কলকাতা: একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মমতা কংগ্রেসকে তো ছুঁলেনই না এমনকি সিপিএমেরও নাম নিলেন নমঃ নমঃ করে। শুক্রবার ধর্মতলায় তৃণমূল সুপ্রিমোর ৪৩ মিনিটের ভাষণের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। সামাজিক মাধ্যমে বৃহস্পতিবার থেকেই বিজেপির লোকেরা বলতে শুরু করেছিলেন, “২১ জুলাই গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিলেন যুব কংগ্রেসের কর্মীরা। গুলি করেছিল বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ। শহিদ স্মরণ করবে তৃণমূল। আর মমতা মন খুলে গালি দেবেন বিজেপিকে।” ২১ জুলাইয়ের নিহতদের স্মরণে ধর্মতলায় তৃণমূলের অনুষ্ঠানটা বাৎসরিক, মমতা ক্ষমতায় আসার পর যা কার্যত উৎসবে পরিণত হয়েছে। চব্বিশে লোকসভা নির্বাচনের আগে শেষ শহিদ দিবসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর চোখ এখন দিল্লিতে; কংগ্রেস বন্ধু এমনকি সিপিএমও পর নয়।
সিপিএমের অ্যালার্জি! এইটুকুই যা অভিমান
বেঙ্গালুরুতে জোটের বৈঠক থেকে সদ্যই ফিরেছেন। সেখানে সোনিয়া-রাহুলের থেকে খাতিরও কম জোটে নি। সাগরদিঘি উপনির্বাচনে হেরে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে ঝাঁঝ দেখিয়েছিলেন মমতা, তিন মাসের মধ্যেই তা অতীত। ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’ বা ‘ইন্ডিয়া’ নামে ২৬ দলের জোটের নেতৃত্বে কংগ্রেস। তৃণমূল যে’হেতু নিজেদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক করে ফেলেছে, তাই একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে মমতা যে কংগ্রেস নিয়ে নীরব থাকবেন, তার পূর্বাভাস রাজনৈতিক মহলের কাছে ছিল।
বেঙ্গালুরুর যে বৈঠকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের জন্ম, তাতে উপস্থিত ছিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও। সেই খাতিরে সিপিএমও তৃণমূলের শরিক। শরিকি বিবাদ ভাল নয়। তাই সিপিএমের বিরুদ্ধে যতটুকু না বললে না হয়, ততটুকু বলেই কাজ সেরেছেন মমতা। বামেদের বিরুদ্ধে মমতা এ’দিন যা বলেছেন, তাতে রাগ-ক্ষোভের চেয়ে অভিমানই ছিল বেশি। সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা নিয়ে বিরোধীরা কাঠগড়ায় তুলেছে শাসকদল ও প্রশাসনকে। হিংসার অভিযোগ লঘু করতে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মমতা বলেন, “বুদ্ধদেববাবুর আমলে কী হয়েছিল? মমতার নামে আপনাদের তো চিরকাল ‘অ্যালার্জি’! ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৮ সালে ভোটের দিন ৩৯ জন মারা গিয়েছিল। এ’বার মারা গিয়েছে ২৯ জন। তার মধ্যে তৃণমূলেরই ১৮ জন।” এরপর মমতা সিপিএমের নাম উল্লেখ করে যা বলেন, তাকে ঠিক নিন্দা বলা চলে না। তৃণমূল সুপ্রিমো বলেন, “আমাদের পঞ্চায়েতগুলো সিপিএমের সরকারের কায়দায় কাজ করবে না। আমাদের সরকারের মতো কাজ করবে।” বছরের পর বছর ২১ জুলাইয়ের যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমকে তীব্র বাক্যবাণে বিদ্ধ করে গেছেন, শুক্রবার সেই মঞ্চ থেকেই সিপিএমের উদ্দেশ্যে মমতার মিহি অভিযোগ, “আমার নামে আপনাদের তো চিরকাল ‘অ্যালার্জি’! তবে কি ২১ জুলাইয়ের ধর্মতলায় সিপিএমকে তাঁর প্রতি ‘অ্যালার্জি’ ত্যাগের পরামর্শ দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা ছেড়েছেন মমতা?
এ’দিন সিপিএমের প্রতি যতটা নরম ছিলেন মমতা, ততটাই গরম ছিলেন বিজেপি ও মোদীর বিরুদ্ধে। মমতা বলেন, “আমরা ইনক্লুসিভ জোট তৈরি করতে পেরেছি। সবটাই ‘ইন্ডিয়া’র ব্যানারে হবে। আমরা চেয়ারকে কেয়ার করি না। ‘ইন্ডিয়া’ লড়বে। তৃণমূল কংগ্রেস সৈনিকের মতো ঝান্ডা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে।” মমতা আরও বলেন, “বিজেপি দেশ থেকে রাজনৈতিক ভাবে বিদায় নিক। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সব সীমা পার করে গিয়েছে। আমি বলে দিয়েছি, আমাদের চাওয়ার কিছু নেই। আমাদের একটাই চাই, লেট ইন্ডিয়া উইন, লেট বিজেপি লুজ।”একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর বিরোধী জোটের মুখ হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল সুপ্রিমোর শুক্রবারের বক্তৃতার পর মনে হওয়া স্বাভাবিক, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা ত্যাগ করেই কংগ্রেসের জোটে নাম লিখিয়েছেন তিনি।
মোদীর পরে মিডিয়াই চক্ষুশূল
ধর্মতলায় বিজেপির পরেই মমতার রোষ গিয়ে পড়ে মিডিয়ার উপরে। বলেন, “কিছু নেতিবাচক ব্যক্তি শুধু এবিপি আনন্দ দেখে মনে করে, ওরা যেটা বলছে, সেটাই সত্যি। মিডিয়া ট্রায়াল। আমি তাদের বলব, বিজেপি চ্যানেলগুলোকে কিনে নিয়েছে। যদি না বলে তবে ইনকাম ট্যাক্স রেইড করবে। ইডি রেইড করবে। সিবিআই রেইড করবে। এখানেও দেখবেন, আজ ২১ জুলাই হয়ে গেল। কাল-পরশু থেকে আবার শুরু হয়ে যাবে।” গত বছর ২১ জুলাইয়ের পরের দিন সকালেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী অর্পিতার ঘরে রেইড করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। ২৩ জুলাই ভোর হওয়ার আগেই দু’জনকে হেফাজতে নিয়েছিল ইডি। এবারের ২১ জুলাই পার্থ-অর্পিতার কারাবাসের বর্ষপূর্তিরও ২১ জুলাই। এটা মনে করেই কি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এমন কটাক্ষ?
Feature image- NNDT.