কলকাতা: রাজনীতির হেভিওয়েটদের মেগা শোয়ের জন্য বিখ্যাত ব্রিগেডে এর আগে ধর্মের রঙ লেগেছিল মাত্র একবারই। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফরে এসে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভক্তদের দর্শন দিয়েছিলেন পোপ জন পল টু। পোপের সেই অনুষ্ঠানে জেল্লার কমতি না থাকলেও মাঠ সে’ভাবে ভরে নি। গীতা জয়ন্তীতে ব্রিগেডে লক্ষ কন্ঠে গীতাপাঠের অনুষ্ঠান ঘিরে বাংলার হিন্দুত্ববাদী শিবিরে সাজ সাজ রব লক্ষ্য করা যাচ্ছিল প্রস্তুতিপর্ব থেকেই। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন জানার পর লক্ষ কন্ঠে গীতাপাঠ নিয়ে উন্মাদনা-উদ্দীপনা সঙ্গত কারণেই আরও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মোদী সফর বাতিল করায় অনুষ্ঠান কতটা জমবে, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল নানা মহলে। আয়োজকরাও কিছুটা দমে গিয়েছিলেন যেনো। তবে শেষ পর্যন্ত রবিবারের দুপুরে ব্রিগেডে যে জমায়েত হল, তাতে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা তিন সংগঠন সনাতন সংস্কৃতি সংসদ, মতিলাল ভারততীর্থ সেবা মিশন আশ্রম ও অখিল ভারতীয় সংস্কৃত পরিষদের নেতারা রীতিমতো আপ্লুত।
আয়োজকদের তরফে বলা হয়েছিল, ব্রিগেডে লক্ষ কন্ঠের গীতাপাঠ ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’-এ নাম তুলবে। কাজেই জনসমাগম নিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের একটা টেনশন ছিলই। সকাল দশটা নাগাদ অনুষ্ঠান শুরু হয়। বেলা বারোটা গড়ানোর আগেই জমায়েতের বহর নিয়ে উৎকণ্ঠা কেটে যায়। ভক্তিগীতি দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা। সংকীর্তন, বেদপাঠ শেষে কাজি নজরুল ইসলামের ‘পার্থসারথি’ কবিতাটি হাজার হাজার কন্ঠে বৃন্দগান হিসেবে পরিবেশিত হয়। শোভাযাত্রা সহযোগে মঞ্চে পদার্পণ করেন দ্বারকা মঠের শঙ্করাচার্য শ্রীমৎ সদানন্দ সরস্বতী। অনুষ্ঠানে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের দ্বৈতাপতিও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে শ্রীমদ্ভগবদগীতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ভাষণ দেন শঙ্করাচার্য। বিভিন্ন মঠ ও মিশনের সাধু-সন্তু-মোহন্তদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে সহস্র শঙ্খধ্বনি সহযোগে গীতার পাঁচটি অধ্যায় থেকে পাঠ হয়েছে। এ’দিন ব্রিগেডে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষ গীতাপাঠ করেছেন বলে আয়োজকদের তরফে জানানো হয়েছে।
অনুষ্ঠানে না আসতে পারলেও লক্ষ কন্ঠে গীতাপাঠের সাফল্য কামনা করে আয়োজকদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পড়ে শোনানো হয়। বিশেষ বার্তায় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, “এক লক্ষ মানুষের গীতাপাঠের কর্মসূচি সত্যিই প্রশংসনীয়। মহাভারতের কাল থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বর্তমান সময়েও গীতা সবার অনুপ্রেরণা। পরম্পরা, জ্ঞান ও দার্শনিক-আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার মেলবন্ধনই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র ও সম্প্রীতি আমাদের শক্তি।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি নিশ্চিত, একসঙ্গে এত মানুষের গীতাপাঠ আমাদের সামাজিক সম্প্রীতিকে আরও মজবুত করার পাশাপাশি, দেশের উন্নয়ন-যাত্রাকেও শক্তি জোগাবে।”
অনুষ্ঠানে দ্বারকা মঠের শঙ্করাচার্য সদানন্দ সরস্বতী বলেন, “বাংলা তপস্বী, সাধক ও মহাত্মাদের শ্রেষ্ঠ স্থান। বড় বড় অবতার এখানে জন্ম নিয়েছেন, তপস্যা করেছেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসের মতোন অবতার এখানে জন্ম নিয়েছেন। যিনি নিজের অলৌকিক শক্তি দ্বারা দেশ ও দশকে দিশা দেখিয়েছেন।” শঙ্করাচার্য আরও বলেন, “আসল ভারতীয় কে? নকল ভারতীয়ই বা কে? এই ভেজালই আমাদের দুর্বলতা। ভারতীয়ত্বে কোনও ভেজাল থাকা উচিত নয়। যে ভারতীয় সংস্কৃতি দেশজুড়ে ব্যাপ্ত, তার নাম সনাতনী হিন্দু সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি দেশের সবাইকে আদর দিয়েছে, সবাইকে আপন করে নিয়েছে।” কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে রথে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে উপদেশ দান করেছিলেন, তাই গীতা। রথে ছিলেন অর্জুন। রথের সারথি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সদানন্দ সরস্বতী বলেন, “আমাদের দেহও একটা রথ। এই রথের সারথি স্বয়ং ভগবান। সারথি নারায়ণের নির্দেশ মতো দেহ ও মনকে পরিচালনা করলে কখনও আমাদের পতন হবে না। এই শরীর রথ, পরমাত্মা তার রথী- এটাই হল গীতার সার।”
লক্ষ কন্ঠে গীতাপাঠের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ দলমত ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অনেকেকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সহ রাজ্যে বিজেপির প্রায় সব নেতানেত্রীই গীতাপাঠের ব্রিগেডে হাজির থাকলেও তৃণমূল সহ অন্যান্য দলের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। জমায়াতের বড় অংশই যে বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের থেকে আসা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে অনুষ্ঠানকে রাজনীতির ছোঁয়াচ মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন আয়োজকেরা। তাই মঞ্চে নয় বিজেপি নেতাদের আসন হয়েছিল মাঠে। গীতাপাঠের অনুষ্ঠান পন্ড করতেই নবান্ন টেট পরীক্ষার দিন পাল্টে ২৪ ডিসেম্বর করেছে বলে আয়োজকদের পাশাপাশি রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারাও অভিযোগ করেছিলেন। লক্ষ কন্ঠে গীতাপাঠের অনুষ্ঠান সফল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত উজ্জীবিত রাজ্যের গেরুয়া শিবিরই।
Feature image- NNDC.