দিদির কৃপায় ডিজি হলেন রাজীব কুমার, চক্ষুশূলের পৌষ মাসে অসহায় কুণালের ভরসা ভগবান

দিদির কৃপায় ডিজি হলেন রাজীব কুমার, চক্ষুশূলের পৌষ মাসে অসহায় কুণালের ভরসা ভগবান


রাজীব কুমারকে ডিজি বানিয়ে মমতা কি দলের মধ্যেই বার্তা দিতে চাইলেন? লিখলেন নির্বাণ রায়-

প্রশাসন ও দলে তাঁর রাশ যতটুকু আলগা হয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে তা ভালোই সামলে নিয়েছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহেই তা পরিষ্কার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, প্রশাসনের উপরে তাঁর পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইদানিং ঘটনা তেমন ছিল না। বাজারে এই সেদিনও কানাঘুষো ছিল, দলের পাশাপাশি প্রশাসনের ভেতরেও তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেড়েছে। যা রটে, তার কিছুটা ঘটে। সম্ভবত সংগঠন ও সরকারের কাজে অতিরিক্ত নাক গলাতে গিয়েই পিসির বিরক্তির কারণ হয়েছেন ভাইপো। যাঁরা মনে করেছিলেন তৃণমূলের ভেতরে খুব তাড়াতাড়ি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নির্ণায়কশক্তি হয়ে উঠবেন, গত ২৪ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোরে দলের সভায় তাঁদের ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছেন মমতা।

কুণাল ঘোষের মতো ভুঁইফোড়কে সামনে রেখে তৃণমূলের তথাকথিত সেকেন্ড ইন কমান্ড ফোঁস করার একটা চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু তাতে যে তাঁর লাভ বিশেষ কিছু হয় নি মুখপাত্র কুণালের চুপসে যাওয়াই তার প্রমাণ। বস্তুতপক্ষে ২৪ নভেম্বরের পর থেকে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড আদৌ দলকে কমান্ড দেওয়ার কাজে সেকেন্ড পজিশনে আছেন কিনা তা নিয়েই রাজনৈতিক মহলের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ২৪ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোরে দলের বিশেষ অধিবেশনে অভিষেক কার্যত ব্রাত্য হয়ে যাওয়ার পর দিন একটি নিউজ চ্যানেলে কত বড় বড় কথা বলেছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক ও মুখপাত্র কুণাল ঘোষ! দলে তারুণ্যের প্রাধান্য ও বৃদ্ধতন্ত্রের অবসান দাবি করে সেদিন কুণাল হাউহাউ করে যা বলেছিলেন, তা তৃণমূল সুপ্রিমো গ্রাহ্যের মধ্যে এনেছেন, এমন প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। বরঞ্চ গত ৩৫ দিনে এমন কিছু পদক্ষেপ মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, যাতে প্রমাণিত হয় কে কী চাইল, সে’সবের থোড়াই পরোয়া করছেন তিনি।

অভিষেকের হয়ে ফাল পাড়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই ঝানু কুণাল বুঝতে পারেন, বাড়াবাড়ি করলে আম ও ছালা দুই-ই যাবে। অতঃপর সুর পাল্টাতে দেরি করেন নি তৃণমূল মুখপাত্র। আইপিএস রাজীব কুমারের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন রাজ্যবাসী। তিনি সেই আইপিএস, সারদা মামলার তদন্তে যাঁর সরকারি আবাসনে সিবিআই হানা দিলে মুখ্যমন্ত্রী রাজপথে ধর্নায় বসে পড়েছিলেন। তখন রাজীব কুমার কলকাতা পুলিশের কমিশনার। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতারি এড়াতে দীর্ঘ ২০-২২ দিন নিরুদ্দেশ পর্যন্ত ছিলেন এই দুঁদে পুলিশ অফিসার। কীভাবে তিনি সিবিআইয়ের হাত থেকে বাঁচলেন, কে জানে! রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে সবথেকে বড় অভিযোগ, সারদা মামলার তদন্ত রাজ্য পুলিশের হাতে থাকার সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গায়েব করেছেন তিনি। যাইহোক, দৈবের কৃপা হোক বা অন্য কোনও কারণে রাজীব রক্ষা পেলে তাঁকে রাজ্যের তথ্য ও প্রযুক্তি দফতরের ‘প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি’ করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। এরপর থেকেই রাজীব কুমার অন্তরালে। আড়াল থেকে সরিয়ে এনে রাজীব কুমারকে এবার রাজ্য পুলিশের ডিজি পদে বসিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা কেন হঠাৎ রাজীবকুমারকে রাজ্য পুলিশের শীর্ষপদে বসালেন, এটাই এখন রাজনৈতিক মহলে সবথেকে বড় জল্পনার বিষয়।

