সুপ্রিম কোর্ট ভেবে দেখুক, একজন ব্যতিক্রমী বিচারপতির পাশে কেন এত মানুষ! - nagariknewz.com

সুপ্রিম কোর্ট ভেবে দেখুক, একজন ব্যতিক্রমী বিচারপতির পাশে কেন এত মানুষ!


আদালত তার সিস্টেমের মধ্যে অপরাধীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হলে সাধারণ মানুষ ব্যতিক্রমী বিচারপতিদের মধ্যেই ত্রাতা খুঁজবে। লিখলেন উত্তম দেব-

জাস্টিস অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ‘নিউজ চ্যানেলে’ সাক্ষাৎকার দিয়ে নিয়ম ভেঙেছেন, হতেই পারে। কিন্তু তাঁর নিয়মভঙ্গ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের যত মাথাব্যথা, জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে চন্দ্রচূড়ের পদক্ষেপ নিয়ে তার চেয়ে বেশি মাথাব্যথা বাংলার সাধারণ জনগণের। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বলা হয় ভারতবর্ষের প্রধান বিচারপতি। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে এই পদের গৌরব এবং ওজন কোন‌ও অংশে কম নয়। আমি জানি না, প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের কানে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মনোভাবের কথা কেউ পৌঁছে দিয়েছেন কিনা। শুক্রবার দিনটা নিঃসন্দেহে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য খারাপ। নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত দুটি মামলা তাঁর বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তাঁর দুটি নির্দেশের উপরে শীর্ষ আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এ’সব কারণে বিচারবিভাগের অন্দরমহলে জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায় কতটা কোনঠাসা হলেন, জানি না। কিন্তু শুক্রবার বিকেল থেকে জনগণের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করুন। কারা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে, হিসেব খুব পরিস্কার।

ক’জন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে খুশি হয়ে জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে সামাজিক মাধ্যমে মুখ খুলেছেন? যারা প্রভুর মাথায় ছাতা ধরে রাখে, প্রভুর জেলে যাবার পরিস্থিতি হলে সেই ছত্রধারকদের মনের অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এখন প্রভুর বিপদ কাটলে সেই ছত্রধারকের দল খুশি হবে না তো কারা খুশি হবে? এই ছত্রধারকদের বাইরে রাজ্যের যে বিপুল জনসমুদায়, তাদের চোখে তো জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়ের কোন‌ও ত্রুটি ধরা পড়ছে না। হতে পারে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় বিচার নিয়ে ‘অতি সক্রিয়’। আইনের ব্যাকরণ অনুযায়ী বিচারকের ‘অতি সক্রিয়তা’ ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে আম জনতার মাথাব্যথা নেই, আইনবেত্তাদের থাকতে পারে। বিশেষ করে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের অতি সক্রিয়তাকে দুই হাত তুলেই স্বাগত জানাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের জনগণ। ফলে জাস্টিস অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের যে মন্তব্যকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে, সেই মন্তব্যকেই সাধারণ মানুষের মনে হচ্ছে ন্যায্য।

জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করলেই জুটছে গণধিক্কার

আজকে যিনি যত বড় আইনজীবীই হন, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করলেই তিনি জনগণের কাছে ধিক্কারের পাত্র হয়ে যাচ্ছেন। কলকাতার এক প্রখ্যাত ও দাপুটে আইনজীবীর তো এমন দশা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বেরোনোর পর গতকাল যে ক’জন জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন, তাদের একজন নিজেই জেলখাটা। পাবলিক তাঁর কমেন্ট বক্সে গিয়ে বলছে, “তুমি দু কান কাটা বেহায়া।” আরেকজন বাচাল তরুণ, মালিকের মাথায় ছাতা ধরে ধরে হাতব্যথা হয়ে যাবার পরেও যার এখন‌ও বলার মতো কোনও বকশিস জোটে নি। কাল প্রভুর সেই সেবক ছোঁড়া পাবলিকের যত গালি খেয়েছে, ওজন করলে তা তিনশো কুইন্টালের কম হবে না। একদা একদিবসে পদাঘাতে কচুবনে ভূমিশয্যা নেওয়া এক দলবদলু অধ্যাপক‌ও জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়ের বিড়ম্বনায় খুশি হয়ে টুইট করেছেন দেখলাম। পাবলিক তাকে যথারীতি শুধিয়েছে, “দাদা, মাজার ব্যথা কমেছে না এখন‌ও আছে?”

