পলিটিক্যাল ডেস্ক: দলের দায়িত্ব আর ঘাড়ে নিতে চান না অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফেরালেন অনুগামীদের অনুরোধও। লোকসভা নির্বাচনে নিজের ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রেই শুধু সময় দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন অভিষেক। তৃণমূলের নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে অভিষেকের অনাসক্তি দেখে স্বাভাবিকভাবেই মুষড়ে পড়েছেন কুণাল ঘোষ, পার্থ ভৌমিক, তাপস রায় ও ব্রাত্য বসুর মতোন অনুগামীরা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মনে হচ্ছিল, তৃণমূলের সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব বুঝি সেকেন্ড ইন কমান্ডের হাতেই চলে গেছে। অভিষেক শিবির থেকে সে’সময় কৌশলে এমন কথাও হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, রাজ্য প্রশাসনের দায়িত্ব ভাইপোর হাতে আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। অথচ বছর ঘোরার আগেই রাজ্যের শাসকদলের অন্দরে চিত্রটা পাল্টে গেছে। সামনেই লোকসভা নির্বাচন। কিন্তু কুণাল যাঁকে দলে মমতাদির পরেই প্রধান সেনাপতি বলেন, তিনি কার্যত হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন।
কী হইতে কী হইয়া গেল অভিষেকের!
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, পিসির উপর অভিমান অথবা অসন্তোষ থেকেই দলের কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন অভিষেক। আসলে তিনি যা চাইছিলেন, বা যেমনভাবে দল ও প্রশাসন পরিচালনা করতে চাইছিলেন, মমতা তা নাকচ করে দেওয়াতেই হয়তো দলের কাজে আগ্রহ হারিয়েছেন ভাইপো। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই তৃণমূলের ভেতরে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের পাশাপাশি ক্যামাক স্ট্রিটকে ঘিরেও একটা সমান্তরাল ভরকেন্দ্র গড়ে ওঠার ইঙ্গিত মিলছিল। নির্বাচনের পর তৃণমূলে অভিষেকের নিয়ন্ত্রণ এতটাই বৃদ্ধি পায় যে তাঁর অনুগামীদের দাপটে দলের একটা অংশ রীতিমতো কোনঠাসা হয়ে পড়ে। তৃণমূলের ভেতরে অভিষেকের কাজকর্ম নিয়ে যাঁদের অসন্তোষ বাড়ছিল, তাঁরা সবাই মিডিয়ার কাছে মমতাপন্থী হিসেবেই পরিচিতি।
একুশ ও বাইশ- এই দুই বছর তৃণমূলের এমন কোনও কর্মসূচি ছিল না, যেখানে মমতার ছবির পাশেই অভিষেকের ছবি স্থান পায় নি। একাধিক ইস্যুতে তৃণমূলের হয়ে মুখ খুলেছেন একা অভিষেক। গোয়া- ত্রিপুরায় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন অভিষেক। সাংগঠনিক স্তরে রদবদলের সিদ্ধান্তগুলিও নেওয়া হয়েছে অভিষেকের নির্দেশে। অভিষেকের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায় তেইশে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলের প্রার্থী বাছাই থেকে রণকৌশল তৈরি এবং প্রচার- সবেতেই অভিষেকের প্রাধান্য ছিল প্রশ্নাতীত। পঞ্চায়েত নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়ে সাফল্য লাভের পরে একশ দিনের কাজ নিয়ে তৃণমূলের কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠা অভিষেক কেন পুজোর আগেই ঝিমিয়ে পড়লেন?
উপমুখ্যমন্ত্রী হতে গিয়েই কি পিসির রোষে ভাইপো?
তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলেই গুঞ্জন শোনা যায়, বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই নাকি পিসির রোষানলে পতিত হয়েছেন ভাইপো। একে মমতাপন্থী ও অভিষেকপন্থীদের নিত্য খিটিমিটিতে দলের অবস্থা নাজেহাল হয়ে উঠেছিল। যা নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি করলে দলের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে মনে করেছেন মমতা। এদিকে শুধু দলেই প্রভাব বাড়িয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না অভিষেক, প্রশাসনের ভেতরেও নিজের অনুগত একটা গোষ্ঠী বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের গ্রেফতারির পর মন্ত্রিসভায় রদবদল এবং সেখানে নিজের অনুগত বিধায়কদের ঢোকানোর দাবিতে অভিষেক গোঁ ধরেছিলেন বলে শোনা যায়। যা পত্রপাঠ নাকচ করে দেন মমতা। লোকসভা নির্বাচনের আগেই সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী পদে তাঁর বসাটা জরুরি- অনুগামীদের কেউ কেউ অভিষেককে এই বুদ্ধিটাও দিয়েছিলেন বলে কানাঘুষো। বুদ্ধিদাতাদের মধ্যে সাংবাদিক থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া তৃণমূলের এক মুখপাত্রও ছিলেন বলে খবর। অভিষেক উপমুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন- বছরের মাঝামাঝি এমন হাওয়া কিন্তু তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল একটি মহল। অভিষেক নিজে বিষটিতে যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়ে ভাল করেন নি বলে তৃণমূলের অনেকেই মনে করেন।
ভাইপোকে এখনই উপমুখ্যমন্ত্রী বানানো তো দূরের কথা, সংগঠন বা প্রশাসন- কোনও ক্ষেত্রেই নিজের রাশ এতটুকু আলগা হয়ে পড়ুক, মমতা তা চান না। লোকসভায় প্রার্থী বাছাই নিয়ে অভিষেক জোরাজুরি শুরু করতেই প্রমাদ গোনেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের ভেতরে ভাইপো চন্দ্রবাবু নায়ডু টাইপের কোনও ‘ক্যু’ করার আগেই মমতা সতর্ক হয়ে গেছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। ২৪ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের বিশেষ অধিবেশন থেকেই মমতার পদক্ষেপ স্পষ্ট। লোকসভার প্রার্থী তালিকা তাঁর পছন্দ মাফিক হবে- দলের বিশেষ অধিবেশনেই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। নেতাজি ইন্ডোরের মঞ্চে লাগানো ব্যানারে অভিষেকের ছবি পর্যন্ত ছিল না। পর দিন কুণাল এ নিয়ে অভিযোগ তুললেও খোদ দলের সুপ্রিমোর নির্দেশেই তা হয়েছিল বলে তৃণমূলের ভেতরে সবাই তা জানতেন। অনুগত আইপিএস রাজীব কুমারকে তথ্য ও প্রযুক্তি দফতরের ‘প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি’ পদ থেকে সরিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি পদে বসানো কিম্বা অনুগত আইএএস নন্দিনী চক্রবর্তীকে স্বরাষ্ট্র সচিব করা- মুখ্যমন্ত্রীর এই দুই সিদ্ধান্তের পেছনেই বড় তাৎপর্য আছে বলে মানছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রশাসনের ভেতরে যাঁরা অভিষেকের খাতিরের লোক, তাঁদের গুরুত্ব নবান্ন ইতিমধ্যেই কমিয়ে দেওয়া শুরু করেছে বলে খবর।
মমতার সঙ্গে কি দেনদরবার করার মতো পরিস্থিতিতেও নেই অভিষেক?
এই পরিস্থিতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে বেশি চিন্তিত তাঁর অনুগামীরা। এমনিতেই ২৪ নভেম্বরের পর থেকেই তৃণমূলে অভিষেকপন্থীদের তমতমি পড়তির দিকে। অভিষেকের দিকে ঝুঁকে থাকা এমন কেউ কেউ হাওয়া বুঝে পুরোপুরি দিদিপন্থী হয়ে গেছেন। যাঁরা ‘ফেন্স সিটার’ ছিলেন, তাঁরাও সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেছেন। কুণাল ঘোষ, পার্থ ভৌমিক ও তাপস রায়ের মতো নেতা, যাঁদের সঙ্গে ববি-অরূপ-কল্যাণদের দূরত্ব ঘোচার নয়, তাঁরা এখনও আশায় আছেন অভিষেক আবার ফোঁস করবেন। শনিবার তাঁর কালীঘাটের অফিসে কুণাল ঘোষ, পার্থ ভৌমিক, নারায়ণ গোস্বামী, ব্রাত্য বসু ও তাপস রায়ের সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠকে বসেছিলেন বলে খবর মিলেছে। বৈঠকে কুণালরা অভিষেককে দলে ফের সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিলেও অভিষেক তাতে উৎসাহ দেখান নি। লোকসভা নির্বাচনের আগে অভিষেক তৎপর না হলে দলের ভেতরে তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হবে, এই আশঙ্কাই করছেন কুণাল-পার্থ-তাপসের মতো নেতারা।
অনুগামীদের হতাশ করে দিয়ে অভিষেক নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, লোকসভা নির্বাচনে নিজের কেন্দ্র ডায়মন্ডহারবার ছাড়া আর কোনও কেন্দ্র নিয়েই মাথা ঘামাবেন না তিনি। কুণালরা যদিও চান, বাকি ৪১ কেন্দ্রের প্রার্থী তালিকা নিয়েও নিজের বক্তব্য জোরালোভাবে জানান দেন অভিষেক। কিন্তু দলের বিষয়আসয় নিয়ে পিসির সঙ্গে দেনদরবার করার মতো পরিস্থিতিতে কেন তিনি নেই, বৈঠকে অনুগামীদের অভিষেক তা খুলে জানিয়েছেন বলে গুঞ্জন।
Feature image is representational.