আইপিএস রাজীব কুমারের কর্মকুশলতা নিয়ে কার‌ও কোন‌ও সন্দেহ নেই। রাজীব মমতার কতটা বিশ্বস্ত, এই প্রশ্নের ফয়সালা সে’দিন‌ই হয়ে গেছে, যে’দিন মমতা তাঁর বাড়ির সামনে ধর্নায় বসেছিলেন। অন্যদিকে যাঁদের নাম শোনা মাত্রই কুণাল ঘোষের গ্রাত্রদাহ হয়, রাজীব কুমার তাঁদের একজন। সারদা মামলায় তাঁকে বলির পাঁঠা করার পেছনে রাজীবের বড় রকমের হাত ছিল বলে কুণাল ঘোষের অভিযোগ। নিজের দুর্দশার জন্য রাজীব কুমার ও অর্ণব ঘোষ- এই দুই আইপিএস-কে শাপশাপান্ত পর্যন্ত করেছেন কুণাল, যেমনভাবে তিনি শাপশাপান্ত ও বাপান্ত করেন মুকুল-পার্থের। এহেন বিতর্কিত আইপিএসকে কেন ফের শীর্ষপদে ফেরালেন মমতা?

কুণালের চক্ষুশূল রাজীব কুমারের সঙ্গে অভিষেকের কোন‌ও খাতির আছে বলে মনে হয় না। রাজীব কুমারের ডিজি পদ প্রাপ্তিতে উল্লসিত হ‌ওয়ার বদলে অভিষেকের অসন্তুষ্ট হ‌ওয়াটাই স্বাভাবিক। রাজীব কুমার ডিজি হতে চলেছেন, জানার পর সামাজিক মাধ্যমে কুণাল ঘোষ লিখেছেন, “প্রসঙ্গ: রাজীব কুমার ডিজি। উনি দক্ষ অফিসার। মাঝখানে ওঁর সঙ্গে তীব্র বিরোধ ছিল। কালীপুজোর দিন CM-এর বাড়িতে বহুদিন পর দেখা ও সৌজন্য বিনিময় হয়। রাজীব, আপনাকে শুভেচ্ছা। তবে কখনও কারুর কথা শুনে আমার মত কোনো নির্দোষের জীবন নষ্ট করতে যাবেন না। এসব ভগবান ক্ষমা করেন না।” কুণালের অবস্থা দেখলে করুণা হয়। নিজের জীবন নষ্টের জন্য কুণাল যেই লোককে দায়ী করেন, তাঁর প্রিয় নেত্রী সেই লোককেই তাঁর বাহিনীর দন্ডমুন্ডের কর্তা বানিয়ে দিচ্ছেন! দলের সুপ্রিমোর উপরে নয় কুণালকে শেষ পর্যন্ত ভগবানের উপরে ভরসা রাখতে হচ্ছে। ‘যাঁর কেউ নেই, তাঁর ভগবান আছেন’- কুণালের পোস্ট পড়ে এই কথাটিই আবার মনে পড়ছে।

বিতর্কিত রাজীব কুমারকে রাজ্য পুলিশের ডিজি পদে বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে মমতা হয়তো দলের ভেতরেই কাউকে কাউকে বার্তা দিতে চাইলেন। চালু কুণাল বার্তাটা ভালো‌ই পড়তে পেরেছেন। তাই রাজীবকে মুখে শুভেচ্ছা জানিয়ে মনে মনে উপর‌ওয়ালার কাছে বিচার দিচ্ছেন তিনি। এছাড়া আর কীই বা করার আছে অসহায় কুণালের। তৃণমূলে যাঁর উত্থান কুণালের জন্য বলকারক তিনি আপাতত ব্যাকফুটে। মমতা ভাইপোকেই পুছছেন না তো মুখপাত্র কুণাল!

Feature graphic is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *