শত্রু-মিত্র উভয়ের কাছেই কাও এবং ‘র’ সমার্থক হয়ে উঠেছিল। প্রতিষ্ঠান ও কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে লিখলেন উত্তম দেব-
একজন ভাল টিম লিডার ছাড়া একটা ভাল টিম তৈরি হয় না। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন- ‘ইসরো’র উত্থানের পেছনে আছে এপিজে আবদুল কালাম, ইউআর রাও সহ এক ঝাঁক তরুণ বিজ্ঞানীর নিরলস শ্রম ও সাধনা। এই বিজ্ঞানীরা অভিভাবক হিসেবে পেয়েছিলেন সতীশ ধাওয়ানের মতো একজন অসামান্য ‘লিডার’কে। ‘টিম লিডার’ ধাওয়ানকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন কালাম তাঁর ‘ফায়ার অব উইংস’ গ্রন্থে। ইসরোর জনক ড.বিক্রম অম্বালাল সারাভাই তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করিয়ে যাওয়ার সময় পান নি। আমাদের গর্বের ইসরো আজ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে, তার ভিতটি গড়ে দিয়েছেন কিন্তু চেয়ারম্যান সতীশ ধাওয়ান। যাঁকে নিয়ে প্রসঙ্গ তাঁর কর্মজগত অবশ্য মহাকাশে নয় ছিল একেবারেই মাটিতে এবং নিভৃতে। কিন্তু তিনিও টিম লিডার এবং সংগঠক হিসেবে ছিলেন অতুলনীয়। ১৯৬৮ সালের আগে ‘ফরেন ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক’ বলে কার্যত কিছুই ছিল না ভারতের। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র তিন বছরের মধ্যে দেশকে একটি দক্ষ, চতুর ও কার্যকর ‘ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ যিনি উপহার দিয়েছেন, তাঁর নাম পন্ডিত রামেশ্বরনাথ কাও। আরএন কাও নামেই জনজীবনে অধিক পরিচিত ছিলেন নিভৃতচারী এই গোয়েন্দা শিরোমণি।
‘র’ যেভাবে মূর্ত হল
১৯৬৭ পর্যন্ত ভিন দেশের মাটিতে নজরদারি চালানোর জন্য ভারত সরকারের হাতে পৃথক কোনও সংগঠন ছিল না। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা ‘আইবি’-র লোকেরাই গোয়েন্দাগিরির গতানুগতিক পদ্ধতিতে কাজটি সারতেন। এই সময়ের মধ্যে দুটো যুদ্ধ দেশের উপর দিয়ে গেছে। বাষট্টিতে উত্তর সীমান্তে চিনের সামরিক আগ্রাসনের মুখে ভারতের অপ্রস্তুত অবস্থার জন্য ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের ব্যর্থতাকে একটা অন্যতম কারণ বলে ধরা হয়। পঁয়ষট্টির ভারত-পাক যুদ্ধের সময় পৃথক একটা চৌকশ গোয়েন্দা বাহিনীর অভাব প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করেছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল জেএন চৌধুরী। আইবির থেকে নিয়ে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করার আর্জি জানিয়ে তদানীন্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়াই বি চ্যবনের কাছে ‘কনফিডেন্সিয়াল নোট’ পাঠিয়েছিলেন জেনারেল চৌধুরী। চ্যবন বিষয়টিতে সম্মত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। ভারতে ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি গঠনের কাজে সুতা পাকানোর সেই শুরু।
১৯৬৬-র ১০ জানুয়ারি উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তানের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর। ১১ জানুয়ারি রাতে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যজনক আকস্মিক মৃত্যু। ১৩ দিনের মাথায় অপ্রত্যাশিতভাবেই দেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর অভিষেক। দলের ভেতরে ইন্দিরা যাঁদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করতেন মারাঠা ‘স্ট্রংম্যান’ ওয়াই বি চ্যবন তাঁদের অন্যতম। ইন্দিরা চ্যবনকে প্রতিরক্ষা থেকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্রে আনেন। ইন্টেলিজেন্স উইংসের সবক’টির