কলকাতা: ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে এনে সভা করিয়ে ছাড়ল রাজ্য বিজেপি। বুধবারের সভা নামে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বঞ্চিতদের জন্য হলেও আসলে এই সভা থেকেই লোকসভা ভোটের দামামা বাজিয়ে দেওয়া হল। সভার সুর যে আক্রমণাত্মক হবে, তা আগেই টের পেয়েছিল রাজনৈতিক মহল। ধর্মতলায় সভার আয়োজনে পুলিশের বাধা ও হাইকোর্টের নির্দেশে ছাড়পত্র পাওয়া- এই দুই ঘটনা যে রাজ্য বিজেপির নেতাদের মেজাজকে আরও চড়িয়ে দিয়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সরকারের দিক থেকে বাধা এবং আদালতের মাধ্যমে জয় যে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিকেই বাড়তি মাইলেজ দিয়ে থাকে। ধর্মতলায় বিজেপির বুধবারের হাইভোল্টেজ সভা কতটা ভরে এবং অমিত শাহ সভায় কী বলেন, সেই দিকেই তাকিয়ে ছিলেন সবাই।
সভার ভিড় শাহকে হতাশ করে নি। ফিরে যাওয়ার সময় তিনি নিশ্চয়ই সুকান্ত মজুমদার- শুভেন্দু অধিকারীদের বাধাই দিয়েছেন। ধর্মতলায় সভা মানেই প্রেস্টিজ ইস্যু। তার উপর আবার সরকারের সঙ্গে লড়াই করে আদালত থেকে ছিনিয়ে আনা। সভা শুরুর আগে থেকেই তৃণমূল শিবির থেকে কটাক্ষ ধেয়ে আসছিল, বিজেপি সভার অনুমতি তো পেল কিন্তু ধর্মতলা চত্বর ভরাতে পারলে হয়। শেষ পর্যন্ত অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে এ’দিন ধর্মতলায় যে জমায়েতটা রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব টানতে পারলেন, তা চোখে পড়ার মতোই। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে দলকে ভাল সংখ্যায় আসন জিততে হবে- বাংলার কার্যকর্তাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছেন শাহ। বুধবারের সভার মেজাজ অমিত শাহ দিল্লিতে বসেই টের পেয়েছিলেন। মাত্র চার মাস পরেই লোকসভা ভোট। বাংলার নেতাকর্মীদের ‘চার্জড’ করিয়ে দিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি সেরেই যে তাঁকে দিল্লিতে ফিরতে হবে, ঝানু শাহ তা বিলক্ষণ জানতেন।
সভায় শাহের মুখে শুভেন্দুর নাম
ধর্মতলায় সভার ভিড় যেমন শাহকে নিরাশ করে নি তেমনি সভায় শাহের বক্তৃতাও বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের হতাশ করে নি। ২৩ মিনিটের ভাষণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে ছাড় দিয়ে কথা বলেন নি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সভায় অমিত শাহ বলেন, “বাংলার মানুষ ২ কোটি ৩০ লাখ ভোট ভারতীয় জনতা পার্টিকে দিয়েছে। ৭৭টি সিট দিয়েছে। আমাদের নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে এখনও পর্যন্ত দিদি দুই বার বিধানসভা থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন। আমি দিদিকে বলতে চাই, দিদি আপনি কান খুলে শুনুন, শুভেন্দুকে আপনি বিধানসভা থেকে বের করে দিতে তো পারবেন কিন্তু বাংলার জনগণকে চুপ করিয়ে দিতে পারবেন না। বাংলার জনতা বলছে, দিদি আপনার সময় শেষ হয়ে গেছে।” ধর্মতলার বড় সভায় শাহের মুখে শুভেন্দুর নাম তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
ইউপিএ জামানার থেকে মোদী জামানায় বাংলার প্রাপ্তি বেশি
মমতা-অভিষেক ও তৃণমূলের অভিযোগ, দিল্লির বিজেপি সরকার একশ দিনের কাজ ও আবাস যোজনার টাকা আটকে রাখায় বাংলার গরীব মানুষেরা ভুগছেন। তৃণমূলের এই অভিযোগের জবাব দিতেই ধর্মতলায় সভার আয়োজন করেছিল রাজ্য বিজেপি। বিজেপির পাল্টা অভিযোগ, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা তৃণমূলের নেতারা নয়ছয় করাতেই বাংলার গরীবেরা একশ দিনের কাজ ও আবাস যোজনার মতো প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সভায় তৃণমূলের অভিযোগ খন্ডন করেন অমিত শাহও। শাহ বলেন, “মোদীজি লক্ষ কোটি টাকা বাংলায় পাঠিয়েছেন। কিন্তু