কলকাতা: পঞ্চায়েত নির্বাচনে এসডিও, বিডিওরা নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়ে শাসকদলের পদাধিকারীতে পরিণত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের। এ’বার সেই অভিযোগকে মান্যতা দিল আদালতও। তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে নথি বিকৃতি করায় উলুবেড়িয়ার এসডিও, বিডিও ও জাতি শংসাপত্র দফতরের অতিরিক্ত ইনস্পেক্টরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করল কলকাতা হাইকোর্ট নিযুক্ত তথ্যানুসন্ধান কমিটি। বৃহস্পতিবার বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি অপূর্ব সিংহ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চে রিপোর্ট জমা দেন তথ্যানুসন্ধান কমিটির সদস্য প্রাক্তন বিচারপতি দেবীপ্রসাদ দে।
৮ জুলাই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে। ১১ জুলাই ছিল গণনা। কিন্তু এখনও পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে হাইকোর্টে ছয় ডজনের বেশি মামলা ঝুলে আছে। এমনকি প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিজয়ী প্রার্থীদের সরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষনা করারও সুযোগ নেই নির্বাচন কমিশনের। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিডিও, এসডিওদেরও গণহারে কাঠগড়ায় তুলেছে বিরোধীরা। উলুবেড়িয়ার ঘটনাটা মারাত্মক। উলুবেড়িয়া-১ ব্লকের বহিরা-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি আসনে তৃণমূল প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে দিতে বিডিও নিলাদ্রীশেখর দে, উলুবেড়িয়ার এসডিও শমীককুমার ঘোষ ও জাতি শংসাপত্র দফতরের অতিরিক্ত ইনস্পেক্টর কৃপাসিন্ধু সামই-এর বিরুদ্ধে তথ্য বিকৃতি ও জালিয়াতির অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন দুই বিরোধী প্রার্থী।
আসনটি ওবিসি প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত। সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন লুৎফানেসা বেগম। লুৎফানূসা ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত না হওয়ার পরেও তাঁকে ওবিসির সার্টিফিকেট পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূল প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে দিতে স্ক্রুটিনির সময় কাশ্মীরা বিবি ও ওমজা বিবি নামে দুই বিরোধী প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে দেন বিডিও। তথ্য বিকৃতি করে তাঁদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে বলে স্ক্রুটিনির পরপরই বিডিওর কাছে অভিযোগ করেন কাশ্মীরা ও ওমজা। কিন্তু তাঁদের অভিযোগে কান না দিয়ে তৃণমূলের লুৎফানেসা বেগমকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী বলে ঘোষণা করে দেন বিডিও নিলাদ্রীশেখর দে। প্রশাসনিক স্তরে সুবিচার না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন দুই বিরোধী প্রার্থী।
আদালতের নির্দেশে তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত
মামলাটি বিচারপতি অমৃতা সিনহার বেঞ্চে উঠেছিল। শুনানি শেষে নথি বিকৃতির অভিযোগটি যাচাই করতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি। একক বেঞ্চের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিডিশন বেঞ্চে যায় রাজ্য সরকার। সিবিআই তদন্তের পরিবর্তে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দেবীপ্রসাদ দে-র নেতৃত্বে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেয় বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি অপূর্ব সিংহ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ। তথ্যানুসন্ধান কমিটিকেই অভিযোগটির যথার্থতা তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতিরা। বৃহস্পতিবার আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা করে কমিটি। আদালতের নির্দেশে গঠিত তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট বলছে মামলাকারীদের অভিযোগ মিথ্যে নয়। কমিটির সামনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী লুৎফানেসা বেগম স্বীকার করেছেন, তিনি ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত নন, তাঁর ওবিসি শংসাপত্রটি ভুয়ো।
খোদ বিডিও-এসডিও জালিয়াতিতে জড়িত!
তথ্যানুসন্ধান কমিটির তদন্তে দেখা গেছে, একা বিডিও নয়, এসডিও এবং জাতি শংসাপত্র বিভাগের আধিকারিকও তথ্য বিকৃতি ও জালিয়াতিতে জড়িত। তৃণমূল প্রার্থীকে ভুয়ো ওবিসি শংসাপত্র পাইয়ে দিতে তিনজনেরই ভূমিকা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। রিপোর্টে তিনজনকেই সাসপেন্ড করার সুপারিশ করেছে কমিটি। উলুবেড়িয়ার-১ ব্লকের বিডিও নিলাদ্রীশেখর দে, উলুবেড়িয়ার এসডিও শমীককুমার ঘোষ ও জাতি শংসাপত্র দফতরের অতিরিক্ত ইনস্পেক্টর কৃপাসিন্ধু সামইকে বরখাস্ত করার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।
পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ ডিভিশন বেঞ্চের
এ’দিন শুনানি শেষে উলুবেড়িয়া-১ ব্লকের বহিরা-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই আসনের ফল বাতিল করে দিয়ে আসনটি শূন্য বলে ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, তৃণমূল প্রার্থী লুৎফানেসা বেগমের ওবিসিদের জন্য সংরক্ষিত ওই আসনে ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার নেই। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে আসনটিতে পুনর্নির্বাচনের দিন ঠিক করতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
পঞ্চায়েত ভোট কেন বাতিল নয়?
কোথাও বিডিও, এসডিও-র সঙ্গে শাসকদলের যোগসাজশে মক্কায় বসেও মনোনয়ন জমা করে দিচ্ছেন প্রার্থী। কোথাও তৃণমূল প্রার্থীকে ভুয়ো শংসাপত্র জুটিয়ে দিয়ে তথ্য বিকৃতি ঘটিয়ে বিরোধীদের মনোনয়ন বাতিল করে দিচ্ছেন বিডিও, এসডিওরা। এমনকি গণনার দিনও সরকারি আমলাদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের হয়ে কারচুপি করে ফল পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের বিরুদ্ধে এইভাবে গণহারে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের পরেও কেন গোটা পঞ্চায়েত ভোটটাই বাতিল করা হবে না? প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দলগুলি।
Feature image is representational.