায়ুর চাপে ফেলা। বিশেষ রাজনৈতিক প্রতিবেদনে আরও যা লিখলেন ওয়াশিকুর রহমান শুভ্র-
রবিবার বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফলাফল কী হবে, সবার জানা। আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা শুধু বাকি। রাতের মধ্যে যা সারা হয়ে যাবে। বিএনপি সহ যে দলগুলি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এই নির্বাচন থেকে দূরে, তারা শেষ পর্যন্ত এমন কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ, যারা জেরে নির্বাচন পন্ড হতে পারে। আন্দোলনের জেরে নির্বাচন পন্ড হলে শেখ হাসিনার সরকার সত্যিই বিপদে পড়ত। কিন্তু বিএনপির আন্দোলনের জেরে বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা চললেও সেটা এত ব্যাপক নয় যে হাসিনাকে মসনদ থেকে এখনই টলিয়ে দিতে পারে।
২০০৮-এর সংসদ নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরেই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে দেয় আওয়ামি লিগ সরকার। তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলনে বিএনপি-জামাত। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামি লিগ-বিএনপির শক্তি সমান সমান। কিন্তু তারপরেও বিএনপি ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার কূটকৌশলের কাছে বিএনপি বারে বারে ধরাশায়ী হয়েছে। পাশাপাশি নিজেদের বড় কয়েকটি ভুলের কারণেও জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও দলটির ভবিষ্যত আজ প্রশ্নের মুখে।
বিএনপির শক্তি এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে দশ বছর আগে তার থেকে অনেক অনেক বেশি ছিল। ২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল এমনকি আওয়ামি লিগও ভাবতে পারে নি, বিএনপিকে এত লম্বা সময় ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা যাবে। ২০১৩ সালে শেখ হাসিনার সরকারের অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। ১৩-র সংসদ নির্বাচনে জেতার ব্যাপারে হাসিনার নিজের আত্মবিশ্বাস ছিল কিনা সন্দেহ। সে’বার কার বুদ্ধিতে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে এলেন না, কে জানে! সম্ভবত তাঁর বড় ছেলের চাপেই সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি খালেদা। অথচ বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য খালেদার কাছে ভাল প্রস্তাব রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর থেকে ডিনারের দাওয়াত পেয়েও প্রত্যাখান করেছিলেন খালেদা। সে সময় তিনি সংসদের বিরোধী দলনেত্রী। শোনা যায়, নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির হাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকও ছাড়তে প্রস্তুত ছিলেন হাসিনা।
২০১৩-তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে বছরভর আন্দোলনে ছিল বিএনপি ও তার জোট শরিকেরা। তখনও জামাতকে পুরোপুরি দমন করতে পারেন নি হাসিনা। জামাতের সহযোগিতায় রাজপথে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল বিএনপি। আন্দোলন আওয়ামি লিগ সরকারকে যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেললেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফেরে নি। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় নি এবং ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও করেও তেরোর ডিসেম্বরে ভোট ঠেকাতে পারে নি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, তেরোর নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সুযোগ ছিল। এমনকি ক্ষমতায় না এলেও বড় সংখ্যায় আসন নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধীদলের মর্যাদা ছিনিয়ে নিতে পারত। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে থাকার পাশাপাশি সংসদীয় রাজনীতিতেও সমান সক্রিয় থাকলে, আজকে দলটির যে দুর্দশা হয়েছে, তা এড়ানো সম্ভব হত। এটা সত্যি যে, বিএনপির উপরে দমনপীড়ন চলছে। বাংলাদেশের গত পনেরো বছরের রাজনীতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শেখ হাসিনার সরকার ধাপে ধাপে তার একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করেছে। ২০১৩-র ফাঁড়া কাটিয়ে ওঠার পর বিএনপিকে আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে চান নি হাসিনা। গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে টানা হরতাল-অবরোধের নামে যানবাহনে আগুন দিয়ে লোক পুড়িয়ে মেরে হাসিনার কাজটি সহজ করে দিয়েছে বিএনপি নিজেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ঠেসে ধরে নিঃশেষ করে দেওয়াই ট্র্যাডিশন। হাসিনা নিজে পঁচাত্তরে পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামি লিগকে রাজনীতি করার অবাধ পরিসর দিত, বিএনপির ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ তা বলে না। ২০০৪-এর ২১ অগাস্ট আওয়ামি লিগের জনসভায় যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়েছিল তাতে তো শেখ হাসিনার জিন্দা থাকারই কথা না। হাসিনা তাই বারে বারে বলেন, “আমি জিন্দা লাশ! আমার বেঁচে থাকাটা আল্লাহর রহমত।” আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে ২০১৮-য় কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি। সে’বার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি কোনও ভুল করে নি। কিন্তু ততদিনে বিএনপির মাজা ভেঙে দিয়েছেন হাসিনা। বেগম খালেদা জিয়াকে যে অভিযোগে জেল পাঠানো হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। প্যারোলে মুক্ত খালেদা এখন মর মর। যোগ্য নেতৃত্বের অভাব বিএনপিকে যে একটা দিশাহীন দলে পরিণত করেছে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রতিপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কীভাবে তাকে ঘায়েল করতে হয়, বিএনপি সেই কৌশল জানে বলে মনে হয় না। কোনও সন্দেহ নেই যে, আঠারোর সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি ও অনিয়ম দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন। হাসিনা ভালোই জানতেন, আঠারোর মতো আরও একটা নির্বাচন করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না। বিশেষ করে আমেরিকা সহ পশ্চিমি দুনিয়ার দিক থেকে হাসিনা সরকারের উপরে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট চাপ ছিল এবং আছে। এবং এই চাপের কারণেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ করার একটা তাগিদ অনুভব করেছেন হাসিনা। বিএনপির উচিত ছিল, নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামি লিগ সরকারকে স্নায়ুর চাপে ফেলা। বিএনপি কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ঠেকাতে পারল? পারল না তো। বরং বিএনপি যদি তার সমস্ত উদ্যম, শক্তি ও জনবল নির্বাচনের মাঠে ঢেলে দিত, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হত। সেই নির্বাচনে সরকারি দলের কারচুপি দৃশ্যমান হলে বিদেশিদের বিএনপির বলার সুযোগ থাকত, কেন তারা শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে দাঁড়াতে চান না।
৮ জানুয়ারি থেকে বিএনপি নেতৃত্বকে তাকিয়ে থাকতে হবে, কবে জো বাইডেন প্রশাসন শেখ হাসিনা সরকারের উপরে স্যাংশন দেবেন আর কবে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে। আমেরিকা বাংলাদেশকে কতটা গুরুত্ব দেয়, এটাই মেপে উঠতে পারলেন না বিএনপির বাক্যবাগীশ নেতারা। অন্য দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমেরিকার খুবই গরজ, এটা যাঁরা ভেবে নিয়েছেন, তাঁরা রাজনৈতিকভাবে নির্বোধ। চব্বিশে দুনিয়া জুড়ে মাথা ঘামানোর মতো আরও অনেক সিরিয়াস বিষয় বাইডেন প্রশাসনের সামনে আছে। হোয়াইট হাউসের কাছে বাংলাদেশ এখনও এতটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় যে শেখ হাসিনাকে টাইট দেওয়ার জন্য পরশুই কড়া কড়া কয়েকটা স্যাংশন দিয়ে বসবে।
আসলে লন্ডনে বসে বিএনপিকে যিনি চালাচ্ছেন, সেই তারেক জিয়ার কোনও রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই নেই। কোনও কালেই ছিল না। মা প্রধানমন্ত্রী থাকতে তিনি হাওয়া ভবনে বসে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে দলকে ডুবিয়েছেন, এখনও ডুবিয়ে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার কৌশলের কাছে দফায় দফায় বোকা হওয়া ছাড়া গত পনেরো বছরে বিএনপির আর কোনও রাজনৈতিক অর্জন নেই।
Feature image- NNDC.