এত স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে এর আগে রাজ্য বিজেপি কবে এত বড় জমায়েত করতে পেরেছে- এই প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে
পলিটিক্যাল ডেস্ক: এই মুহূর্তে বাংলায় বিজেপিকে রাজনৈতিক লক্ষ্যে আগের তুলনায় অনেক বেশি স্থির ও দৃঢ় বলে মনে হচ্ছে। একুশে নবান্ন দখলের স্বপ্নভঙ্গের পর বঙ্গ বিজেপির মধ্যে যে ছন্নছাড়া অবস্থা তৈরি হয়েছিল তা অনেকটাই কেটেছে। যে যাই বলুক, পঞ্চায়েত নির্বাচন বিজেপিকে আশাহত করে নি। পঞ্চায়েতে দ্বিতীয় স্থান বাম-কংগ্রেসের হাতে খোয়া গেলে বাংলায় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শাহ-নাড্ডার উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজেপি যে ফল করেছে, তা প্রত্যাশার চেয়ে খানিকটা বেশিই। অমিত শাহ ঘোর বাস্তববাদী রাজনীতিক। উপরন্তু দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে তিনি ভালোই খবর রাখেন, কোন পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই করে বাংলায় দল গ্রাম পঞ্চায়েতে ১০ হাজার আসনে বিজয়ী হয়েছে। তাই পঞ্চায়েত ভোটের ফল প্রকাশের পর রাজ্য নেতৃত্বকে ‘বাধাই’ জানাতে বিলম্ব করেন নি শাহ।
জিতেও নাক কাটা গেছে তৃণমূলের
৮০ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেও পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের নাক কাটা গেছে। নির্বাচনকে ঘিরে লাগামহীন হিংসায় দেশে বাংলার নাম খারাপ হয়েছে। ভোটে জোচ্চুরি-জালিয়াতির পরিমাণ এত বিশাল যে কেলেংকারি ঢাকা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। জনগণের মধ্যে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, প্রশাসনের মদতে অবাধে ছাপ্পা মারতে না পারলে পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের পরাজয় ছিল নিশ্চিত। পঞ্চায়েত ভোট মিটতেই রাজনীতির বাতাসে লোকসভা নির্বাচনের গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। অসদুপায়ে অর্জিত বিশাল জয় তৃণমূলের জন্য শীঘ্রই বিশাল বোঝায় পরিণত হতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটেও একই ভুল করেছিল বাংলার শাসকদল। এক বছর পরে লোকসভা নির্বাচনে ১২টি আসনে হারিয়ে ৩৪ থেকে ২২-এ নেমে কৃতকর্মের মূল্য চোকায় তৃণমূল কংগ্রেস।
একুশের পর উপর্যুপরি খারাপ ফল বিজেপির
আঠারোর পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের সন্ত্রাসের মুখে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ৩৪ শতাংশ আসনে প্রার্থীই দিতে পারে নি বিরোধীরা। গ্রাম পঞ্চায়েতে ৫৭৭৯টি আসনে জিতে বামেদের হটিয়ে দ্বিতীয় হয়েছিল বিজেপি। দল যে চেষ্টা করলে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় পর্যন্ত আসতে পারে, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে এই আশা প্রথম দেখিয়েছে আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটের ফল। আঠারোর স্থানীয় নির্বাচনে বাংলায় বিজেপির প্রাপ্তি ছিল ১৯ শতাংশ ভোট। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বেড়ে হয় ৪০.১৩ শতাংশ। লোকসভায় ১৮ আসন ও ৪০ শতাংশের উপর ভোট পাওয়ার উদ্দীপনায় একুশে বঙ্গ জয়ের উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন অমিত শাহ। যদিও বিজেপিকে শেষ পর্যন্ত থামতে হয়েছিল মাত্র ৭৭টি আসনে। মাত্র শব্দটি আসলে আপেক্ষিক। নবান্ন দখল সম্পর্কে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে মন্ডল স্তরের কর্মী এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে পরাজয়ের ধাক্কায় বাংলার পদ্ম শিবির টলমল করে উঠেছিল এবং চলে গিয়েছিল ‘ট্রমার’ মধ্যে।। বাস্তবকে ছাপিয়ে প্রত্যাশার পারদ অতটা না চড়লে ৩৮.১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ৭৭টি আসন জেতাকে সেদিন নেহাতই কম বলে মনে হত না বঙ্গ বিজেপির।
একুশে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার জের অনেক দিন পর্যন্ত টানতে হয়েছে রাজ্য বিজেপিকে। হতোদ্যম হয়ে বসে গেছেন সাধারণ কর্মীরা। সুযোগসন্ধানী সাংসদ-বিধায়কেরা তৃণমূলে ভেগে গেছেন। দলে অন্তর্কলহ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা থামাতে বারে বারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। রাজ্যে বুথ স্তরে বিজেপির সংগঠন বরাবরই দুর্বল। হারের ধাক্কায় তা আরও দুর্বল হয়েছে। অত্যাচারিত সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের পাশে শীর্ষ নেতারা দাঁড়ান নি বলে দলের মধ্যে অভিযোগ উঠেছে। বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে কোনও নির্বাচন, উপনির্বাচনেই ভাল ফল করে নি রাজ্য বিজেপি। দুটি জেতা বিধানসভা আসন হাতছাড়া হয়েছে। বাবুল সুপ্রিয়র ছেড়ে যাওয়া আসানসোল লোকসভাও হারাতে হয়েছে বিজেপিকে। সমানে পার্সেন্টেজ নামতে থাকায় রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তবে কি বিজেপি থেকে ভোট বামেদের ঘরে ফিরতে শুরু করেছে?
পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই শক্তি বৃদ্ধি পদ্মের
এই রাজ্যে লোকসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্যে ব্যবধান থাকে এক বছরেরও কম। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট হয় ৬১ হাজারের বেশি বুথে। এই বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ৫ কোটি ৬৭ লক্ষ ২১ হাজার ২৩৪ জন। যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে জনভিত্তি যাচাইয়ের জন্য পঞ্চায়েত ভোটের বিকল্প নেই। কিন্তু ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হলে তবেই না জনভিত্তি যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। পঞ্চায়েত ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হলে কী ফল আসবে, এই নিয়ে সংশয় ছিল বলেই প্রশাসনের সহায়তায় ছাপ্পা-সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছে শাসকদল- অভিযোগ বিরোধীদের। সন্ত্রাস-হিংসা ও ছাপ্পা পঞ্চায়েত ভোটের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শাসকদলের আক্রমণ ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসনকে সামাল দিয়েই পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের সবাইকে লড়তে হয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি শুধু দ্বিতীয় স্থানই ধরে রাখে নি ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরেই নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। গ্রাম পঞ্চায়েতে ৪,২২৫টি আসন বেড়েছে বিজেপির। পঞ্চায়েত সমিতিতে ১,০১৯টি আসন পেয়েছে বিজেপি, যা আঠারোর থেকে আড়াইশোটি বেশি। জেলা পরিষদে ৩১, যা আগের বারের থেকে ৯টি বেশি। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির ভোট ২৩ শতাংশ। আঠারোর থেকে ৪ শতাংশ বেশি।
বিনা প্রস্তুতিতে কলকাতায় বড় মিছিল বিজেপির
পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির সব থেকে বড় প্রাপ্তি গ্রাম পঞ্চায়েতে আসন সংখ্যা চার অঙ্কে নিয়ে যাওয়া। বাংলার ১০,০০৪ টি বুথে পদ্ম প্রতীকে নির্বাচিত জন প্রতিনিধির উপস্থিতি লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য বিজেপিকে মনোবল জোগাবে বৈকি। পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই বাম-কংগ্রেসের যোগফলের থেকেও অনেকটা এগিয়ে বিজেপি।
সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল যে বিজেপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করেছে তার প্রমাণ বুধবার ( ১৯ জুলাই) কলকাতায় বিজেপির হঠাৎ ডাকা মিছিল। এত স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে এর আগে রাজ্য বিজেপি কবে এত বড় জমায়েত করতে পেরেছে, এই প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বেঙ্গালুরুতে মমতা, বঙ্গে রঙ্গে বিজেপির নেতারা
পঞ্চায়েত ভোটের রেশ কাটার আগেই বঙ্গ বিজেপির জন্য সুসংবাদ এসেছে বেঙ্গালুরু থেকে। তথায় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ২৬ দলের জোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সসম্মানে স্থান পেতেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর মুখে অমাবস্যার আঁধার নেমেছে। ওদিকে একই মঞ্চে মমতা-ইয়েচুরিকে হাজির দেখে পলিটব্যুরোর বাপ-বাপান্ত করছেন সিপিএম-এর সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা। বাংলায় কুস্তি, দিল্লিতে দোস্তির যে সেটিং তত্ত্বে এতদিন সুকান্ত-শুভেন্দুদের বিঁধতেন সেলিম-সুজন-অধীররা তা বাম-কংগ্রেসকে ফিরিয়ে দিচ্ছে বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনে মমতার সঙ্গে কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় গেলে এই রাজ্যে কংগ্রেস তো ডুববেই সখাহারা বামেদেরও স্থান হবে হিমঘরে। শুভেন্দু অধিকারী ‘নো ভোট টু মমতা’ স্লোগান মন্ত্রের মতো জপে চলেছেন। মমতা বিরোধী সব ভোট ঝেঁটিয়ে পদ্মের ঘরে ফেলাই শুভেন্দুর লক্ষ্য। বেঙ্গালুরুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে বিজেপির কাজটা সহজ করে দিয়েছে বাম-কংগ্রেস।
Feature Image- NNDT.