বারে বারে খালিস্তানের খোয়াবে কেন মজে শিখরা? - nagariknewz.com

বারে বারে খালিস্তানের খোয়াবে কেন মজে শিখরা?


উত্তর খুঁজলেন ঋতুপর্ণা কোলে-

বর্তমানের সব থেকে চর্চিত বিষয় হল পাঞ্জাবের খালিস্তান আন্দোলন এবং খালিস্তানি নেতা অমৃতপাল সিং। বেশ কিছুদিন পাঞ্জাব পুলিশের আর অমৃতপাল সিং-এর মধ্যে চলছে ইঁদুর বেড়াল খেলা। কিন্তু কে এই অমৃতপাল সিং, কেনই বা এত মাথাব্যথার কারণ হল? আর এই খালিস্তান আন্দোলনই বা কী? একটু আলোকপাত করা যাক।

খালসা থেকে খালিস্তান

খালিস্তান কী? খালিস্তান হল ‘খালসার দেশ’। পাঞ্জাব, হিমাচল, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের কিছু জেলা এবং পাকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে, দুশো বছর আগেকার ইতিহাসের সূত্র ধরে, মহারাজ রণজিৎ সিং-এর শিখ সাম্রাজ্যের স্মৃতিতে জারিত আলাদা দেশের দাবি। কিন্তু কেন এই দাবি? বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৬৯৯ খ্রীষ্টাব্দে। শিখদের দশম গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং “খালসা” নামক একটি তত্ত্ব প্রচার করেন। যার অর্থ বিশুদ্ধ। অর্থাৎ যারা সম্পূর্ণভাবে শিখ ধর্মের প্রতি অনুগত থাকবে এবং গুরুর কথা মেনে চলবে তারাই হল ‘খালসা’।

গুরু গোবিন্দ সিং: শিখ ধর্মের দশম তথা শেষ গুরু। খালসা তত্ত্বের প্রচলন করেন তিনি।

এমন প্রস্তাবের নির্দিষ্ট কারণ ছিল। সে’সময় ভারতের বেশিরভাগ অংশে রাজত্ব করছিলেন মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর বিদ্বেষমূলক আচরণের কথা সবারই জানা। যে বিদ্বেষ থেকে শিখরাও মুক্তি পায়নি। গুরু গোবিন্দ সিং-এর পিতা গুরু তেঘবাহাদুরকে হত্যা করেন ঔরঙ্গজেব। যার ফলে শিখদের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে। মোঘলদের বিরুদ্ধ লড়াইতে জিততে শিখদের ভেতরকার আগুনকে উস্কে দিতেই খালসা তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন গুরু গোবিন্দ সিং। এই লড়াইয়ের লক্ষ্যই ছিল স্বাধীনতা, যাতে শিখরা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দুই বিষয়েই স্বাধীনতা লাভ করে। ১৭১০ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বান্দা সিং বাহাদুরের নেতৃত্বে শিখরা দিল্লি ও লাহোরের মধ্যেকার শিরহিন্দ প্রদেশ দখল করে নেয় এবং খালসা রাজ ঘোষণা করে। এবং ভগবান‌ই রাজত্ব করার আদেশ দিয়েছেন এমন একটা বক্তব্য প্রচার করে। সে’সময় থেকেই শিখ সমাজে  “রাজ করেগা খালসা” কথাটি প্রচলিত। এই কথাটি শিখদের  প্রার্থনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। আজও তা জনপ্রিয়। বর্তমান কালে এই নিয়ে গানও বাঁধা হয়েছে।

গুরু তেঘবাহাদুর: গুরু গোবিন্দ সিংয়ের পিতা, যাঁকে হত্যা করেছিলেন ঔরঙ্গজেব।

আবার ইতিহাসের কথায় ফিরি। মাত্র ছয় বছর পরে মোঘলরা বান্দা সিং ও তাঁর সমর্থকদের আটকে অত্যাচার শুরু করে। শিখরা সে’সময়ই অনুধাবন করে তাদের আলাদা স্বাধীন রাজত্বের প্রয়োজনীয়তা। খালিস্তানের স্বপ্ন এখান থেকেই শুরু। সেই স্বপ্ন খানিক বাস্তবতাও পায়। শিখ-মোঘলদের লড়াই ইতিহাস বিখ্যাত। শিখরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জয়লাভ করে।  ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের শেষ যুদ্ধেও শিখদের জয় হয়। এরপর থেকে শিখ সাম্রাজ্যে বিশেষ কোনও সমস্যা দেখা যায় নি। এমনকি মহারাজা রণজিৎ সিং-এর রাজত্ব পর্যন্ত ইংরেজরাও এই সাম্রাজ্যের বিষয়ে নাক গলায় না। রণজিৎ সিং-এর সাম্রাজ্য আজকের পাঞ্জাব, হিমাচলপ্রদেশ, কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল।

আকালি আন্দোলনের সূত্রপাত ও এসজিপিসি গঠন

সমগ্র অঞ্চলের রাজনীতি বদলে যায় মহারাজা রণজিৎ সিং-এর মৃত্যুর পর (২৭শে জুন ১৮৩৯)। ইংরেজ সরকার ধীরে ধীরে রণজিৎ সিং-এর পুরো সাম্রাজ্যটাই দখল করে নেয়। এবং হরিয়ানাকে এই সাম্রাজ্যের অংশ করে দেয়। মহারাজা রণজিতের সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দেয়। স্থানীয় কয়েকজন “মোহান্ত”কে বেছে তাদেরকে গুরুদোয়ারার দায়িত্ব দেয় ইংরেজরা। এই বিষয়টা শিখদের একেবারেই পছন্দ হয়নি। তবে এই ক্ষোভ আন্দোলনের আকার নিতে বেশ কিছুটা সময় নেয়। ১৯২০ সালে সে’কারণেই শিখ ধর্মাবলম্বীরা আকালি আন্দোলন শুরু করেন। অন্যদিকে একটি ১৭৫ জন সদস্যের একটি গোষ্ঠী ইংরেজ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাতে গুরুদোয়ারা থেকে মোহান্তদের সরানো হয়। এই গোষ্ঠীর সদস্যরাই তৈরি করেন ‘শিরোমণি গুরুদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটি’ (SGPC)। এই কমিটিই সে’সময় গুরুদোয়ারা থেকে মোহান্তদের সরিয়ে নিজেরা দায়িত্ব নেয়। এখন পর্যন্ত সমস্ত গুরুদোয়ারাই SGPC-ই পরিচালনা করে চলেছে।

ইংরেজ আমলে ১৯২০ সালে আকালি দলের আত্মপ্রকাশ। জাতীয় কংগ্রেসের পরেই ভারতের সবথেকে পুরোনো রাজনৈতিক দল আকালি। ফটো-আর্কাইভস

