জলপাইগুড়ি: দুর্গাপূজা একদা ছিল রাজা-মহারাজা, জমিদারদের পূজা। রাজাদের রাজত্ব কবেই শেষ হয়েছে। জমিদারেরাও স্থান পেয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। রাজা-জমিদারেরা না থাকলেও তাঁদের পূজা এখনও চলছে বহু জায়গায়। রাজাদের পূজা মানেই রাজসিক সব ব্যাপার। কত রকমের নিয়ম-কানুন। এবং পূজা ঘিরে কতই না রহস্য আর লোকশ্রুতি। রাজাদের পূজা ঘিরে তাই আজও মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। আসছি জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের দুর্গাপূজার কথায়, যা বাংলার প্রাচীন দুর্গাপূজাগুলির মধ্যে অন্যতম। জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজা এবার ৫১৪ বছরে পড়ল। নানা তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শিষ্য সিংহ এই পুজোর প্রচলন করেন। শিষ্য সিংহের জেষ্ঠ্যভ্রাতা বিশ্ব সিংহ (যাঁকে কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে) ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে কোচবিহার রাজবাড়ির বড়দেবীর (কোচবিহার রাজবাড়ির দেবী দুর্গাকে এই নামেই ডাকা হয়) পূজার প্রচলন করেন বলে জানা যায়। এই হিসেব অনুযায়ী বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের দুর্গাপূজার বয়স কোচবিহার রাজবাড়ির বড়দেবীর পূজার থেকেও এক বছর বেশি।
রাজাদের দুর্গাপূজা মানেই তো রহস্যে মোড়া। কোচবিহার রাজাদের বড়দেবীর পূজা থেকে বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের পূজায় রহস্য কিছু কম নেই। পূজার সূত্রপাত থেকেই নরবলি ছিল। এই প্রথা নাকি পরবর্তী একশ বছর যাবৎ চালু ছিল! নিখুঁত এবং সর্ব সুলক্ষণযুক্ত দেহের অধিকারী অনূর্ধ্ব দ্বাদশ বর্ষীয় ব্রাহ্মণ বালককে দেবী মূর্তির সামনে বলি দেওয়া হত সপ্তমীর গভীর নিশীথে সংগোপনে। বলিকৃত বালকের কলিজা ( হৃদপিন্ড ) দেবীর উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হত। চারশ বছর আগে এই নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ হয়ে গেলেও নরবলির কথা পরিবারের বড়দের মুখে শুনেছেন রাজবাড়ির সকল সদস্যই। এখনও হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্সে পূজা এলেই লোকের মুখে মুখে ফেরে বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়িতে নরবলির গল্প। সপ্তমী তিথিতে রাত বারোটার পর অনুষ্ঠিত অর্ধরাত্রি পূজায় প্রতীকি নরবলি কিন্তু আজও হয় রাজবাড়িতে। চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো মনুষ্য আকৃতির পুতুল বলি দেওয়া হয়।
রাজা নেই তো কী হয়েছে, রাজার পূজার রীতিনীতি কিছুমাত্র পাল্টায় নি। আগে যেমন ছিল তেমনটিই আছে এখনও। বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়িতে মায়ের পূজা হয় কালিকা পুরাণ মতে। তাই পূজায় বলি সিদ্ধ। সপ্তমীর অর্ধরাত্রি পূজায় আটটি পায়রা বলি দেওয়া হয়। জলপাইগুড়ি জেলার রাজবংশী সমাজের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৈকুণ্ঠপুরের দুর্গা পূজা। নবমীতে যজ্ঞের আগে মনোস্কামনা পূরণে পূজা প্রাঙ্গণে পাঁঠা , হাঁস , চালকুমড়ো এবং আখ বলি দেন স্থানীয়রা।
বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের দুর্গা প্রতিমার পৃথক কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। মহামায়া এখানে তপ্ত কাঞ্চন বর্ণা। এবং তিনি সর্বাঙ্গে সালংকারা। দেবীর মস্তকে স্বর্ণ মুকুট এবং গন্ডদেশে শোভা পায় নবরত্ন হার। দেবীর দশ হস্ত ও কর্ণকুন্তলে বিরাজ করে সোনা-রূপার গহনা। দেবী পরিধান করেন লাল বেনারসি শাড়ি। প্রতিমার উচ্চতা ১৫ ফিট। একচালা একটি রথের উপর দেবী উপবেশন করেন। সিংহবাহিনী দেবীর সঙ্গে থাকে ব্যাঘ্রও। সিংহের গাত্রবর্ণ শুভ্র। অসুর দলনী দেবী দুর্গার দুই পাশে তাঁর চার পুত্রকন্যা কার্তিক-গণেশ, লক্ষ্মী-সরস্বতী তো থাকেনই বিগ্রহ রূপে চালায় বিরাজ করেন মহামায়া, দেবী চন্ডী, দেবাদিদেব মহেশ্বর, ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুও। এমনকি মায়ের পাশে স্থান পেয়েছেন কৈলাশে ভোলানাথের চ্যালা নন্দীর স্ত্রী জয়া এবং তাঁর সখী বিজয়াও। বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির নাটমন্দিরে পূজা হয়। স্থায়ী কাঠামোর উপর প্রতিমা নির্মাণের কাজও চলে সেখানেই। মহালয়ার সকালেই তর্পণান্তে রাজ পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মায়ের চক্ষুদান সেরে ফেলেছেন রাজবাড়ির মৃৎশিল্পী। কার্যত মহালয়া থেকেই বৈকুন্ঠপুর রাজ পরিবারের দুর্গাপূজা শুরু হয়ে গেছে। মহালয়ার অমাবস্যায় কালীপুজো এখানে দুর্গাপূজারই অঙ্গ ।
বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ির পূজায় নবপত্রিকার স্নানের জল আসে হরিদ্বারের গঙ্গা, মথুরা ও বৃন্দাবনের যমুনা নদী এবং কৈলাশ মানস সরোবর থেকে। ষষ্ঠীর বোধন থেকে দশমীতে নিরঞ্জন– ঐতিহ্য , পরম্পরা ও নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম নেই রাজবাড়ির পুজায়। পূজার ভোগে আমিষের প্রাধান্য। সপ্তমী, মহাষ্টমী এবং নবমী– তিনদিনই দেবীর ভোগে থাকে রুই-কাতলা, ইলিশ, বোয়াল এবং চিতল মাছ। থাকে পাঁঠার মাংসও।
এক সময় বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির পূজা মানেই ছিল বিরাট উৎসব। এস্টেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ আসতেন পূজা দেখতে। রাজবাড়ি চত্বর জুড়ে শত শত তাঁবু পড়ত। পুজো উপলক্ষে বিশাল মেলা বসত। সময়ের গ্রাসে অতীত দিনের জৌলুস অনেকটাই ফিকে। তারপরেও পূজা উপলক্ষে রাজবাড়ি সংলগ্ন রাস্তার দু’পাশে আজও মেলা বসে।
রাজবাড়ির দশমী ও সিঁদুর খেলা আজও জলপাইগুড়ির দুর্গা পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। দশমীর পূজা সমাপান্তে সধবারা দেবী বরণ ও সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। রাজ পরিবারের সদস্যরা তো বটেই দলে দলে সাধারণ মানুষও এতে অংশগ্রহণ করে। বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়িতে দেবী নিত্য পূজিতা। দেবী দুর্গার দশমী বিহিত পুজা সমাপান্তে মৃৎ প্রতিমার নিরঞ্জন হয় মাত্র। ঢাক-ঢোল-কাশি-বাঁশির প্রবল বাদ্যের মধ্যে রথে আসীন দেবী প্রতিমা টানতে টানতে রাজবাড়ির দিঘির ঘাটে নিয়ে যান ভক্তরা। এই দৃশ্য দেখতে রাজবাড়ি চত্বরে উপস্থিত হন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিমা নিরঞ্জনের সাথে সাথেই কাঠামো জল থেকে তুলে ফেলাই নিয়ম। এই কাঠামোর উপরেই নির্মিত হবে পরের বছরের দেবী প্রতিমা। রাজবাড়ির দুর্গাপুজার পুরো দায়িত্ব কুল পুরোহিত শিবু ঘোষালের কাঁধে। শিববাবুর পিতৃপুরুষেরাও একই কাজ করে এসেছেন। রাজ পরিবারের তরফে পূজার মূল দায়িত্ব সামলান প্রণত বসু।
Feature image- NNDT.