দায়িত্বই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলাক, ইন্দিরা তা চান নি। সিবিআই-কে স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে সরিয়ে পিএমও-র অধীনে নিয়ে আসেন তিনি। বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলিতে গোয়েন্দা আধিকারিকদের পোস্টিংয়ের দায়িত্বও স্বরাষ্ট্র দফতরের হাত থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধীর এইসব পদক্ষেপের পেছনে নিঃসন্দেহে অন্য অঙ্ক ছিল কিন্তু নেহেরুকন্যার অভিপ্রায় যাই থাকুক, আজকে Research and Analysis Wing বা RAW নামে যে সংস্থাটিকে নিয়ে দেশে-বিদেশে এত চর্চা, সেই এজেন্সি ইন্দিরারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ‘র’-কে ইন্দিরা গান্ধীর মানসপুত্র (ব্রেন চাইল্ড) বললে অত্যুক্তি হয় না। ইন্দিরার সৌভাগ্য, তিনি সবথেকে দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী ও স্থিরমতি একজনের হাতে নতুন এজেন্সিকে গড়েপিটে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কোনও কোনও সময় ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। শত্রু-মিত্র উভয়ের কাছেই কাও এবং ‘র’ অভিন্ন হয়ে উঠেছিলেন। নিজের কর্মগুণেই এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন কাশ্মীরি এই ব্রাহ্মণ।
কর্মদক্ষ, দক্ষ সংগঠক অথচ ‘লো প্রোফাইল’
১৯১৮ সালের ১০ মে বারাণসীতে পন্ডিত রামেশ্বরনাথ কাওয়ের জন্ম। কাওয়ের পূর্বপুরুষেরা কাশ্মীর উপত্যকার শ্রীনগর ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। লখনউ শহরের কাশ্মীরি মহল্লায় কাও পরিবার নতুন বসতি গড়ে তুলেছিল। মাত্র ছয় বছর বয়সে পিতাকে হারান রামেশ্বরনাথ। কাকা পন্ডিত ত্রিলোকিনাথ পন্ডিতের অভিভাবকত্বে বড় হয়ে উঠেছিলেন কাও। ম্যাট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েট বরোদায়। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন আরএন কাও। শৈশব থেকেই মেধাবী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। ইংরেজি-হিন্দি ছাড়াও ফার্সি, উর্দু ও সংস্কৃতে চোস্ত ছিলেন রামেশ্বরনাথ। আইন নিয়ে পড়তে পড়তেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৪০-এ ইম্পেরিয়াল পুলিশ সার্ভিসে যোগদান। কর্মজীবনের প্রথম পোস্টিং কানপুরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে। পুলিশের চাকরিতে যোগদানের কয়েক বছরের মধ্যেই গোয়েন্দা বিভাগ নিয়ে উৎসুক হয়ে ওঠেন রামেশ্বরনাথ। তাঁর সমস্ত আগ্রহ গিয়ে পড়ে গোয়েন্দাগিরিতে। ১৯৪৭-এর জুনে ডেপুটেশন নিয়ে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে চলে যান পিএন কাও। স্বাধীনতার পরে প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পান। দীর্ঘ কর্মজীবনে আর কখনও কাওয়ের গায়ে উর্দি ওঠে নি।
সাতষট্টিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন আরএন কাওকে ডেকে নতুন একটি এক্সটারনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির জন্য প্রকল্পপত্র তৈরি করে জমা দিতে বললেন, তখন কাও ‘আইবি’-র যুগ্ম অধিকর্তা পদে কর্মরত। আরও অনেক গোয়েন্দা আধিকারিক থাকতে কাওকেই কেন নির্ভরযোগ্য মনে করেছিলেন ইন্দিরা? কাওয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহকর্মী কে শঙ্করণ নায়ার তাঁর লেখা বইয়ে বিষয়টির উল্লেখ করেছেন। জওহরলালের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আধিকারিক থাকার সুবাদে কাও ছিলেন নেহেরু পরিবারের অত্যন্ত পরিচিত। আগে থেকেই ইন্দিরা তাঁকে চিনতেন-জানতেন। নায়ারের মতে, মিসেস গান্ধীর গুরুত্বপূর্ণ মিশনের ক্যাপ্টেন হতে এটা কাওয়ের জন্য একটা যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল বৈকি। তদুপরি কাশ্মীরি পন্ডিত হওয়াটাও কাওকে নতুন এজেন্সির প্রধান হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে দিয়েছিল- এমনটাই মনে করেন কে শঙ্করণ নায়ার। তবে আরএন কাওকে ইন্দিরার ভরসা করার যে বিশেষ কারণই থাকুক না কেন, ‘র’-এর মতো সিক্রেট সার্ভিসের অধিনায়কত্বের জন্য কাওই ছিলেন ‘বেস্ট চয়েস’। কাওয়ের কর্মদক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল সমৃদ্ধ। অথচ স্বভাবে প্রচারবিমুখ কাও ছিলেন পর্দার পেছনেই স্বচ্ছন্দ্য। শত্রু পক্ষের নজর এড়াতে যে সংগঠনের নামেই ‘ক্যামোফ্লাজ’, সেই সংগঠনের নেতা হিসেবে দরকার ছিল আরএন কাওয়ের মতোই একজন সুদক্ষ অথচ ‘লো প্রোফাইল’ গোয়েন্দা আধিকারিক।
নিজের হাতে গড়লেন ‘র’-এর কাঠামো
দেশের ভেতরে যে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোগুলি কাজ করে থাকে, তাদের সঙ্গে বহির্দেশে কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির গঠন কাঠামো ও কাজের ধরণে বড় রকমের পার্থক্য আছে। গতানুগতিক পদ্ধতিতে বিদেশের মাটিতে বিশেষ করে শত্রুদেশে গোয়েন্দাগিরি চালানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া যে কোনও দেশের করিতকর্মা ‘ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’র কাজ শুধু অন্য দেশে গুপ্তচর পাঠানো নয়। একটা দেশের পররাষ্ট্র নীতি, প্রতিরক্ষা নীতি কোন দিকে যাবে, কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে কেমন কূটনৈতিক সম্পর্ক হবে, তার অনেক কিছুই নির্ভর করে ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির পাঠানো তথ্যাদির উপরে। দেশের কূটনীতিকদের, বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনগুলিকে তাই সর্বদাই ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে চলতে হয়। এই ধরণের ইন্টেলিজেন্স উইং হামেশাই এক-একটা দেশের পলিটিক্যাল উইং হিসেবেও সক্রিয় হয়ে ওঠে। নিজের রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অন্য রাষ্ট্রের সরকার বদল ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাজের মধ্যেই পড়ে। এই সমস্ত কিছু বিবেচনা করে সূত্রপাত থেকেই ‘র’-এর কার্যপদ্ধতি ও গঠনকাঠামোর ব্যাপারে সচেতন ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা চান নি আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার ফাঁসে ‘র’-এর মিশন ব্যাহত হোক। তিনি কেমন সংগঠন প্রত্যাশা করেন, প্রোজেক্ট তৈরির আগে কাওকে বুঝিয়ে বলেছিলেন ইন্দিরা। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা অনুযায়ীই ভারতের ‘ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’র কাঠামো তৈরি করেছিলেন রামেশ্বরনাথ কাও।
কে শঙ্করণ নায়ারের ভাষ্য অনুযায়ী ‘র’-এর কাঠামো রচনাই ছিল কাওয়ের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। কয়েকটি পরামর্শ দেওয়া ছাড়া নতুন এজেন্সির পরিকাঠামো নির্মাণ, কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ ও পরিচালনার ব্যাপারে কাওকে ‘ফ্রিহ্যান্ড’ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সংস্থায় কর্মরতদের পদ সচিবালয়ের ধাঁচে সাজিয়েছিলেন কাও। প্রস্তাবিত গঠনকাঠামোয় নতুন এজেন্সির প্রধানের পরিচয় হয় সচিব। অধঃস্তনদের ‘আন্ডার সেক্রেটারি’ পদমর্যাদা প্রদান করা হয়। ভারতের ‘ফরেন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’র ‘Research and Analysis Wing’ নামকরণে তৎকালীন ক্যাবিনেট সচিব ডিএস যোশীর ভূমিকা ছিল বলে নায়ার তাঁর বই ‘Inside IB and RAW The Rolling stone that Gathered Moss’-এ দাবি করেছেন। সংস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য লোকচক্ষে গোপন রাখতেই ছদ্মনামে সংস্থাটিকে ক্যাবিনেট সচিবালয়ের একটি শাখা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন যোশী।
অসমান্য ‘টিম লিডার’ গড়লেন অনবদ্য এক ‘টিম’
‘র’-এর টিম তৈরীতে অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছিলেন টিম লিডার কাও। নতুন সংস্থার নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল ‘ইউপিএসসি’-র নিয়ন্ত্রণমুক্ত। আইপিএস ক্যাডার নেওয়ারও কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। নতুন নিয়োগ হোক আর নতুন পদ সৃষ্টি, দূতাবাসগুলিতে পোস্টিং কিম্বা বিদেশ ভ্রমণ- সংস্থার প্রধান হিসেবে কাও ক্যাবিনেট সচিবালয়ে যে প্রস্তাব পাঠাতেন, ক্যাবিনেট সচিবালয়ের একজন সচিব হিসেবে তিনিই তাতে ছাড়পত্র দিতেন। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা কার্যকর করতে ‘র’-এর অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো ও কাজকর্ম আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্ত এমন সোজাসাপ্টা হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। আইবি সহ বিভিন্ন ‘সেক্টর’ থেকে মাত্র আড়াইশো জনকে নিজের হাতে সযত্নে বাছাই করে একটা ছোট টিম তৈরী করেছিলেন ‘স্পাই মাস্টার অব ইন্ডিয়া’। ১৯৬৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘ধর্ম রক্ষতি রক্ষিতঃ’ আদর্শকে সামনে রেখে ‘Research and Analysis Wing-RAW’এর জন্ম। আত্মপ্রকাশের মাত্র তিন বছরের মাথায় ‘কাও বয়েজ’রা দুর্ধর্ষ এক ‘সিক্রেট সার্ভিস’-এ পরিণত হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন ইউপিএ জামানায় দেশের তৃতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। কাও জন্ম শতবর্ষে ‘আইবি’-র পূর্বতন প্রধান নারায়ণন তাঁর ‘এক্স বস’ সম্পর্কে বলেছেন, “তাঁর নেতৃত্বে কাজ করার অনুভূতিই অন্যরকম। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ ক্যাপ্টেন, যিনি নিজের হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে টিমের ছোট-বড় সকলের মনকে স্পন্দিত করতে পারতেন। টিমের সকলের কাছে কাও ছিলেন পিতৃপ্রতিম এক ব্যক্তিত্ব।”
বাংলাদেশ সৃষ্টির নেপথ্যের কারিগর
পাকিস্তানের এক্সটারনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ‘আইএসআই’ বা ‘ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স’-এর জন্ম ১৯৪৮-এর পয়লা জানুয়ারি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের মাত্র সাড়ে চার মাস পরেই। দুই দশক পরে জন্ম নিয়ে ভারতের ‘র’ ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আইএসআই-কে গুনে গুনে গোল দিয়েছিল; তখনও ‘র’-এর গা থেকে আঁতুড়ের গন্ধ যায় নি। একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর- পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনতা থেকে পূর্ববঙ্গকে মুক্ত করার ঘোষিত যুদ্ধটা চলেছিল মাত্র ১৩ দিন। কিন্তু যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত করার ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ শুরু হয়েছিল জানুয়ারি থেকেই। এই কাজে ‘কাও-বয়েজ’রা এতটাই ‘কামিয়াব’ হয়েছিল যে রামেশ্বরনাথ কাওকেই ‘বাংলাদেশের আসল কারিগর’ বলে দাবি করেন কেউ কেউ।