এর পর থেকে ধীরে ধীরে  আকালি দল এবং SGPC একসঙ্গে শিখ সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। যদিও তখন শিখরা বিশ্বাস করত যে ব্রিটিশ সরকার যখন থাকবে না তখন তারা তাদের পুরনো শিখ সাম্রাজ্য ফিরে পাবে। কিন্তু শিখদের এই বিশ্বাসে প্রথম ধাক্কা লাগে ১৯২৯ সালে, যখন মতিলাল নেহেরু পূর্ণ স্বরাজ আন্দোলন শুরু করেন। সেখানে সমগ্র ভারতের কথা বলা হয়েছিল, বলা বাহুল্য আলাদা করে শিখ দেশের কথা সেখানে তোলা হয় নি। অর্থাৎ শিখরা যে তাদের নিজেদের স্বাধীন সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখছিলো তা এই আন্দোলনের ফলে ধাক্কা খায়। শিখ নেতারা বোঝেন, এই আন্দোলন সফল হলে তাদেরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। ১৯৪০ সাল নাগাদ শিখদের নিজস্ব দেশের কথা পুনরায় উঠে আসে। কারণ এ’বছরই মুসলিম লিগ লাহোর বিল পাশ করে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি তোলে। অবস্থা বুঝে এ’সময়ই ভীর সিং ভাট্টি শিখদের আলাদা দেশের কথা আবার উত্থাপন করেন। এ’সময়ই প্রথম শোনা যায় “খালিস্তান” শব্দটি। খালসার নাম নিয়ে দেশের কথা আগেও এসেছে। কিন্তু দেশের নাম কী হবে তা এসময়ই স্থির হয়। কিন্তু কংগ্রেস ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের প্রস্তাব একেবারে নাকচ করে দেয়। এরপর আসে ১৯৪৬ সাল। ততদিনে গঙ্গা-সিন্ধু দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দেশভাগ ও জিন্নাহর স্বপ্নের  পাকিস্তান প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যখন দেশভাগের মধ্য দিয়েই ব্রিটিশ শাসন পাকাপাকিভাবে শেষ হতে চলেছে, তখন শিখরা আবার আলাদা পাঞ্জাব প্রদেশের দাবি তোলে। কারণ ইংরেজরা দখলের আগে শিখদের আলাদা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিলো। কিন্তু স্বাধীনতার সময় জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১% শিখ ছিলো। তাছাড়া কেবল পাঞ্জাব প্রদেশের জনগণনায় দেখা যায় কেবল পাঞ্জাব প্রদেশেই ৫৩% মুসলিম, ৩০% হিন্দু, শিখ কেবল ১৫%। ফলে শিখদের পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তখনই নাকচ হয়ে যায়। তখন আকালি দল জানায় তাদের অখণ্ড ভারতের সঙ্গে থাকতে সমস্যা নেই।

দেশভাগ ও ভারতে শিখদের পৃথক রাজ্যলাভ

যখন মুসলিম লিগের দাবি মেনে দেশভাগ‌ই ভবিতব্য হয়ে দেখা দিল,তখন বাংলার পাশাপাশি পাঞ্জাব ভাগ‌ও অনিবার্য হয়ে উঠল। কারণ বাংলার পর  পাঞ্জাবেও মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। পাঞ্জাব ভাগে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিখরাই। কারণ পাঞ্জাবপ্রদেশের অধিকাংশ ভূখণ্ডই পাকিস্তানের ভাগে চলে যায়, তার সঙ্গে যায় অধিকাংশ গুরুদোয়ারা, এমনকি শিখধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের জন্মস্থান লাহোরও চলে যায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের দিকে।  মোট শিখ জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি পাকিস্তানের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। শিখরা একেই পাঞ্জাবে সংখ্যালঘু, তার উপর দুই দেশে তারা ভাগাভাগি হয়ে যায়।  তা সত্বেও এভাবেই থেকে যেতে চেয়েছিলো শিখরা। কিন্তু দেশভাগের সময় দাঙ্গায় শিখ-হিন্দু  ফারাক করে নি পাকিস্তানের মুসলমানরা। শিখরা বাধ্য হয় ভিটে মাটি সব ছেড়ে ভারতে চলে আসতে। কিন্তু ঘটনার একটা উল্টো ফল হয়। কম জনসংখ্যার কারণে শিখরা ফিরে পায়নি তাদের দেশ। কিন্তু পাকিস্তান থেকে শিখরা যখন ভারতের পাঞ্জাব অংশে চলে আসে তখন সেই অংশে শিখদের জনসংখ্যাই হয় সর্বোচ্চ। শিখরা নিজেদের দেশ না পাক সংখ্যাগুরু হিসাবে একটা গোটা রাজ্য পেয়ে যায়।

দেশভাগ দেশত্যাগ! ভিটেমাটি হারিয়ে পাকিস্তান থেকে ভারতের পথে শিখ শরণার্থীরা। ছবি- আর্কাইভস

তারপরেও কিছু ব্যপারে শিখরা খুশি ছিল না। কারণ, শিখ সম্প্রদায়ের নেতারা মনে করতে লাগলেন, দেশভাগের পর থেকেই তাদের প্রতি ভারত সরকারের আচরণ  যথেষ্ট উদার নয়। অনেকসময় তাদের যুক্তিপূর্ণ দাবিদাওয়াকেও নাকচ করা হতে লাগল। যার মধ্যে অন্যতম, ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠন শুরু করে। মারাঠি ভাষার লোক পেয়ে যায় মহারাষ্ট্র, তেলেগুভাষীরা পায় অন্ধ্রপ্রদেশ। পাঞ্জাবের শিখরা সেসময় দাবি করে, হিন্দিভাষী হরিয়ানাকে পাঞ্জাব থেকে আলাদা করে কেবল পাঞ্জাবি ভাষার মানুষের জন্য একটা পৃথক রাজ্য দেওয়া হোক। যা ভারত সরকার গ্রাহ্য করে নি। ফলে পুনরায় শুরু হয় আকালি দলের আন্দোলন। ১৯৬০-১৯৬৫ সালের মধ্যে বহু আন্দোলন হয়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আকালি প্রধান তারা সিং-এর আমরণ অনশন। ১৯৬৫ সালে বাঁধল ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ। শিখরা সব অভিমান ও আন্দোলন ভুলে ভারতের হয়ে মরণপণ লড়াই করল। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে শিখদের অবদানের কথা সমগ্র ভারতবাসী অনুধাবন করল।  ১৯৬৬-তে শিখদের দাবি মেনে পাঞ্জাব রাজ্যকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং হিমাচলপ্রদেশ- তিনটি রাজ্যে ভাগ করে দিল কেন্দ্রীয় সরকার। তবে নতুন সমস্যা জন্ম নিল চণ্ডীগড়কে নিয়ে। যেহেতু চণ্ডীগড়ে হিন্দিভাষীর সংখ্যা বেশি তাই তাকে পাঞ্জাবের সঙ্গে না দিয়ে ইউনিয়ন টেরিটরি বানিয়ে দিলো কেন্দ্রীয় সরকার। যাকে দুই রাজ্যই ব্যবহার করতে পারবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তে শিখরা একেবারেই খুশি করল না। তাছাড়া পাঞ্জাবিভাষীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এমন বেশ কিছু জেলাকে হরিয়ানার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। যাইহোক পাঞ্জাব আলাদা রাজ্য হয়ে যায় এবং পাঞ্জাবের প্রথম ভোটে আকালি দল জেতে কিন্তু নানাকারণে পূর্ণ সময় ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে না। এমন ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে। পাঞ্জাবে আকালি দলের ক্ষমতাকে ভালো চোখে দেখেনি কংগ্রেস। তাই বারবার নানাভাবে মন্ত্রীসভা ভেঙে দেয় যা সাধারণ মানুষের মধ্যে চূড়ান্ত ক্ষোভের সঞ্চার করে।

আনন্দপুর সাহিব প্রস্তাব ও ভিন্দ্রান‌ওয়ালের উত্থান

বিরক্ত আকালি দলের সদস্যরা ১৯৭৩ সালের ১৬-১৭ই অক্টোবর সমবেত হন আনন্দপুর সাহিবে। সেখানে কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং শিখদের দাবি দাওয়া সম্পর্কে একটি তালিকা তৈরি করা হয়। যা আনন্দপুর সংকল্প নামে পরিচিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন এই সংকল্পে আলাদা দেশ বা খালিস্তানের কথা বলা হয়নি। কিন্তু শিখ ধর্ম যে হিন্দু ধর্মের থেকে আলাদা তা এখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি চণ্ডীগড়কে পাঞ্জাবের অংশ করা, পাঞ্জাবের জল পাঞ্জাবের ব্যবহারের জন্য রাখা, রাজ্যের সব ব্যাপারে কেন্দ্র সরকারের মাথা না গলানো, পাঞ্জাবি বলা জেলা পাঞ্জাবের অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি দাবি রাখা হয়েছিল। সবথেকে বড় দাবি ছিল পাঞ্জাবের জন্য তারা নিজস্ব সংবিধান বানাবে শিখ ধর্ম অনুসারে। ১৯৭৮ সালে আকালি দল এই সংকল্পের একটি সংশোধিত রূপ প্রকাশ করে।

জারনেইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে: খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদের জনক। ফটো ক্রেডিট- ইন্ডিয়া টুডে

পাঞ্জাবের ইতিহাসে ১৯৭৮ সালটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবছরই পাঞ্জাবের ইতিহাসে যুক্ত হয় ভিন্দ্রানওয়ালে। আলোচনার শুরুতে যে অমৃতপাল সিং-এর কথা বলা হয়েছে সেই অমৃতপাল সিং আজ নিজেকে ভিন্দ্রানওয়ালের অনুগামী হিসেবে দাবি করছেন। কিন্তু কে এই ভিন্দ্রানওয়ালে? তাঁর প্রকৃত নাম জারনেইল সিং ব্রার, কট্টর শিখপন্থী দল দামদামি তাস্কাল দলের প্রধান। জারনেইলের গ্রাম ছিলো ভিন্দার গ্রাম সেখান থেকেই তিনি ভিন্দ্রানওয়ালে নামে পরিচিতি লাভ করেন। গোটা পাঞ্জাবে তিনি প্রচার করতে শুরু করেন শিখ ধর্ম অনুসারে সামগ্রিক জীবনযাত্রার কথা। এভাবে শিখদের মধ্যে ভিন্দ্রানওয়ালে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি আর একটি কারণ ছিল পাঞ্জাবের জাতপাতের সমস্যা। দেশের সামনে পাঞ্জাবকে তুলে ধরার দায়িত্ব এতদিন ছিলো আকালি দলের হাতে। এই দলের বেশির ভাগ নেতাই জাঠ ও বানিয়া সম্প্রদায়ের। রাজ্যের ৭০% জমি এদেরই দখলে। যদিও ভিন্দ্রানওয়ালে নিজেও জাঠ, কিন্তু জাতপাতের উর্ধ্বে উঠে শিখ ঐক্যের প্রচার করার ফলে মানুষ ভিন্দ্রানওয়ালের উপর আস্থা রাখতে শুরু করে। জাত-পাত পাঞ্জাবের একটা বড় সমস্যা। রামরহিমের খবরের মধ্যে দিয়ে ডেরা সাচ্চা সওদার কথা জেনেছিল দেশবাসী। এই ধরণের ডেরাগুলোর জন্মই শিখদের জাতপাত সমস্যা থেকে। সে অন্য প্রসঙ্গ।

ভিন্দ্রানওয়ালেকে ইন্দিরা গান্ধীর মদত

ফেরা যাক ভিন্দ্রানওয়ালের কথায়। ভিন্দ্রানওয়ালেই খালসার কথা পুনরায় তুলে আনেন। সেসময় পাঞ্জাবের অল্পবয়সীরা নেশায় ডুবে থাকত। তেমন কোনো সামাজিক দিশা নতুন প্রজন্মের কাছে ছিলো না। এই প্রজন্মকে দলে টানার কাজ সহজ হয়েছিলো নানা প্রলোভনের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে ভিন্দ্রানওয়ালে বারবার নেশামুক্তির কথা বলতেন যাতে অল্পবয়সীদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের লোকজন-ও ভিন্দ্রানওয়ালের উপর আস্থা রাখতে শুরু করে। মানুষের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানোর কাজে যে সবচেয়ে সহজে সবথেকে বেশি জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় তা ভিন্দ্রানওয়ালে বুঝেছিলন। তিনি সাধারণ মানুষকে বোঝাতে শুরু করেন, শিখদের সমস্যার প্রধান কারণ হিন্দুরা। প্রতি শিখের উচিত ৩২ জন করে হিন্দুকে নিধন করা। রাজনৈতিক স্বার্থে এই কট্টরপন্থী শিখ ভিন্দ্রানওয়ালেকে মদত দিতে শুরু করেন ইন্দিরা গান্ধী। পরবর্তীতে আকালি দলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস থেকে ভোটেও দাঁড়ান ভিন্দ্রানওয়ালে। ধীরে ধীরে ভিন্দ্রানওয়ালের ক্ষমতা হয়ে ওঠে অপরিসীম। নানা ভয়ানক অনৈতিক কাজকর্ম করলেও কেন্দ্রের জনতা সরকার চুপ থাকে। সাধারণ পাঞ্জাবিদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায় ভিন্দ্রানওয়ালের মতো শক্তিশালী নেতা আর কেউ নেই। ভিন্দ্রানওয়ালে তাঁর অনুগামীদের ৭৮সালের ১৩ই এপ্রিল নিরঙ্কারী শিখদের সঙ্গে লড়াইয়ে লেলিয়ে দেন। বাবা গুরু চরণ সিং নিহত হন ভিন্দ্রানওয়ালে অনুগামীদের হাতে। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে পাঞ্জাবে ভিন্দ্রানওয়ালের দাপট বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে নিজেদের খোয়াখুয়িতে কেন্দ্রে জনতা সরকারের পতন ঘটে। ১৯৮০-র জানুয়ারিতে লোকসভার মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে  দিল্লির তখতে ফেরেন ইন্দিরা গান্ধী।

জনতা সরকারকে বিপাকে ফেলতে ইন্দিরা গান্ধী ভিন্দ্রানওয়ালেকে মদত দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ফটো প্রতীকি ও সংগৃহীত

১৯৮১-র জনগণনাকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাবে হিন্দু-শিখ ঝামেলা পাকিয়ে ওঠে। আর্য সমাজীদের নেতা, হিন্দুত্ববাদী, শিখ-বিদ্বেষী এবং হিন্দ সমাচার, পাঞ্জাব কেশরী প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদক লালা জগত নারায়ণ প্রচার করতে শুরু করেন, জনগণনার সময় সবাই যেন মাতৃভাষা হিন্দি বলে যা যা শিখদের একেবারেই পছন্দ হয় নি। ভিন্দ্রানওয়ালে এই সুযোগকে কাজে লাগান আরও বেশি জনপ্রিয় হবার লক্ষ্যে। লালা জগত নারায়ণ শেঠকে খুন হয়ে যান ভিন্দ্রানওয়ালের অনুগামীদের হাতে। কেন্দ্রে তখন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে আর চুপ থাকা সম্ভব হল না। কারণ, লালা জগত নারায়ণ শেঠের মৃত্যুতে আর্য সমাজী হিন্দুরা আবার খেপে যায়। গ্রেফতার করা হয় ভিন্দ্রানওয়ালেকে। গ্রেফতারির সময় ভিন্দ্রানওয়ালে মেহতাচক গুরুদোয়ারায় ছিলেন। পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার আগে গুরুদোয়ারার বাইরে থাকা জনতার উদ্দেশ্যে উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেন। যাতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা পাঞ্জাবে। জনতা এতটাই ক্ষুব্ধ হয় যে পুলিশ ভিন্দ্রানওয়ালেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পর ১৯৮২ সালে পাঞ্জাবে শুরু হয়  আকালি ভিন্দ্রানওয়ালের যৌথ ধর্মযুদ্ধ । যা “দাল খালসা” নামে পরিচিত। এই ধর্মযুদ্ধে প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো অনন্তপুর সাহিব রেজোলিউশনকে যে কোন‌ও মূল্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির উপর চাপ সৃষ্টি করে পাশ করানো। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য ছিল, এই সংকল্প ভারতের সংবিধানের বিরোধী, তাই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আকালি ও ভিন্দ্রানওয়ালের “ধর্মযুদ্ধ”-কে আটকানোর প্রয়াস শুরু করে দেন তিনি। ধর্মযুদ্ধের নামে ভিন্দ্রানওয়ালে লোকজন পাঞ্জাবে খুন বোমাবাজি শুরু করে দেয়। ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে খালসা বাহিনীর সঙ্গে অ-শিখদের দাঙ্গা বেঁধে যায় যাতে বেশ কিছু মানুষ মারা যায়। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ৩৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২রা অক্টোবর ‘ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ খালসা’ এবং ‘দাল খালসা’ দুই সংগঠনকেই নিষিদ্ধ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। শুরু হয় ধর-পাকড়।

অপারেশন ব্লুস্টারের জের গড়াল বহুদূর

পাঞ্জাবে খালিস্তানি আন্দোলনের জন্য ১৯৮২ সালের প্রায় প্রতিটা দিনই গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্দ্রানওয়ালের লোকজন নিত্য নতুন ঘটনার মধ্যে দিয়ে দেশের শান্তিকে বিঘ্নিত করতেই থাকে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর উপর হামলা, প্লেন হাইজ্যাক ইত্যাদি চলছিল। এসবের মধ্যেই বিরাশির নভেম্বরে দিল্লিতে এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল সরকার। এশিয়ান গেমস চলা কালে সারা পৃথিবীর কাছে তাদের দাবিকে প্রচাল করার সিদ্ধান্ত নেয় আকালি-ভিন্দ্রানওয়ালে ধর্মযুদ্ধ মোর্চা। ইন্দিরা গান্ধির সরকার সেটাকে আটকানোর সবরকম প্রচেষ্টা করে। দিল্লির দিকে আসা সমস্ত গাড়ি থেকে শিখদের নামিয়ে তল্লাশি নেওয়া শুরু হয়। ভিন্দ্রানওয়ালে ও তার অনুগামীদের কর্মকাণ্ড হিন্দুদের আতঙ্কিত করে তেলে। এরই মাঝে সেনাবাহিনীতে থাকা শিখদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু হয়। অপরদিকে ভিন্দ্রানওয়ালের দল আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। অস্ত্র আমদানি, ব্যাঙ্ক ডাকাতি ইত্যাদি ঘটনা চলছিলই। ১৯৮৩ সালের ৫ই অক্টোবর  একটি বাসকে দাঁড় করিয়ে  যাত্রীদের নামিয়ে বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করে ভিন্দ্রানওয়ালের লোকজন। এই ঘটনায় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুন। পরের দিনই রাষ্ট্রপতি শাসন চালু হয়ে যায় পাঞ্জাব জুড়ে। ভিন্দ্রানওয়ালে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে লুকিয়ে পড়েন এবং সেখান থেকেই অনুগামীদের নির্দেশ দিতে থাকেন। পাঞ্জাবের নানা জায়গায় নানা হামলা হতে থাকে। সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হতে শুরু করে। পাঞ্জাবের ভেতরে আক্রান্ত হতে থাকে মূলত হিন্দুরা। এছাড়া এমপি, এমএলএ এবং পুলিশ। পাঞ্জাবের বাইরে আক্রান্ত হতে থাকে শিখরা। সারা দেশজুড়ে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হলে ভিন্দ্রানওয়ালেকে নির্মমভাবে দমন করা ইন্দিরা সরকারের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। যার ফল অপারেশন ব্লুস্টার শুরু হয় ১৯৮৪ ১লা জুন।

অপারেশন ব্লুস্টার: সেনা অভিযানের জেরে বিধ্বস্ত অমৃতসর স্বর্ণ মন্দির চত্বর। ফটো- আর্কাইভস।

ভারতীয় সেনা স্বর্ণমন্দিরের ভেতর ঢুকে ভিন্দ্রানওয়ালেকে হত্যা করে। এই অপারেশন সহজ ছিল না। গ্রেনেড ব্যবহারের কারণে মন্দির ভীষণরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সরকারি হিসাবে ৫০০-র উপর সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়। যদিও সংখ্যাটা অনেক বেশি বেসরকারি মতে। অপারেশনের দিন নির্বাচন ঠিক ছিল না বলে অনেকে মনে করেন। কারণ ওই সময়েই শিখদের পঞ্চম গুরু অর্জন দেবের শহিদ দিবস উদযাপন চলছিল স্বর্ণ মন্দিরে। তাই জনসমাগম অনেক বেশি ছিল। ফলে সেনা অভিযানে নির্দোষ বহু পুণ্যার্থীও মারা যান। এই কারণে এবং ভগ্নপ্রায় স্বর্ণমন্দিরকে দেখে ভিন্দ্রানওয়ালের সমর্থক নয় এমন বহু শিখের মধ্যেও ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। ৪০০০ শিখ সেনা চাকরি ছাড়েন। এই সময় কিছু শিখ সৈন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করে এমনকি অফিসারদের খুন পর্যন্ত করে। অমৃন্দর সিং এর মতো কংগ্রেস নেতা ইস্তফা দেন, লেখক খুশবন্ত সিং ভারত সরকারের দেওয়া পুরস্কার ত্যাগ করেন। স্বর্ণমন্দিরের দুরাবস্থা দেখে শিখরা ক্ষুব্ধ হন, সন্দেহ নেই। এবং ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডে সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে। সতবন্ত সিং এবং বিয়ন্ত সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর দেহরক্ষী। ৩১ তারিখ ১৯৮৪। সকাল সাড়ে নটা। দেহরক্ষীদের ১৮টি গুলি ইন্দিরা গান্ধীর শরীরকে ঝাঁঝরা করে দেয়।

শিখ নিধন, শিখ অস্মিতায় আঘাত ও খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদ

এই ঘটনার পর শুরু হয় শিখ নিধন। ২৮০০ শিখকে মারা হয় কেবল দিল্লিতেই। দেশজুড়ে ৮০০০ এর উপর শিখ নিধন করা হয় এ’সময়। দিল্লিতে ও দেশের অন্যত্র কংগ্রেসের অনেক নেতা শিখ হত্যায় প্ররোচনা দেন বলে অভিযোগ। পুলিশও নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয়। স্বর্ণমন্দিরের উপর হামলা, দিল্লির সাধারণ শিখ হত্যা ইত্যাদি বিষয়ের কারণে ভিন্দ্রানওয়ালে মারা গেলেও তার মতাদর্শ শিখ সমাজের অনেকাংশে গেঁথে বসে আছে আজও। ভিন্দ্রানওয়ালে তাদের চোখে স্বাধীনতা সংগ্রামী। ২০০৩ সালে আকালতক্ত ভিন্দ্রানওয়ালেকে শহীদ ঘোষণা করে। 

ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার জেরে শিখ নিধন। দাঙ্গায় দিল্লি সহ সারা দেশে আট হাজার শিখের মৃত্যু। ফটো ক্রেডিট- এএফপি

ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যুর পরেও পৃথক শিখ রাষ্ট্রের দাবিতে খালিস্তানপন্থীরা ভারতে ও ভারতের বাইরে একাধিক আক্রমণ করেছে গত চার দশকে। ১৯৮৫ সালের জুন মাসে খালিস্তানী জঙ্গিরা একটা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানকে উড়িয়ে দেয় যাতে ৩২৯ জন মারা যায়। এই ঘটনাকে তারা ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে ঘোষণা করে। পাঞ্জাবে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৯৮৫ সালের ২৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও আকালি দলের নেতা হরচাঁদ সিং লঙ্গোয়ালের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তা হিংসার অবসান ঘটাতে ব্যর্থ হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের এক মাসের মধ্যে লঙ্গোয়াল নিজেই শিখ জঙ্গিদের হাতে খুন হয়ে যান। অপারেশন ব্লস্টারের নেতৃত্ব দেওয়া অরুণ সিং বৈদ্য খুন হন ১৯৮৬ সালের আগস্ট মাসে। ১৯৯৫ সালে খালিস্তানীদের হাতে খুন হন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী বিয়ন্ত সিং। এরপরই শুরু হয় খালিস্তানীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের আরও কঠোর দমননীতি। দমননীতির ফলে শিখ উগ্রপন্থা নির্মূল হয়। সাধারণ শিখ সম্প্রদায়ের মানুষও উগ্রপন্থায় আস্থা হারায় এবং  সরকার থেকে প্রাপ্ত নানা সুবিধার কারণে খালিস্তানিদের বিরুদ্ধে চলে যায়। অনেকে মনে করেন ২০০৪ সালে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করা একপ্রকার শিখদের খুশি করার প্রয়াস।

ছাই চাপা আগুন উস্কে দিল কে?

যাইহোক মোদ্দাকথা খালিস্তানিরা হয় দেশের মধ্যে শান্ত হয়, নয়তো দেশ ছেড়ে পালায়। দেশের বাইরে আন্দোলন শুরু করে। খালিস্তানী আন্দোলন আগে লাহোর থেকে পরিচালিত হত। এরপর ইউরোপের নানা দেশ এবং আমেরিকা-কানাডা থেকে শুরু হয়। কিন্তু ভারতে শান্তি বজায় থাকে। খালিস্তানীদের উপদ্রব ভারতের মধ্যে দেখা যায় না। যা কিছু আন্দোলন ভারতের বাইরেই ঘটতে থাকে। ২০১৪ সাল। ভারতের রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আসে। হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসে। উগ্রহিন্দুত্ববাদীদের নানা প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। বৈচিত্র্যময় ভারতে সর্বত্র জোর করে গোবলয়ের রাম হনুমানের প্রচার, নানা জায়গার মাছ, মাংসের দোকান বন্ধ করার খবর আসতে শুরু করে। ২০১৫ সালে পয়লা জুন পাঞ্জাবে ঘটে যায় একটি ঘটনা। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা শিখদের টার্গেট করে তাদের ধর্মকে আঘাত করতে একটি গুরুদোয়ারা থেকে  শিখ ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহিব’ চুরি করে এবং তা ছিঁড়ে চারপাশে ছড়িয়ে দেয় বলে অভিযোগ। শুরু হয় প্রতিবাদ পাঞ্জাব জুড়ে। অনুরূপভাবে গ্রন্থসাহিব অবমাননার ঘটনা পাঞ্জাবের আরও কিছু জায়গায় ঘটেছিল এই সময়। এর প্রতিবাদে ৬০০০ মানুষ কোটকাপুরায় সমবেত হয়ে ধর্ণায় বসেছিল। পুলিশ সেই জমায়েতের উপর বিনা প্ররোচনাতে লাঠি চালায় এবং তারপর গুলি চলে। দুজন মারা যায় এবং পঞ্চাশ জনের বেশি আহত হয়। পাঁচশ জনের বেশি শিখ আন্দোলনকারীকে পুলিশ আটক করে। কিন্তু কেন্দ্রে মোদি সরকার ও পাঞ্জাবে আকালি বিজেপি জোট সরকার হিন্দুত্ববাদী ঝঞ্ঝাটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। একদা কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা কংগ্রেস শিখ ধর্মকে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে একাত্ম করে দেখতে চেয়ে ভুল করেছিল বলে মনে করেন শিখ সম্প্রদায়ের অনেকেই, শিখদের স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা তাঁরা ভাল চোখে দেখেন না। মোদির অনুগামীরা শিখদের স্বাতন্ত্র্যকে হিন্দু বিরোধী শক্তি হিসাবে গণ্য করেও ভুল করেছে বলেই শিখ সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের অভিযোগ। ভারতের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন সেনাবাহিনী ইত্যাদিতে শিখদের অবদানকে অস্বীকার করে কেবল হিন্দু বিরোধী বা ভারত বিরোধী হিসাবে দেখার মানসিকতা বোকামির‌ই লক্ষণ।

মোদী সরকারের কৃষি আইনের প্রতিবাদে কৃষকদের বিক্ষোভ। বিক্ষোভে সবথেকে বেশি উত্তাল ছিল পাঞ্জাব। ফটো ক্রেডিট- এএফপি

এক দেশ এক নীতিতে পক্ষপাতী মোদী সরকার আঞ্চলিক ধর্ম বিশ্বাস, আঞ্চলিক রাজনীতি, আঞ্চলিক দলকে দমিয়ে রাখতে উদ্যোগী। স্বাভাবিকভাবেই ভাষার কারণে দক্ষিণ ভারতে, ধর্মের কারণে কাশ্মীর, পাঞ্জাবে কট্টরবাদীরা জেগে উঠেছে। এরই মধ্যে মোদী দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন ২০১৯-এ আরও বেশি শক্তি নিয়ে। ২০২০-এ সারা বিশ্ব আক্রান্ত হয় করোনায়, দেশে শুরু হয় লকডাউন, জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এই সময়টাকে মোদী সরকার কাজে লাগিয়ে পাশ করায় কৃষি বিল। যার প্রধান বক্তব্য ‘এক দেশ এক বাজার’। ভারতের অন্যত্র এই বিলের বিরোধিতা সেভাবে না হলেও গর্জে ওঠে পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরা। “কিষাণ বাচাও মাণ্ডি বাচাও” স্লোগানের মধ্যে দিয়ে দুই রাজ্যে আন্দোলন শুরু হয়। কৃষি বিল যে কোনোভাবেই কৃষকের স্বার্থে তৈরি হয়নি তা সামনে চলে আসা এবং লকডাউনকে উপেক্ষা করে জনপ্রতিরোধ গড়ে ওঠা – এই দুই বিষয়ই বাধ্য করে কেন্দ্র সরকারকে কৃষি বিল প্রত্যাহার করতে।

দীপ সিধু থেকে অমৃতপাল সিং সান্ধু

এই কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দুটি নাম উঠে আসে। প্রথম জন হল দীপ সিধু  আর দ্বিতীয় জন হলো অমৃতপাল সিং সান্ধু। কৃষক আন্দোলন যখন চলছে অমৃতপাল তখন দুবাই-এ। দীপ সিধু তার কিছু আগেই অভিনয় জগতের পাশাপাশি রাজনীতির ময়দানে নেমেছেন। প্রথমে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী সানি দেওলের হয়ে প্রচার করেন ২০১৯ সালে। কিন্তু কৃষি বিল আসার পর প্রতিবাদী মঞ্চ থেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিতে শুরু করেন। পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করে  সমগ্র পাঞ্জাবিদের উপর বঞ্চনার কাহিনী নতুন করে তুলে ধরে, বেকারিত্ব ইত্যাদির কথা বলে যুব সম্প্রদায়কে পুনরায় ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলেন। এই করেই যুবসম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতা মেনে দীপ সিধুর হাত ধরে ফিরে আসে খালিস্তানের দাবি।

ওয়ারিস পাঞ্জাব দে-র প্রতিষ্ঠাতা দীপ সিধু; কৃষক বিক্ষোভের সময় লালকেল্লায় খালিস্তানি পতাকা উড়িয়ে ছিলেন। ফটো- সংগৃহীত

২০২১ সালের ২৬ শে জানুয়ারি লালকেল্লার সামনে কৃষক ইউনিয়ন প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেয়। এ’সময়ই দীপ সিধু খালিস্তানের দাবি নিয়ে  দলবলের  সঙ্গে সেখানে যায়। এরপরের ঘটনা সকলেরই জানা। লালকেল্লার উপর থেকে ভারতের পতাকা খুলে খালিস্তানের পতাকা উড়িয়ে দেন দীপ সিধু। ঘটনাটা কিছু সময়ের জন্য কৃষক আন্দোলনকে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। বিজেপি প্রচার শুরু করে কৃষক আন্দোলনের মূল লক্ষ্য খালিস্তানের দাবি। কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সকলেই দেশদ্রোহী। কিন্তু বিজেপির এই প্রচার সোশাল মিডিয়ার কারণে বুমেরাং হয়ে যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে দিপ সিধু বিজেপির হয়ে ২০১৯ সালে প্রচার করে। সেই সব ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়। বিজেপির বিরোধী শক্তি প্রচার করতে সক্ষম হয় দীপ সিধু বিজেপিরই লোক। বিজেপির হয়ে কৃষক আন্দোলনের মুখ পোড়াতে খালিস্তানের পতাকা উড়িয়েছে। উনিশ সালের ভিডিওর ফলে এই দাবি সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।  আরও বেশি করে মানুষ কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত নভেম্বর মাসে সেই কৃষি আইন প্রত্যাহার করা হয়। এই পুরো ঘটনার মধ্যে দুটি বিষয় ঘটে- এক, দীপ সিধুর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, দুই, সোশাল মিডিয়ায় খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অমৃতপাল সিং। দুবাই থেকে নানা ভিডিও, অডিওর মাধ্যমে পাঞ্জাবের যুবকদের মগজ ধোলাই চালাতে থাকেন তিনি।

গাড়ি দুর্ঘটনায় দীপ সিধুর মৃত্যুর পর ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে-র দায়িত্ব নেন অমৃতপাল সিং সান্ধু। ফটো ক্রেডিট- টিওআই

দীপ সিধুর অডিও রুমেও অমৃতপালের বক্তব্য ভীষণ জনপ্রিয় হতে শুরু করলে দীপ সিধু অমৃতপালকে ব্লক করে দেন। দ্রুত ঘটে চলেছিল এই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ। দীপ সিধু “ওয়ারিস পাঞ্জাব দে” ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শিখদের কন্ঠস্বর হয়ে উঠছছিলেন। হঠাৎ ১৫ই ফেব্রুয়ারী ২০২২ পথ দূর্ঘটনায় মারা যায় দীপ সিধু। আশ্চর্যজনকভাবে ৪ঠা মার্চ একটি ফেসবুক পেজ থেকে ‘ওয়ারিস পাঞ্জাব দে’ সংস্থার প্রধান হিসাবে অমৃতপালের নাম ঘোষণা করা হয়। আগষ্টের আগে অবধি অনলাইনেই অমৃতপাল প্রচার চালান। অবশেষে আগস্ট ২০২২-এ দুবাই থেকে ভারতে আসেন। প্রসঙ্গত বলা দরকার, দুবাইতে থাকাকালীন অমৃতপাল পাগড়ি বা দাড়ি কিছুই রাখতেন না, পাশ্চাত্য আদব কায়দায় ঘুরে বেড়াতেন এবং সোশাল মিডিয়ায় সেভাবেই হাজির হতেন কিন্তু ভারতে ফিরলেন ভোল বদলে পাগড়ি এবং দাড়ি সহযোগে।

ভিন্দ্রানওয়ালে-টু হতে চাইছেন অমৃতপাল?

অমৃতপাল সেপ্টেম্বরে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন যাতে প্রচুর জনসমাগম হয়। তা থেকে নিজের জনপ্রিয়তা অনুধাবন করে নিজেকে দ্বিতীয় ভিন্দ্রানওয়ালে হিসাবে তুলে ধরতে উদ্যোগী হন। খালিস্তানের জন্য গলা ফাটাতে শুরু করেন। অমৃতপাল সাধারণ মানুষকে বোঝাতে শুরু করেন যে শিখরা বছরের পর বছর দাসত্ব করেছে। প্রথমে ইংরেজদের, এখন করছে হিন্দুদের। সময় এসেছে স্বাধীনতা আদায় করার। পাশাপাশি আনন্দপুর সাহিব সংকল্পকে এমনভাবে তুলে ধরেন যেন সেই সংকল্পের প্রধান দাবিই ছিলো খালিস্তান। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকেই নানা স্থানে ‘অমৃত’ উৎসব পালন শুরু করেন। পাশাপাশি ‘ঘর বাপসি’ অনুষ্ঠান-ও শুরু করে ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’। আগেই বলেছি, পাঞ্জাবে জাত-পাত একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যার কারণে অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গেছিল। অমৃতপাল সিং তাদের  শিখ ধর্মে ফিরিয়ে আনেন। যাকে অমৃতপাল খালসার পথে ফিরিয়ে আনা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি পাঞ্জাবে ড্রাগ একটা বড়ো সমস্যা। নেশার বিরুদ্ধেও লড়াই-এ নামেন অমৃতপাল। তাঁর কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে ভিন্দ্রানওয়ালের কাজ কর্মের কপি-পেস্ট বলে মনে হবে। কেবল কাজে নয় সাজ পোশাকেও ভিন্দ্রানওয়ালেকে অনুকরণ শুরু করেন অমৃতপাল। মাথায় পাগড়ি, গায়ে আলখাল্লা এবং হাতে তীরের পাশাপাশি আগ্নেয় অস্ত্র।

সশস্ত্র অনুসারীদের সঙ্গে অমৃতপাল সিং সান্ধু। দ্বিতীয় ভিন্দ্রানওয়ালে হয়ে উঠতে চাইছেন অমৃতপাল? ফটো- সংগৃহীত

বাইশ সালের অক্টোবর মাসে অমৃতপাল খ্রিষ্টান ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেন। ফলে খ্রিষ্টানদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। অমৃতপালের বিরুদ্ধে FIR করতে গেলেও শেষ পর্যন্ত করা হয় না। নভেম্বরে শিব সেনার সমর্থক সুধীর সুরীকে হত্যা করে অমৃতপালের লোক। ৯ই ডিসেম্বর এবং ১৩ই ডিসেম্বর দুটি গুরুদোয়ারা ভেঙে ফেলে ধর্ম ঠিকঠাক পালন হচ্ছে না এই দাবিতে। তবে মূল সমস্যা শুরু হয় ১৫ই ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ থেকে। ঠিক একবছর পূর্ণ হয় দীপ সিধুর মৃত্যুর। ফেসবুকে ভারত বিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী পোস্ট দেন অমৃতপাল। এজন্য অমৃতলালের ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের অ্যাকাউন্ট ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাসপেণ্ড করা হয়। এই মাসেই কিডন্যাপিং-এর কেসে অমৃতপাল এবং তার ছয় সঙ্গীর নামে FIR হয়। অমৃতপাল সিং এর সঙ্গী লাভপ্রীত সিং তুফান গ্রেফতার হন। অমৃতপাল নিজের মাথায় গ্রন্থসাহিব রেখে অজস্র ভক্তকে নিয়ে আজনালা থানা ঘেরাও করেন। পুলিশ বাধ্য হয় লাভপ্রীতকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু এই থানা আক্রমণে বেশ কিছু পুলিশ আহত হয়। এরপর অমৃতপাল “ফলস কেস”এর নাম করে ওয়ারিস পাঞ্জাব দের সমর্থকদের উসকে দেয়। পাঞ্জাবের পাশাপাশি পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। সর্বত্র খালিস্তানের দাবিই মুখ্য হয়ে ওঠে। সারা রাজ্যে সন্ত্রাসের পরিবেশ পুনরায় তৈরী হয়। পুলিশও অমৃতপালের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। আশির দশক, নব্বইএর দশকের ভয়ানক দিন যাতে ফিরে না আসে,  ভিন্দ্রানওয়ালে-টু হয়ে ওঠার আগেই অমৃতপালের গ্রেফতারির দাবি জোরালো হয়। ১৮ই মার্চ পাঞ্জাব পুলিশের গাড়ি নাটকীয়ভাবে ধাওয়া করে অমৃতপালের গাড়ি। কিন্তু শেষপর্যন্ত ধরতে ব্যর্থ হয়। ২৩শে মার্চ, ২০২৩ তারিখে অমৃতপাল পাঞ্জাব পুলিশের চোখে নিঁখোজ এবং ‘ফেরার’ হিসাবে ঘোষনা করা হয়েছে। অমৃতপাল কোথায় তা সময়ই বলবে। ‘ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে’-র সদস্যদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

খালিস্তানের দাবিতে বার বার কেন উত্তপ্ত হয় পাঞ্জাব?

সমস্ত ইতিহাসের পর একটা প্রশ্ন না উঠলেই নয়। বারবার পাঞ্জাবে খালিস্তান নামক আলাদা দেশের দাবি কেন ওঠে এবং সেই দাবি শেষপর্যন্ত হিংসার রূপ কেন নেয়? এখানেই চলে আসে আন্তর্জাতিক রাজনীতি। খালিস্তানীদের মদত দেওয়া, ব্রেন ওয়াস করা এবং অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দেওয়ায় পশ্চিমের দেশের পাশাপাশি পাকিস্তান জড়িয়ে আছে গোড়া থেকেই। পাকিস্তান থেকে আসা শিখদের সঙ্গে প্রথম দিকে কেন্দ্র সরকার যে ভেদাভেদ করেনি তা নয়। পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দুরা শিখদের থেকে অনেক বেশি সুবিধা পেয়েছে। ক্ষোভের শুরু তখন থেকে। যখন কেউ একবার বঞ্চনার শিকার হয় তখন সারাজীবন ধরেই নিজেকে বঞ্চিত ভাবতে থাকে। সেটাকেই কাজে লাগায় পাকিস্তান ও পশ্চিমের কিছু দেশ। ভারতের ভেতরকার শান্তি বিঘ্নিত হোক তা সবসময়ই চায় এই দেশগুলির সরকার। বিশ্বের দরবারে ভারত যাতে মাথা না তুলতে পারে সে ব্যাপারেও তাদের আগ্রহ আছে। নানা প্রলোভনের ফাঁদে যুব সম্প্রদায় সহজেই পা দেয়। খালিস্তানি আন্দোলনও এমন একটা বিষয়। পাঞ্জাব প্রদেশের ৬৬% ভূমি পাকিস্তানের হাতে চলে যাওয়া সত্বেও যত আন্দোলন যখন ভারতের বিরুদ্ধেই হয়,  তখন খালি চোখেই বোঝা যায় আন্দোলনকারী ও তাদের মদতদাতাদের আসল অভিপ্রায়। নব্বুই-এর দশকে খলিস্তানি আন্দোলনের উপর বেশ কিছু গবেষণা হয় তার ফল যা সামনে আসে তা হলো মোহ। খালিস্তানি আন্দোলনে যুক্ত হলে বাইক ও আগ্নেয় অস্ত্র পাওয়া যায় এমন একটা আশা থেকেই যুব সম্প্রদায় আকৃষ্ট হয়। খালিস্তান বা খালসা নিয়ে শিখ আবেগ তো আছেই। উপরন্তু পাঞ্জাবের বেকারত্ব চরম, ফলে অল্প অর্থের বিনিময়েই যুব সম্প্রদায়কে দলে টানা যায়।

খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি পাকিস্তানের তো মদত আছেই এমনকি পশ্চিমী দেশের বিভিন্ন সংস্থাও খালিস্তানিদের মদত দেয়। ছবি- সংগৃহীত

খালিস্তানি আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে পাকিস্তানের দু’রকম লাভ। প্রথমত, ভারতে অশান্তি তৈরি করা যায় দ্বিতীয়ত, আন্দোলনকারীদের কাছে অস্ত্র বেচা যায়। তবে কেবল বেকারত্ব নয় পাঞ্জাবের জাতপাত সমস্যাও বারে বারে খালিস্তান ইস্যুর জন্ম দেয়। পাঞ্জাবের কাস্ট পিরামিডের সবচেয়ে উপরে আছে জাঠ শিখ। যারা পাঞ্জাবের অধিকাংশ জমির মালিক কিন্তু মোট জনসংখ্যার ২১-২৫% জাঠ। আর প্রায় ৩২% তপসিলি। জাঠেদের অত্যাচার এবং প্রতারণা, জাতপাতের সমস্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। অথচ মূল গ্রন্থসাহিবে জাতিভেদ না মানার কথা বলা আছে। তাই নিম্নবর্গীয় মানুষ স্বপ্ন দেখে খালিস্তান হলে তার নিয়ম কানুন গ্রন্থসাহিব অনুসারে হবে তাহলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব হবে। ভারতে থাকার কারণে উত্তরভারতীয় হিন্দুদের বর্ণপ্রথার কুফল শিখ হয়েও ভোগ করতে হচ্ছে। এর পাশাপাশি পাঞ্জাবের বড় সমস্যা ড্রাগের নেশা। অথচ শিখ ধর্ম গ্রন্থে যেকোনো নেশা থেকে দূরে থাকার কথা আছে। অনেকেই মনে করে পাঞ্জাবে যুব সমাজে নেশা করার সমস্যাকে ভারতীয় প্রশাসন যথেষ্ট কড়া ভাবে দমন করে না। চাকরিহীন যুব সম্প্রদায়কে আরও বেশি করে নেশার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে চায় যাতে তারা প্রশ্ন করতে ভুলে যায়। খালিস্তানে যেহেতু শিখ ধর্ম অনুযায়ী নিয়ম কানুন তৈরী হবে, একটি নেশা মুক্ত দেশ তারা পেতে পারে। বর্তমানে এসবের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া, সরকারি পদে উত্তরপ্রদেশ, বিহারের লোকজনের আধিক্যর মতো বিষয়।

খালিস্তান শিখদের সমস্যার কোনও সমাধান নয়

খালিস্তান পেলেই কি শিখদের সমস্যা মিটবে? উত্তর একটাই সেটা হলো মিটবে না। পাঞ্জাবের প্রধান আয় কৃষিকাজ থেকে। ফসল বিক্রির বাজার গোটা ভারত, আলাদা হলে সেই বাজার নষ্ট হবে। শিল্প সেই অর্থে পাঞ্জাবে নেই। পাঞ্জাবের অধিকাংশ ভূখণ্ড জাঠদের হাতে। খালিস্তান হলেও সেটা একই থাকবে। ফলে অর্থের দিক থেকে এবং জাতের দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটার সম্ভাবনা নেই। এই প্রসঙ্গে আর একটি প্রবন্ধ তৈরি হয়ে যেতে পারে,’ কৃষি বিপ্লব আশীর্বাদ না অভিশাপ’ এই টপিকের উপর। আশীর্বাদের যদি কিছু থাকে তা সারা ভারত ভোগ করেছে। এখন সময় এসেছে অভিশাপ ভোগ করার। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে,  অতিরিক্ত কীটনাশক, রাসায়নিক সার পাঞ্জাবের মাটিকে আর কিছু বছরের মধ্যে বন্ধ্যা করে তুলবে। কৃষির প্রয়োজনে মাটির তলার জল প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। পাশাপাশি সবুজবিপ্লব প্রায় প্রতি কৃষক পরিবারকে উপহার দিয়েছে ক্যান্সার রোগী। পাঞ্জাবের চিকিৎসা ব্যবস্থাও খুব আশাপ্রদ নয়। তাই এই সমস্ত ক্যান্সার রোগির ঠিকানা রাজস্থানের বিকানের। বর্তমানে পাঞ্জাব থেকে একটি ট্রেন যায় রাজস্থানের যোধপুর পর্যন্ত যার নাম আবোহার যোধপুর এক্সপ্রেস। অথচ লোকের মুখে মুখে ট্রেনটির নামই হয়ে গেছে ক্যান্সার এক্সপ্রেস। আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি খালিস্তান নামক দেশের জন্ম হয় তবে এই অভিশাপ নিয়েই যাত্রা শুরু করতে হবে।

শিখ আবেগকে ছোট না করেই বলা দরকার, খালিস্তান নামে ম্যাজিক সমাধানের বাইরে বেরিয়ে ভাবতে হবে শিখদের। বর্তমান পাঞ্জাব এবং সারা ভারত যেহেতু অমৃতপাল সিং সান্ধুর “ওয়ারিশ পাঞ্জাব দে” নিয়েই আলোচনা করছে তাই লেখাটির অনেকটা জুড়েই স্থান পেয়েছে অমৃতপাল। কিন্তু খালিস্তানি আন্দোলনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। অমৃতপালকে দিয়ে সেটা শুরু হয়নি, অমৃতপালকে দিয়ে শেষও হবে বলে মনে হয় না। সে আলোচনা পরে কখনও করা যাবে।

Fature Image is Representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *