বিশেষ প্রতিবেদন: সালিশি আদালতের রায় জানার পর থেকেই চোখে সর্ষেফুল দেখছে নবান্ন। সিঙ্গুরে ‘ন্যানো’ প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ায় ‘টাটা মোটরস’-কে ৭৬৫.৭৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে ‘পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম’-এর প্রতি নির্দেশ দিয়েছে সালিশি আদালত (আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল)। সালিশি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার চাইলে হাইকোর্ট কিম্বা সুপ্রিম কোর্টে যেতেই পারে কিন্তু গেলেই যে সালিশি আদালতের রায় উল্টে যাবে, এমন গ্যারান্টি রাজ্যকে দিতে পারছেন না আইন বিশেষজ্ঞরা।
সালিশি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ বা শীর্ষ আদালতে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরও একটি আইনি জটিলতা রাজ্যকে ভাবাচ্ছে। আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনালের নির্দেশের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করতে গেলে রাজ্য সরকারকে ‘টাটা মোটরস’-কে প্রদেয় ক্ষতিপূরণের অর্ধেক অর্থ আদালতের কাছে জমা রাখতে হবে। ৭৬৫.৭৮ কোটির অর্ধেকও বড় কম অঙ্ক নয়। এই মুহূর্তে আবগারি ছাড়া রাজ্যের কোষাগারে আয়ের কোনও বড় উৎস নেই। দেউলিয়া হতে চলা সরকার কীভাবে সালিশি আদালতের রায়ের ধাক্কা সামাল দিবে, এই চিন্তায় রাজ্যের মুখ্যসচিব, অর্থসচিব রীতিমতো মুষড়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে।
সোমবার সালিশি আদালতের রায়ের খবর আসার পর থেকেই ফিকে হয়ে যাওয়া ‘সিঙ্গুর পর্ব’ রাজ্য রাজনীতিতে ফের জাঁকিয়ে বসেছে। সে’দিন সন্ধ্যায় ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে টাটা গোষ্ঠীর তরফ থেকে একটি বিবৃতি জারি করে জানানো হয়, “২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর তিন সদস্যের আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনালে সিঙ্গুর অটোমোবাইল কারখানা মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। ট্রাইবুনাল সর্বসম্মতভাবে টাটা মোটরসকে ৭৬৫.৭৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম’-কে নির্দেশ দিয়েছে। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো ক্ষতিপূরণ পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ১১ শতাংশ হারে সুদ দিতেও বলেছে ট্রাইব্যুনাল।”
সালিশি আদালতের রায়ের কথা কানে যেতেই বেদিশা হয়ে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করার নির্দেশ দেন তিনি। এই ধরণের মামলায় হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের পর সালিশি আদালতের রায় পাল্টে গেছে, এমন উদাহরণ মুখ্যসচিবকে খুব বেশি দেখাতে পারেন নি আইন বিশেষজ্ঞরা। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছে আপিল আদালত। হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে সালিশি আদালতের রায় বাতিলের সম্ভাবনা ক্ষীণ, এমনটাই মনে করছেন রাজ্যের আইনজীবী মহলের বড় অংশ।
২০০৬ সালে হুগলির সিঙ্গুরে ন্যানো গাড়ির কারখানা গড়ে তুলতে টাটা মোটরসের হাতে ১ হাজার একর জমি তুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজ্য সরকারের হয়ে কৃষকদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম (WBIDC)। পরে শিল্পোন্নয়ন নিগমের কাছ থেকে ওই জমি কিনে নেয় টাটা মোটরস। জোর করে কৃষকদের কাছ থেকে তিন ফসলি-চার ফসলি জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এই অভিযোগে সিঙ্গুরে ‘জমি বাঁচাও আন্দোলন’ গড়ে ওঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। আন্দোলনের চাপে ২০০৮-এর অক্টোবরে সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্প থেকে সরে আসে টাটা গোষ্ঠী। ততদিনে অধিগৃহীত জমিতে কারখানা স্থাপনের কাজ অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল।
২০১১-য় বাংলায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পেছনে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষিজমি বাঁচাও আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ক্ষমতায় এসেই টাটা গোষ্ঠীর কাছে সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের জমি ফেরত চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জমি ফেরতের শর্ত হিসেবে জমির দাম ও প্রকল্পে বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত চায় টাটারা। পত্রপাঠ টাটা মোটরসের দাবি খারিজ করে দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। টাটা গোষ্ঠীকে দাম বুঝিয়ে না দিয়েই ন্যানো প্রকল্পে অধিগৃহীত জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দেন মমতা। দাম ও ক্ষতিপূরণ না পেয়ে ‘আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনালে’ মামলা করে টাটা গোষ্ঠী। এতদিনে রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই রাজ্যের।
২০০৬-এ রাজ্য সরকার সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমি টাটা মোটরসের কাছে বেচে দেওয়ার পর টাটারাই জমির বৈধ মালিক। ২০১১-র পরে টাটাদের দাম না ফিরিয়েই ন্যানো প্রকল্পের জমি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। জমি কৃষকদের ফিরিয়েও দিয়েছে সরকার। যদিও জমিকে আর চাষের যোগ্য করে তোলা যায় নি। সময় প্রমাণ করে দিয়েছে, সিঙ্গুর আন্দোলন মমতার ক্ষমতায় আসার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া তা থেকে আর কোনও ফল পাওয়া যায় নি। শিল্প না হওয়ায় সিঙ্গুরের কৃষকেরা এখন হাত কামড়ান। ফিরে পাওয়া জমিতে না করা যাচ্ছে আবাদ না আছে অন্য কোনও কাজ। সিঙ্গুর থেকে সরে গিয়ে গুজরাটের সানন্দে প্রকল্প গড়ে তোলে টাটা মোটরস। জমি আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন সিঙ্গুরের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর থেকে বহু আগেই আস্থা উঠে গেছে মাস্টারমশাইয়ের। তৃণমূল শাসনে বীতশ্রদ্ধ রবীন্দ্রনাথবাবুর এতদিনে উপলব্ধি হয়েছে, টাটা বিদায়ে শুধু সিঙ্গুর নয় গোটা বাংলার সর্বনাশ হয়েছে!
Feature graphic is representational.