পূর্ব পাকিস্তানে যে গণবিদ্রোহ আসন্ন, সত্তরের শেষেই সেই আভাস পেয়েছিল নয়াদিল্লি। পূর্ব পাকিস্তানের গণবিদ্রোহ দমন করতে ভারতের আকাশ ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তান যাতে বিমানযোগে ঢাকায় সেনা পাঠাতে না পারে, তার একটা উপায় খুঁজে বের করতে কাওকে বলেছিলেন ইন্দিরা। তখনও দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল থাকায় আন্তর্জাতিক আইন মেনে ভারতের উপর দিয়ে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিমান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭১-এর ৩০ জানুয়ারি শ্রীনগর থেকে জম্মু যাওয়ার পথে এয়ার ইন্ডিয়ার ‘গঙ্গা’ নামের ‘ফকার এফ-২৪’ বিমানটি হঠাতই ‘হাইজ্যাক’ হয়ে গেল। নিজেদের কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’-এর সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে দুই অপহরণকারী বিমানটি লাহোরে নিয়ে যায়। বিমানযাত্রীদের নিরাপদে মুক্তির বিনিময়ে ভারতের জেলে আটক সহযোদ্ধাদের মুক্তি দাবি করে অপহরণকারীরা। ভারত সরকার দাবি মানতে অস্বীকার করলে তিনজন ক্রু সহ ৩২ জনকে নামিয়ে দিয়ে লাহোর বিমান বন্দরে প্লেনটি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় দুই অপহরণকারী। সকল যাত্রী নিরাপদে ভারতে ফিরে আসে কিন্তু প্রতিবাদে দুই দেশের মধ্যে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় নয়াদিল্লি। পুরো ঘটনাটাই ছিল ‘র’-এর সাজানো নাটক। ‘র’-এর প্রাক্তন আধিকারিক আরকে যাদব পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, তাঁদের বসের জবাব নেই, প্লট তিনিই সাজিয়ে ছিলেন।
বাংলাদেশকে নিজের হাতের তালুর মতোই চিনতেন কাও। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা এক কোটি শরণার্থীর ভেতর থেকে বেছে বেছে গেরিলা যোদ্ধা ‘রিক্রুট’ করে এক লক্ষের বিরাট বাহিনী তৈরি ও তাদের প্রশিক্ষিত করার কৃতিত্ব ‘র’-কেই দেওয়া হয়। জনশ্রুতি আছে যে ঊনসত্তর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে পশ্চিম পাকিস্তানকে পর্যুদস্তু করার জাল বিছানোর কাজটি শুরু করেছিলেন আর এন কাও। শোনা যায়, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান একবার কাওকে দেখিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, “এই ভদ্রলোক আমার থেকে আমার দেশ সম্পর্কে বেশি জানেন।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎখাত ও হত্যার ষড়যন্ত্র আগেই টের পেয়েছিল বাংলাদেশে থাকা আরএন কাওয়ের নেটওয়ার্ক। ‘র’ প্রধানের পরামর্শ শুনে ব্যবস্থা নিলে প্রাণে বেঁচে যেতেন শেখ মুজিব। শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছদ্মবেশে কাও নিজে দু’বার গিয়ে শেখ সাহেবকে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মুজিবকে ধানমন্ডির অসুরক্ষিত বাসা ছেড়ে রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন ‘বঙ্গভবনে’ উঠতে বলেছিলেন ‘র’ প্রধান। বঙ্গবন্ধু ও আরএন কাওয়ের শেষ মোলাকাতটি সম্ভবত হয়েছিল ১৯৭৫-এর অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে। কাওয়ের কথায় মুজিব কর্ণপাত করেন নি। ১৫ অগাস্ট ভোরে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন তিনি।
সিকিমেও সাকসেস ‘কাও-বয়েজ’রা
সিকিম চিনের গ্রাসে যাওয়ার আগেই ভারত যে পাল্টা চালে ক্ষুদ্র ‘বাফার’ রাষ্ট্রটিকে নিজের ২২তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত করতে পেরেছিল, তা সম্ভব হয়েছিল কেবল সঠিক সময়ে ‘র’-এর পাঠানো তথ্যের কারণে। ১৯৭৪ সালেই সিকিমে চোগিয়াল রাজবংশের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক করেছিলেন ‘র’ প্রধান আরএন কাও। চিন নাক গলানোর আগেই চোগিয়াল রাজ পালডেন থন্ডুপ নামগিয়ালকে ‘ম্যানেজ’ করে সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করে নেন ইন্দিরা। কাওয়ের সফল দৌত্যের কারণেই রাজতন্ত্রের অবসানে রাজি হয়ে গণভোটের ডাক দেন থন্ডুপ নামগিয়াল। সিকিমের অধিকাংশ মানুষ ভারতভূক্তির পক্ষে রায় দিলে ১৯৭৫-এর ১৬ মে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে সিকিমের অস্তিত্ব লোপ পায়।
কাওকে খাটো করতে গিয়ে ‘র’-কে ছোট করেছিলেন দেশাই
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে আরএন কাওকে ভাল নজরে দেখতেন না মোরারজি দেশাই। সাতাত্তরে ইন্দিরার পতনের পর জনতা পার্টি কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে নিজের কর্মজীবনে প্রথমবারের মতো অস্বস্তির মুখে পড়তে হয় ভারতের ‘ফিলোজফার স্পাই মাস্টার’কে। পঁচাত্তরে ইন্দিরাকে ‘অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা’ জারি করতে যাঁরা প্ররোচিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কাও-ও ছিলেন বলে মোরারজি সন্দেহ করতেন। যদিও এই সন্দেহ অমূলক ছিল বলেই ব্যক্তিগত পরিসরে জানিয়েছিলেন কাও। তবে কোনঠাসা ইন্দিরা যে জরুরি অবস্থা জারি করতে যাচ্ছেন, কাওয়ের মতো ‘সুপার স্লুথে’র কাছে সেই তথ্য অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। ঘনিষ্ঠ মহলে কাও দাবি করেছেন, ইন্দিরাকে জরুরি অবস্থার মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি পরিহার করার পরামর্শই দিয়েছিলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল, কাওকে শায়েস্তা করতে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে Research and Analysis Wing-এর মতো অনবদ্য প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে ফেলা। প্রতিবাদে ‘র’-এর সচিব পদ থেকে ইস্তফা দেন আরএন কাও। কাও বিদায় নিলে মোরারজির মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। কাওয়ের উত্তরসূরি কে শঙ্করণ নায়ারও পদে তিন মাস টিকতে পারেন নি, ‘র’-এর হাল এতটাই খারাপ করে ফেলেছিল জনতা পার্টির সরকার।
পৃথিবীর সেরা ‘স্পাইমাস্টার’দের একজন
১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরেই আরএন কাওকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর দেহরক্ষীদের গুলিতে ইন্দিরা নিহত হওয়ার পর রাজীব গান্ধীর হাতে পদত্যাগপত্র তুলে দিয়ে কাজের জগত থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নেন রামেশ্বরনাথ কাও, ততদিনে ছয় ফুটের মানুষটা একটা মিথ। প্রাক্তন ‘র’ প্রধান এএস দুলাত থেকে দেশের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল- ভারতের সকল গোয়েন্দা প্রবরেরা বারাণসীতে জন্ম নেওয়া এই কাশ্মীরি ব্রাহ্মণকেই আচার্য মানেন। সত্তরের দশকে পৃথিবীর সেরা পাঁচ গোয়েন্দা প্রধানের তালিকায় ভারতের রামেশ্বরনাথ কাওকে না রেখে পারেন নি ফ্রান্সের ‘এক্সটারনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ ‘SDECE’-র প্রাক্তন প্রধান কাউন্ট আলেকজান্ডার ডে মারেনচাস।
২০০২ সালের ২০ জানুয়ারি দিল্লিতে ‘র’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান রামেশ্বরনাথ কাওয়ের বর্ণময় জীবনে পূর্ণচ্ছেদ পড়ে। প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই বেঁচে আছেন কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতা।
Feature graphic is representational.
- ঋণস্বীকার- IB and RAW The Rolling stone that Gathered Moss by K Shankaran Nayar/ R.N. Kao: Gentleman Spymaster by Nitin Anant Gokhale/ Mission R&AW by RK Yadav.