কলকাতা: বেঙ্গালুরুতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সদ্য গঠিত ‘ইন্ডিয়া’ জোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে সীতারাম ইয়েচুরি। বাংলার বাম মহল তোলপাড়। সিপিএমের নিচু তলার কর্মীরা দলের সিদ্ধান্তে হতবাক। অস্বস্তি ঢাকতে অবশেষে মুখ খুললেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বুধবার আলিমুদ্দিনে সিপিএমের রাজ্য দফতরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সেলিমের দাবি, ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’ কোনও নির্বাচনী জোট নয়। সেলিমের কথা অনুযায়ী, বেঙ্গালুরুতে মানুষের জীবন ও জীবিকা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রক্ষায় নীতি গ্রহণ করতে কোনও নেতা বা মুখ ছাড়াই বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলি এককাট্টা হয়েছিল।
বেঙ্গালুরুতে বিজেপি বিরোধী দলগুলির মূল উদ্যোক্তা কংগ্রেসের তরফ থেকে এই জাতীয় কোনও বক্তব্য না এলেও সেলিমের দাবি, অনেকে ভোটের জন্য জোট করার চেষ্টা করলেও তাতে সিপিএমের সায় নেই। মহম্মদ সেলিমের মতে, বেঙ্গালুরুর বৈঠক থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে নীতির লড়াই শুরু হয়েছে। সীতারাম ইয়েচুরিও বিষয়টি বৈঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন বলে সেলিমের দাবি। তাহলে সদ্যজাত ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কি ভোট নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বলেন, “আমাদের পরিস্কার কথা, ভোটে আসন সমঝোতা হবে প্রত্যেকটি রাজ্যের নিজস্ব বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে।” সেলিম বলেন, “বিজেপি হঠাও দেশ বাঁচাও আমরা তো আজ থেকে বলছি না। যেমন আমরা ২০১৫ থেকেই বলছি, তৃণমূল হঠাও বাংলা বাঁচাও।”
বাংলায় দলের তৃণমূল বিরোধী অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না বলে দাবি করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বলেন, “সিপিআইএম প্রত্যেকটা মোড়ে গিয়ে রাজনীতিতে ‘ইউ টার্ন’ করে না। আজকে তৃণমূলকে ‘ইউ টার্ন’করতে হয়েছে। গোয়া, মেঘালয়, সাগরদিঘি নির্বাচনের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীকে গালাগাল করেছিলেন।” বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি রুখতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক অবিজেপি দলগুলিকে নিয়ে বৃহত্তর জোট সিপিএমের বরাবরের চাওয়া বলে সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেন মহম্মদ সেলিম। এই পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে আরএসএস-এর মদতে মমতা সক্রিয় ছিলেন বলে সেলিমের অভিযোগ। সেলিমের দাবি, আরএসএস-এর ইন্ধনে কংগ্রেসকে দুর্বল করতে মমতা তৃতীয় ফ্রন্ট নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছিলেন। এখন পরিস্থিতির চাপে পথ বদল করে কংগ্রেসের ডাকা বৈঠকে হাজির হচ্ছেন মমতা- কটাক্ষ সেলিমের।
বুধবার আলিমুদ্দিনে মহম্মদ সেলিম বলেন, “কংগ্রেস সহ অন্যান্য দল ভেঙে বেরিয়ে আসা গোষ্ঠীদের নিয়েই এনডিএ তৈরি হয়েছিল। এখনও এনডিএ-তে গোটা দলের সংখ্যা কম। বিভিন্ন দলের ‘ব্রেকওয়ে গ্রুপগলিরই রমরমা সেখানে।” সেলিমের কটাক্ষ, “দু দিন বাদে টিএমসি-র একটা ব্রেকওয়ে গ্রুপও এনডিএ-তে যোগ দিতে পারে। এইজন্য বিজেপি অপেক্ষা করছে।” তৃণমূল নেতৃত্বের একটি বড় অংশের সঙ্গে বিজেপির ভাল যোগাযোগ আছে বলে দাবি করেন সেলিম। তাঁরা যতটা কমিউনিস্ট ও কংগ্রেসের বিরোধী ততটা বিজেপি বিরোধী নন। সিবিআই-ইডির তদন্তের হাত থেকে নিজে বাঁচতে ও ভাইপোকে বাঁচাতে মমতা বিজেপির সঙ্গেই তলে তলে বোঝাপড়া করে চলেছেন বলে অভিযোগ করেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক।
আলিমুদ্দিনের বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না
বেঙ্গালুরুর বৈঠকের পর সংবাদ মাধ্যম সিপিএমকে বেশি বেশি মাতামাতি করছে বলে কটাক্ষ করেন মহম্মদ সেলিম। সংবাদ মাধ্যম একই মঞ্চে ইয়েচুরি-মমতার উপস্থিতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় আলিমুদ্দিন যে অস্বস্তিতে সেলিমের কটাক্ষে তা স্পষ্ট বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সেলিম বলেন, “সিপিএমের রাজনৈতিক লাইন খবরের কাগজ, টেলিভিশন চ্যানেলের হেডলাইন দেখে ঠিক হয় না। ফেসবুক থেকেও ঠিক হয় না। এমনকি পাটনা, বেঙ্গালুরু, মুম্বাইয়ে জোটের বৈঠক থেকেও ঠিক হয় না। সিপিএমের লাইন পার্টি কংগ্রেসে ঠিক হয় দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনার পর।”
দল পার্টি কংগ্রেসে নেওয়া লাইনের বিপরীতে গিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক সমঝোতায় যাবে না- এটা বোঝাতেই মহম্মদ সেলিম এমন মন্তব্য করেন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা। তবে পঞ্চায়েত ভোটের উত্তেজনা থিতিয়ে যাওয়ার আগেই বেঙ্গালুরুর বৈঠকে এক মঞ্চে মমতার সঙ্গে সীতারাম ইয়েচুরির ছবি নিয়ে আলিমুদ্দিনের অন্দরেও চাপা ক্ষোভ-হতাশা কম নেই। কিন্তু দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের ভয়ে সবার মুখে কুলুপ। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জামানায় নিচু তলার কর্মীদের মুখ বন্ধ রাখা মুশকিল। দলের কর্মী-সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা রাখতেই যে নতুন জোট নিয়ে সেলিমের এত সাফাই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
Feature image- NNDT.