তৃণমূলের সিন্ডিকেটওয়ালারা সেই টাকা বাংলার গরীব পর্যন্ত পৌঁছাতে দিচ্ছেন না।” পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মুখে অভিযোগ লেগেই থাকে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রাপ্য পাওনা থেকে বাংলাকে বঞ্চিত করে রেখেছে। এ’দিন ধর্মতলার মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতার এই অভিযোগও খন্ডন করেন অমিত শাহ। হিসেব পেশ করে শাহ দেখান, প্রতিটি খাতে ইউপিএ জামানার থেকে অনেক বেশি অর্থ বাংলার জন্য বরাদ্দ করেছে মোদী সরকার।
ভাতিজার নাম যেন না নেয়, মমতা দুর্গানাম জপছেন
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সভায় বলেন, “তৃণমূলের জামানায় কাটমানি আর সিন্ডিকেটের জ্বালায় বাংলার মানুষ নাজেহাল। এই বাংলায় আগে সকালে রবীন্দ্র সংগীত শোনা যেত। এখন বোমের আওয়াজে লোকের ঘুম ভাঙে। গোটা দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু বাংলায় দারিদ্র হ্রাসের লক্ষণ নেই।” তৃণমূলের শাসনকে কটাক্ষ করে অমিত শাহ বলেন, “বাংলায় ভ্রষ্টাচার চরম সীমায় পৌঁছেছে। আমি গুজরাটের লোক। কিন্তু আমার জীবনে কোনও নেতার বাড়ি থেকে এত এত নোটের বান্ডিল বের হতে দেখি নি।” শাহের আক্ষেপ, “যে বাংলা একদিন শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান- সবদিক দিয়েই দেশকে নেতৃত্ব দিতো, সেই বাংলাকে দিদি বরবাদ করে দিয়েছেন।” রাজনৈতিক হিংসা, নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা ও দুর্নীতির কারণে গোটা ভারতে আজ বাংলার বদনাম হয়ে গেছে বলে সভায় অভিযোগ করেন অমিত শাহ। শাহ বলেন, “জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অনুব্রত মণ্ডল, পার্থ চট্টোপাধ্যায়- এরা কেউ গরু চুরি, কেউ কয়লা চুরি, কেউ খাদ্য চুরি, কেউ বা চাকরি চুরির মাধ্যমে জনগণের টাকা মেরে খেয়েছে।” শাহ আরও বলেন, “মমতাজিকে আজ আমি বলতে চাই, যদি আপনার সাহস থাকে তবে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অনুব্রত মণ্ডল ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করে দেখান।” এরপরেই শাহের কটাক্ষ, “উনি (মমতা) দুর্গানাম জপছেন, যাতে এরা ভাতিজার নাম না বলে দেয়।”
সিএএ দেশের আইন, লাগু করেই ছাড়ব
নাম না করে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের ঘটনার কথা উল্লেখ করে বুধবার অমিত শাহ বলেন, “তৃণমূল এত দুর্নীতি করেছে যে সংসদের পবিত্রতাকে পর্যন্ত নষ্ট করে দিয়েছে। যে দলের সাংসদ ভেট নিয়ে সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করেন, সেই দল কখনও বাংলার ভাল করতে পারে?” ধর্মতলার সভায় অনুপ্রবেশ ও ‘সিএএ’ নিয়েও মুখ খোলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, “অসমে ভাজপা সরকারে থাকায় সীমান্ত দিয়ে একটা পাখিও ঢুকতে পারে না। আর বাংলায় তৃণমূল নেতা প্রকাশ্য সভায় বলেন, যারা অনুপ্রবেশকারী, তাদের আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড যদি দরকার হয়, তবে এই নম্বরে যোগাযোগ করুন। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরেও পুলিশ চুপ!” শাহের প্রশ্ন- “যে রাজ্যে এইভাবে অনুপ্রবেশ হয়, সেই রাজ্যে কখনও বিকাশ হতে পারে?” সিএএ নিয়ে অমিত শাহ বলেন, “অবাধে অনুপ্রবেশ চলতে দিতেই মমতা ব্যানার্জি সিএএ-র বিরোধিতা করছেন। কিন্তু আজকে আমি এই সভায় বলতে চাই, মমতা দিদি, সিএএ দেশের আইন। একে কেউই আটকাতে পারবে না। আমরা সিএএ-কে লাগু করেই ছাড়ব।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শরণার্থীদের আশ্বস্ত করে বলেন, “ওই পার থেকে আসা হিন্দু ভাইবোনদের এই দেশে ততটাই অধিকার, যতটা অধিকার আমার-আপনার আছে। তাদের এই অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না।”
Feature graphic- NNDC.