নিয়োগে পর্বত সমান দুর্নীতি, মানুষের পেটে লাথি পড়েছে

আসলে মামলার বিচারে বিচারপতিরা কবে কী খুঁজে বের করবেন, কার জেল হবে আর কার জরিমানা; এ’সব নিয়ে জনতা খুব বেশি ভাবতে নারাজ। লাথিটা না মানুষের পেটে গিয়ে পড়েছে। সমাজে দুর্নীতি অনেক রকমের হয়। এবং মানুষ তা মেনে নেয়, মানিয়েও নেয়। কিন্তু পেটে লাথি পড়লে সবার হুঁশ উড়ে যায়। কেউ কেউ তোলা তুলে এই বাজারে দিব্যি আছে। কিন্তু সবাই কি আর তোলা তুলে খেতে পারে? ছেলেমেয়েদের তো চাকরি চাই। কর্মসংস্থান চাই। গ্রুপ ডি, গ্রুপ সি, প্রাথমিক শিক্ষক, হাইস্কুল শিক্ষক- গ্রেড ধরে ধরে রেট ঠিক করে যারা চাকরি বেচেছে আজ তারা করছেন সমালোচনা- “জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায় নিরপেক্ষ নন!” শুনে পাবলিক বলছে, “নিকুচি মারি তোদের নিরপেক্ষতার। শ্লা… চাকরি চোর!”

জনগণ ব্যতিক্রমী বিচারকদের পছন্দ করে

আরে জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে দুটো মামলা সরিয়ে নিলেই কি জনগণের মুখ বন্ধ করা যাবে? এই দেশের, এই সমাজের সাধারণ মানুষের বহু আগেই এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, আদালতে প্রভাবশালীদের শাস্তি-টাস্তি শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। তাই কদাচিৎ কোন‌ও বিচারক অতি সক্রিয় হয়ে প্রভাবশালীদের শাস্তি দিতে উদ্যোগী হয়েছেন দেখলে জনগণ তাঁর দিকে ঝুঁকে যায়। রাজ্য ক্যাবিনেটের দুই নম্বর পজিশনে থাকা মন্ত্রী, তাঁর তরুণী রক্ষিতার ফ্ল্যাটে টাকার পাহাড়! পঞ্চাশ-ষাট কোটি টাকার স্তূপ। এই লোকটার আসল রূপ কোন‌ও দিন ধরাই পড়ত না নিয়োগ দুর্নীতির সিবিআই-ইডির তদন্ত শুরু না হলে। জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায় দেখে নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে মামলাটির শুনানি না করলে আজ যারা জেলে, তাদের সবকটা জেলের বাইরে বগল বাজিয়ে তোফা দিন কাটাতো। এরা মানুষের টাকা খেয়ে ফূর্তি করে বেড়াত আর যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা কোর্ট-বাড়ি, বাড়ি-কোর্ট করতে করতে আর ত্রিপলের তলায় ধর্না দিতে দিতে যৌবন পার করে দিত।

নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় মানুষের প্রত্যাশা অপরাধীদের শাস্তি

আদালত মানে‌ই তারিখ পে তারিখ- এই জনধারণাকে আপনি কীভাবে মুছবেন? আদালত তার সিস্টেমের মধ্যে অপরাধীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হলে সাধারণ মানুষ ব্যতিক্রমী বিচারপতিদের মধ্যেই ত্রাতা খুঁজবে। বিচার না পাওয়াটাই যদি সংস্কৃতি হয়ে ওঠে তবে মুষ্টিমেয় যে’কজন বিচার দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে মনে হবে, মানুষ তাঁদের দেবতার আসনে বসাবেই। চাকরি চুরির মহোৎসবে কারা কারা টাকা মেরে খেয়েছে, মানুষ সব জানে। কিন্তু গণতন্ত্রে, সভ্য সমাজে, আইনের শাসনে বিচারের ভার তো আর গণআদালতের উপরে থাকে না। বিচার করে আদালত নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে আদালত যদি কোন‌ও অস্বাভাবিক রায় দেয়, তখন তর্জনী উঁচিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ রাখার হিম্মত কার‌ও হয় না। জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায় এজলাসে বিচারকের আসনে বসে যে নির্দেশগুলি দিয়েছেন, তা তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলে গেছে বলেই সাধারণ মানুষ জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়াচ্ছে। নিয়োগ দুর্নীতি মামলার রায় মানুষের প্রত্যাশার বিপরীতে গেলেই বিচারব্যবস্থা মানুষের আস্থা হারাবে। কোনও তত্ত্বকথা দিয়ে জনগণকে বুঝ দেওয়া যাবে না। গণতন্ত্রে মানুষ‌ই শেষ কথা বলে। অত‌এব হাকিম যেই হন, নিয়োগ দুর্নীতি মামলার হুকুম যেন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়।

Feature Image is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *