চুরির মধ্যে সবথেকে গৌরবের বই চুরি। পরের বই চুরি করে কিংবা বন্ধুর বই মেরে দিয়ে কেউ কখনও অপরাধবোধে ভোগে না। বই নিয়ে আরও যা বকবক করলেন উত্তম দেব-
কলকাতায় আন্তর্জাতিক বইমেলা চলছে। ঢাকাতে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। দুই বাংলাতেই বইমেলা শুরু হলে বইপ্রেমী, বই লিখিয়ে ও বই প্রকাশকদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। বাংলা ভাষায় শুধু বই লিখেই গ্রাসাচ্ছাদনের সুব্যবস্থা ও ভালভাবে সংসার প্রতিপালন করতে হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কেউ সফল হয়েছেন বলে মনে হয় না। সাহিত্যে পসার জমার পর অধ্যাপনার চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম জীবনে চরম দুঃখকষ্ট সয়ে পরে অবশ্য লেখালেখি দ্বারাই সংসারে খানিকটা স্বাচ্ছল্য এনেছিলেন। বই লিখে মৃত্যুর পর খ্যাতি জুটলেও জীবদ্দশায় যাঁর দুঃখকষ্ট ছাড়া আর কিছুই জোটে নি, তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শিবরাম চক্রবর্তী অবশ্য সহাস্যে সব যন্ত্রণা সহ্য করে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেসবাড়িতে তক্তাপোশে বসেই বই লিখে বাঙালিকে আমৃত্যু হাসিয়ে গেছেন। কলকাতার সরকারবাবুরা তাঁদের হাউসে পাকা চাকরির ব্যবস্থা না করে দিলে বাংলার বহু বিখ্যাত কবিসাহিত্যিক নিশ্চিন্তে বই লেখার কাজটি চালাতে পারতেন না।
বই লিখে বড়লোক হওয়া যায় না। বই লিখে বিখ্যাত হওয়া যায় বটে। তবে বই লিখে বড়লোক হওয়ার থেকেও বই লিখে বিখ্যাত হওয়া বেশি কঠিন। তারপরেও বহু মানুষ বই লিখেন। সারা বছরই নতুন নতুন বই প্রকাশিত হয়। বইমেলা এলে বই প্রকাশের ধূম পড়ে যায়। অনেকে বই ছাপাতে গিয়ে নিজের সঞ্চয় পর্যন্ত ভেঙে ফেলেন। বই লিখে রোজগার করা কঠিন হলেও বহু লোকই বই ছাপিয়ে রোজগার করেন। বাংলা প্রকাশনা ব্যবসা পৌনে দুশো বছরের প্রাচীন। যদিও কোনও কালেই এই ব্যবসায় তেমন রমরমা ছিল না। এখনও নেই। এমনকি বাংলা প্রকাশনা শিল্পে সেই অর্থে পেশাদারিত্ব পর্যন্ত আসে নি। প্রকাশকদের বিরুদ্ধে লেখকদের সবথেকে বড় অভিযোগ- রয়্যালটির ব্যাপারে তাঁরা স্বচ্ছ নন। বাজারে সুনাম আছে এমন প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা হাতে গোনা।
বইমেলা পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের ত্রিবেণী সঙ্গম বলা চলে। যদিও পাঠ্যবইয়ের সংশ্রব ত্যাগের পর বই থেকে শত হস্তে দূরে, এমন মানুষও বইমেলায় যান এবং রোল-ফিশফ্রাই খেয়ে, সেলফি তুলে মেলা থেকে ফিরে আসেন। মানুষ বই পড়ে। তবে মানুষ মাত্রেই বইয়ের পাঠক নয়। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ একটি বই না পড়েও জীবন কাটিয়ে দেয়। বই পড়ার পক্ষে জগতের জ্ঞানীগুণীজন ও মনীষীরা মেলা কথা বলেছেন। জ্ঞানীরা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। সঞ্চিত জ্ঞান তাঁরা অপরাপর মানুষ ও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে চান। অর্জিত জ্ঞানকে গেঁথে রাখার তাগিদ থেকেই গ্রন্থের সৃষ্টি। জ্ঞানীদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও ধ্যানধারণা বইয়ে লেখা থাকে। মানুষ যেদিন থেকে লিখতে শিখল সেদিন থেকেই নিজের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হল। যদিও আর্যরা নিজেদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-স্মৃতিকে শুনে শুনে বা শ্রুতির মাধ্যমে মনে রাখত ও এইভাবেই গুরু-শিষ্য পরম্পরায় তা প্রজন্মান্তরে বহন করে নিয়ে যেত। এই জন্য বেদের অপর নাম শ্রুতি।
‘বই পড়’- মানব জাতির উদ্দেশে জ্ঞানীদের এই উপদেশের পরেও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই কার্যত বই পড়ে না। বইয়ের কোষ হচ্ছে অক্ষর। কালিকে বলা চলে রক্ত। কাঠামো বা কঙ্কাল কাগজ-পিচবোর্ড। পাতাই বইয়ের ত্বক। মুখ হচ্ছে প্রচ্ছদ। জগতে মুখের সৌন্দর্য ফেলনা নয়। বলা হয় সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। তবে মুখ দেখেই কি আর সব সময় মনের হদিস মেলে। মন জানতে গেলে মেলামেশা করতে হয়। ভেতরে ডুব দিতে হয়। বইয়ের মন জানতে গেলেও বইয়ের সঙ্গে মেলামেশা করা জরুরি। মেলামেশা করলেই তো আর হৃদয়ে প্রেম জন্মায় না। পাঠ্যের সঙ্গে পাঠকের মন মিলে গেলেই বইপ্রেম সার্থক হয়। যাঁরা দিবানিশি বইয়ের প্রেমে মশগুল, তাঁরাই তো বইপ্রেমী।
বইয়ের জন্ম দেন লেখক। জন্মস্থান ছাপাখানা। এখন যদিও একটা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলও বইয়ের প্রসবালয়ের কাজটা চালিয়ে দিতে পারে। খ্রিস্টের জন্মের দুশো বছর আগেই ‘হান যুগে’ কাগজ আবিষ্কার করে চিনারা। ছাপাখানা অনেক পরে। ১৪৩৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন জার্মান স্যাকরা জোহানেস গুটেনবার্গ। যদিও তাতে ছাপার কাজ শুরু করতে আরও ১৪ বছর লেগে যায়। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘গুটেনবার্গ প্রেসে’ প্রথম ছাপা হয় একটি জার্মান কবিতা। ১৪৫২-তে ল্যাটিন গ্রামার। ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে ছেপে বেরোয় ‘বাইবেল’। যা ইতিহাসে ‘গুটেনবার্গ বাইবেল’ নামে পরিচিত। বাছুরের চামড়ার ওপর ১৮০ কপি গুটেনবার্গ বাইবেল ছাপা হয়েছিল।
জোহানেস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করার আগেও পৃথিবীতে বই ছিল। কিন্তু সেইসব বইয়ের চর্চা ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে মুষ্টিমেয় পুরোহিত, পাদ্রি, ভিক্ষু, জ্ঞানী, পন্ডিত ও দার্শনিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সভ্যতায় জ্ঞান বা জ্ঞানচর্চার গণতন্ত্রীকরণের সূত্রপাত আমৃত্যু অভাবগ্রস্ত এক জার্মান স্যাকরার আবিষ্কার করা যন্ত্রের মাধ্যমেই।
জোহানেস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করার আগেও পৃথিবীতে বই ছিল। কিন্তু সেইসব বইয়ের চর্চা ছিল সাধারণের নাগালের বাইরে মুষ্টিমেয় পুরোহিত, পাদ্রি, ভিক্ষু, জ্ঞানী, পন্ডিত ও দার্শনিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সভ্যতায় জ্ঞান বা জ্ঞানচর্চার গণতন্ত্রীকরণের সূত্রপাত আমৃত্যু অভাবগ্রস্ত এক জার্মান স্যাকরার আবিষ্কার করা যন্ত্রের মাধ্যমেই। অনেক কাল পর্যন্ত বই বলতেই মানুষ বুঝত চামড়া বা কাপড়ে বাঁধানো ‘হার্ড কভার’ মোটা মোটা বই। চামড়ার মধ্যে আবার ‘মরক্কো লেদার’ দিয়ে বাঁধানো বইয়ের কদর ছিল সব থেকে বেশি। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘পেপার ব্যাক’ বা পাতলা কাগজের মলাটের বই বের করেন জার্মান প্রকাশক ক্রিশ্চিয়ান বার্নহার্ড টাউচনিৎস। যদিও বাণিজ্যিকভাবে পেপার ব্যাক বই প্রথম বাজারে আনে জার্মানিরই পাবলিশিং কোম্পানি অ্যালবাট্রস বুকস, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে। অ্যালবাট্রসকে অনুসরণ করে পরের বছর (১৯৩৫-এর ৩০ জুলাই) ব্রিটেনে প্রথম ‘পেপার ব্যাক’ সংস্করণ প্রকাশ করে ‘পেঙ্গুইন বুকস’।
মানুষ মাত্রেই অভ্যাসের দাস। প্রথম দিকে রক্ষণশীল পাঠকের ঘরে পেপার ব্যাক বই জাতে উঠতে পারে নি। নীরদ সি চৌধুরী বলতেন, হার্ডকভার হলেন ঘরের গিন্নী, পেপার ব্যাককে মনে হয় গণিকা। তিনি সারা জীবন পেপার ব্যাক থেকে দূরে থেকেছেন। যদিও গুটেনবার্গ প্রেস দিয়ে জ্ঞানচর্চার যে গণতন্ত্রীকরণের সূত্রপাত, পেপার ব্যাক বইয়ের প্রচলন তাকে আরও গভীরে নিয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে হার্ডকভারকে হটিয়ে সহজে বহনযোগ্য পেপার ব্যাকই পাঠকের আদৃত হয়ে ওঠে। যুগ স্থির থাকে না। হার্ড কভার, পেপার ব্যাক পেরিয়ে আমরা এখন ই-বুক, পিডিএফ-এর জগতে। অন্তর্জালের জগতে ‘ডিজিটাল ফরম্যাটে’ যে বই পড়ার সুযোগ পাই, তার কোনও গন্ধবাস নেই। কোনও ওজন নেই। এমনকি নেই কোনও নির্দিষ্ট আকার। এই বই ঝোলায় ভরতে হয় না। শেলফে রাখার দরকার পড়ে না। এই বই ঝাড়তে-মুছতে হয় না। এই বইয়ের ‘ডিজিটাল পেজ’ হলদেটে হয় না। পাতা পোকায় কাটে না। টেরাবাইটস-গিগাবাইটসের দুনিয়াতে স্থান অনন্ত। পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত যত বই প্রকাশিত হয়েছে, তার সমস্ত কয়েকটি পেনড্রাইভ কিম্বা মেমোরি কার্ডে ভরে ফেলা সম্ভব।
যাঁরা হার্ডকভার বই ভালবাসতেন তাঁরা অনেকে পেপারব্যাক পছন্দ করতেন না। বই পড়ে পড়ে যাঁরা বুড়ো হয়ে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই ই-বুক ভাল লাগে না। বইয়ের সঙ্গে বাস করে করে ই-বুক, পিডিএফ-কে মন থেকে মানিয়ে না নিতে পারার সঙ্গত অনেক কারণ আছে। ভার্চুয়াল জগতটাই কেমন বায়বীয়। যাকে বলা হচ্ছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তা ধরা দিয়েও ধরা দেয় না। তাকে নিজের করে পাওয়া যায় না। তন্নিষ্ঠ পাঠকের কাছে বই বড়ই জীবন্ত। কখনও তা বিগ্রহের ন্যায় পবিত্র, কখনও প্রেমাষ্পদের ন্যায় আদুরে। ‘ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের’ পর্দায় ভেসে ওঠা গন্ধবাসহীন, দ্বিমাত্রিক ডিজিটাল বইয়ে তাঁর পোষাবে কেন। বইপ্রেমী নতুন বই কিনে আনেন। পাতায় পাতায় সোহাগের হাত বোলান। নতুন বইয়ের সুবাস তাঁকে প্রসন্ন করে। রাত জেগে বই পড়ে শেষ করেন। বইটি প্রিয় হলে তাকে চোখে হারান প্রিয়তমার মতোই। বইয়ের অঙ্গ সত্যিই কোমল ও স্পর্শকাতর। জলের ছোঁয়ায় তার অঙ্গহানি ঘটে। হাতের রূঢ় স্পর্শে তার পাপড়ি ছিঁড়ে যায়। অনাদরে তাকে কীট দংশন করে। বইকে বড় যত্নে রাখতে হয়। বইকে যাঁরা আদরে-সোহাগে যত্নে রাখতে ভালবাসেন, ভালবেসে তৃপ্তি পান, তাঁরা বৈদ্যুতিন বই থেকে দূরেই থাকতে চান।
তবে বইয়ের দুনিয়ায় ই-বুকই ভবিষৎ। বৈদ্যুতিন বই পড়ার অসংখ্য অ্যাপস বাজারে চলে এসেছে। তার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই মুহূর্তে এমন কোনও প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি প্রকাশনা সংস্থা নেই, যারা হার্ড কভার, পেপার ব্যাকের পাশাপাশি বইয়ের ‘কিন্ডল এডিশন’ বের করছে না। একটা কথা মানতেই হবে, ই-বুক, পিডিএফ ফরম্যাট জ্ঞান ও তথ্যকে আরও বেশি সহজলভ্য করে তুলেছে। ‘ডিজাটালাইজেশন’-এর কারণেই জ্ঞানের দুয়ার আজ সবার জন্য অবারিত। এর কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকলেও ভালোর দিকটাই ভারী।
হার্ড কভার হোক আর পেপার ব্যাক কিম্বা হালের ই-বুক- সমস্যা বইয়ের আঙ্গিক নিয়ে নয়। সঙ্কট বইয়ের পাঠক বা পড়ুয়া নিয়ে। মানুষের বই পড়ার সময় ও আগ্রহ- দুটোই কমছে। ছেলেমেয়েরা চিরকালই পাঠ্যবই পড়তে বসেছে পিঠে বেত্রাঘাতের ভয়ে। কিন্তু বই তো নিছক পরীক্ষায় পাশ দেওয়া কিম্বা শুষ্ক জ্ঞানার্জনের বস্তু নয়। বই বিনোদনেরও মাধ্যম। গুটেনবার্গ দ্বারা মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বই পড়া ছিল মানুষের জন্য বিনোদন লাভের সবথেকে সুলভ ও চটজলদি উপায়। দৈনন্দিন বিনোদন বলতে যা বোঝায়, মানুষ তা লাভ করত বই পড়ে। হাসির বই পড়ে বাচ্চারা হাসত। বিয়োগান্তক নভেল পড়ে মায়েরা চোখের জল মুছত। দিনে ভূতের গল্প পড়ার জেরে রাতে কিশোরেরা জানালার সামনে থেকে সরে সরে আসত। রোমাঞ্চিত হওয়ার জন্য সদ্যযুবকেরা থ্রিলার পড়ত। চিলেকোঠায় লুকিয়ে নিষিদ্ধ পুস্তক পাঠে বয়ঃসন্ধিকালের ধর্ম মেনে শরীরে শিহরণ জাগত ষোড়শ-ষোড়শীর। এখন বিনোদন লাভের অজস্র উপায় ও উপকরণ মানুষের সামনে, হাতে একটা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল থাকলেই যথেষ্ট। ছেলেমেয়েরা কষ্ট করে বই পড়তে যাবে কেন? বই তো বর্ণ, শব্দ বাক্য আর অনুচ্ছেদের স্তূপ। শব্দ পড়ে ভেতরে আনন্দ না জাগলে, শব্দের সৌন্দর্য মনকে মুগ্ধ করতে অপারগ হলে নীরবে গ্রন্থপাঠ নীরস ও যন্ত্রণাদায়ক হতে বাধ্য। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউবের যুগে পৃথিবী জুড়েই বই পড়ার আগ্রহ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে মানুষের। সদাব্যস্ত জীবনে দীর্ঘ বই পড়ার অবকাশই বা কোথায়? ব্রিটিশরা ছিল যেমন খাটুইয়ে তেমনি পড়ুয়া জাতি। একটি জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, বই পড়ার পেছনে এখন সপ্তাহে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা সময়ও ব্যয় করেন না ব্রিটেনের মানুষ।
বাঙালির কবি বই লিখে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আরও কয়েকজন বাঙালি এমন কিছু বই লিখেছিলেন, সেসব পড়ে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, তাঁরা নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হলেন কোন পাপে? গড়পড়তা বাঙালির বইপ্রীতি সঙ্গত কারণেই কোনও কালে উচ্চ ছিল না। কিন্তু বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আর্থিক ক্লেশে সাংসারিক টানাপোড়েনের মধ্যেও কখনও বইবিমুখ হয় নি। বিষয় বৈচিত্রে, সাহিত্য গুণে ও চিন্তার ব্যাপ্তিতে বাংলা বইয়ের জগত দৈন্য নয়। তবে গরীবের বেচাকেনার পরিসর অর্থাৎ বাজার দুর্বল হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলা বইয়ের ব্যবসা বা বাঙালির বই ব্যবসা কোনও কালেই লক্ষ্মীর কৃপা পায় নি। সবথেকে জনপ্রিয় সাহিত্যিকের বই পাঁচশ কপি ছাপতে দেওয়ার আগেও প্রকাশক পাঁচবার মাথা চুলকে নেন। চারশ কপি বিক্রি হলে লেখক বাজারে ‘বেস্ট সেলারের’ শিরোপা পান। রবীন্দ্রনাথের কথা আলাদা। শরৎবাবুর বই বাদ দিলে ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ কিম্বা তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’র বাইরে কোনও বাংলা বই-ই কি সেই অর্থে বেস্ট সেলারের ‘ক্রাইটেরিয়া’ পূরণ করতে পেরেছে?
বাংলা ভাষায় লেখা বই বাঙালি না কিনলে ফরাসিরা তো আর কিনে পড়তে যাবে না। বাংলা বর্ণমালা পর হয়ে গেলে বাংলা বই বাঙালির সন্তান পড়বে কীভাবে? বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়ের সংখ্যা দ্রুত বিলীয়মান। বড় মুখ করে বইকে আমরা সম্পদ বলি। কিন্তু সম্পদ কেউ সঙ্গে নিয়ে যায় না। উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যায়। বাঙালির বাংলা পড়তে ভুলে যাওয়া ছেলেমেয়েরা পিতৃপুরুষের রেখে যাওয়া বই ধুলো ঝেড়ে পড়তে বসবে কেন?
যাঁর বই পড়তে বসলে শেষ না করে ওঠা যায় না, সেই সৈয়দ মুজতবা আলী বই লিখেছেন কম, পড়েছেন বেশি। রসিক মানুষটার শখ বলতে ছিল দেশ-বিদেশ ঘোরা, একটু পান করা আর পড়া। মুজতবা আলী বলে গেছেন, ‘বই কিনে কেউ কোনও দিন দেউলিয়া হয় না।’ তবে স্বজাতির বইপ্রেম নিয়ে মোটেই উচ্চ ধারণা ছিল না ‘দেশে বিদেশের’ স্রষ্টার। মুজতবা এক জায়গায় দুঃখ করে লিখেছেন, “তাও বুঝতুম, যদি বাঙালির জ্ঞানতৃষ্ণা না থাকত। আমার বেদনাটা সেখানেই। বাঙালি যদি হটেনটট হতো, তবে কোনো দুঃখ ছিল না। এ রকম অদ্ভুত সংমিশ্রণ আমি ভূ-ভারতে কোথাও দেখিনি। জ্ঞানতৃষ্ণা তার প্রবল, কিন্তু বই কেনার বেলা সে অবলা।”
বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না বটে, তবে বই পড়ার বাই উঠলে সাচ্চা ‘বই খ্যাপা’ কখনও গাঁটের কড়ি গুণে দেখে না। রেস্তে না কুলোলে বন্ধুর কাছ থেকে ধারবাকি করে, বাজারের টাকা সরিয়ে, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে এমনকি বাপের পকেটের টাকা মেরেও বই কেনে। দরকারে বই চুরি করে। চুরির মধ্যে সবথেকে গৌরবের বই চুরি। বইচোরের জেল-জরিমানা হয় না। বই চুরি করে কেউ কখনও অপরাধবোধে ভোগে না। বই সংক্রান্ত আরেকটি অপরাধ করে কেউ কখনও অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হয়েছে বলে শুনি নি- ‘বই মারা’। পরের ঘর থেকে বই নেওয়ার আগে অনাদি-অনন্তকাল ধরে বাঙালি বলে আসছে, ‘পড়েই তিনদিন পর দিয়ে যাবো।’ ৩৬৫ দিন পরেও বই মালিকের কাছে ফেরত যায় না। বউ জবরদখল হলে লাঠালাঠি, খুনোখুনি, মামলা-মোকদ্দোমা হয়। বই জবরদখল ঘিরে চড়চাপড়ের ঘটনা পর্যন্ত শোনা যায় না। সমাজের কত পন্ডিত-বিদ্বজ্জন পাবলিক লাইব্রেরির বই মেরে থুরি আত্তিকরণ করে নিজের লাইব্রেরি সমৃদ্ধ করেছেন।
পাঠকদের মধ্যে যাঁরা সত্ত্বগুণ সম্পন্ন তাঁরা শুধুই বই ভালবাসেন। নীরবে বই কিনে নিভৃতে পড়েন তাঁরা। যাঁরা রজোগুণ সম্পন্ন পাঠক, তাঁরাও বই ভালবাসেন। তবে একটু জাঁক করে বই কিনে খানিক হাঁকডাক করে পড়তে বসেন তাঁরা। যাঁরা তমোগুণী, তাঁরা সাড়ম্বরে বই কেনেন বটে কিন্তু পড়েন কিনা সন্দেহ! বই তো শুধু পড়ার নয়, দেখনদারীরও বস্তু। বই ড্রয়িংরুমের শোভা বাড়ায়। ফেসবুকেরও।
সংসারে যিনি বই ভালবাসেন, বই তাঁর কাছে পরম সম্পদ। কিন্তু যে বই ভালবাসে না, বই তার কাছে বোঝা এবং উৎপাত। মুজতবা আলী বলেছেন বটে বই কিনে কেউ ফতুর হয় না কিন্তু বই কিনে খোঁটা শুনতে হয়। যে বাবার বইয়ের সঙ্গে জন্ম থেকেই শত্রুতা, তিনি ছেলেমেয়েকে সদুপদেশ দেন, ‘বই কিনে পয়সা নষ্ট করিস না।’ ঘরের বউ বই ভাল না বাসলে মধ্যবিত্ত গৃহস্বামীর দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ সোয়াস্তি থাকে না। ‘খালি বই কিনে ঘর ভরাও’- অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিককেও বউয়ের মুখ ঝামটা হজম করতে হয়েছে। বাঙালি সমাজে এই চিত্র কালীপ্রসন্ন সিংহর আমল থেকেই।
বইমেলায় ভিড়ের বহর দেখলে মনে হয় বাঙালি বইয়ের জন্য জান পর্যন্ত দিতে রাজি। এদিকে বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার লাইব্রেরি শুদ্ধ বই কেজি দরে ঝেড়ে দিতে ছেলেমেয়েদের বিবেকে বাধে না। বই নিয়ে আমাদের আদিখ্যেতার শেষ নেই। অথচ উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া সম্পদের মধ্যে বই-ই সবথেকে সস্তা, অবহেলার এবং ক্ষেত্র বিশেষে বোঝাও। এই কলকাতা শহরেই বহু প্রয়াতের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ও দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটা তিক্ত সত্য আমরা সবাই জানি কিন্তু মুখে কবুল করি না। বই আর যাই হোক; নগদ অর্থ, সোনাদানা, সঞ্চয়পত্র, ফিক্সড ডিপোজিট, জমির প্লট কিম্বা ফ্ল্যাট নয়। বাপ-মায়ের রেখে যাওয়া বইয়ের মালিকানা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে মামলা হতে শুনেছেন কখনও?
Feature Photo Credit- Nasen ( National Association for Special Education).