কমিউনিস্ট চিনে গণবিক্ষোভ ছড়াচ্ছে। লকডাউন প্রত্যাহার চিনা জনগণের মূল দাবি হলেও গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার স্পৃহাই যে আন্দোলনকে চালনা করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোভিড সামাল দিতে নাজেহাল চিন কি আরও একটা রক্তস্নানের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে? লিখলেন উত্তম দেব-
চিনে ঠিক কী চলছে, বাইরে থেকে ঠাহর করা খুব মুশকিল। তবে চিনে যে একটা কিছু চলছে, এটা বেশ পরিস্কার। শি জিনপিং-এর সরকার যতই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক, দুনিয়া জেনে গেছে যে, চিন কোভিড নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ। তবে চিনের জনগণ মনে হয় এখন কোভিডের থেকেও বেশি আপদ মনে করছে শি জিনপিং-এর নিপীড়ক প্রশাসনকে। এক দিকে আমরা জানতে পারছি, চিনে করোনার সংক্রমণ ফের ব্যাপক হারে ছড়াচ্ছে এবং সংক্রমণে লাগাম টানতে সরকার কার্যত নাগরিকদের ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় তালা মেরে দিচ্ছে। আর একদিকে শি জিনপিং-এর কমিউনিস্ট সরকারের লৌহ যবনিকা ভেদ করে বাইরের দুনিয়ায় খবর আসছে, চিনের মানুষ শুধু প্রশাসনের কোভিড নীতির বিরুদ্ধেই নয়, একদলীয় ‘রেজিমের’ বিরুদ্ধেও ক্ষেপে উঠেছে।
চিন হচ্ছে সেই দেশ, যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। বেজিংয়ের রাস্তায় কেউ সরকারি নীতির সমালোচনা লেখা ব্যানার নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলেও পুলিশ টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায়। সেই বেজিংয়ে শয়ে শয়ে মানুষ বেরিয়েছে সরকারের কোভিড নীতির প্রতিবাদে। যত দূর জানা যাচ্ছে, বিক্ষোভ শুধু আর রাজধানী বেজিংয়েই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে ঝেংঝোউ, উহান, নানকিং, চেংদু, চংকিং এমনকি বাণিজ্য নগরী সাংহাইতেও। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চিনকে ‘জিরো কোভিড’ করতে চান। অথচ ২০১৯-এর ডিসেম্বরে চিনে প্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হওয়ার প্রায় তিন বছর পরেও শি জিনপিং প্রশাসন দেশকে করোনা শূন্য করতে ব্যর্থ। এই নভেম্বর মাসে চিনে সংক্রমণ ফের জাঁকিয়ে বসেছে। এক-একদিন ৩০-৩৫ হাজার করে পজিটিভ কেস ধরা পড়ছে। হাসপাতালগুলিতে কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার ফের কড়া লকডাউন লাগু করেছে। কিন্তু গৃহবন্দি হয়ে আর থাকতে চাইছে না চিনের সাধারণ মানুষ। দূর থেকে বিক্ষোভের চরিত্র যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, কোভিড ভাইরাসের ওপরে নয় চিনের জনগণের রাগ গিয়ে পড়েছে সর্বগ্রাসী সরকারের ওপরে।
সমাজতন্ত্রের নামে চিনে যেটা চালু আছে, সেটা দমনমূলক কর্তৃত্ববাদী শাসন ছাড়া আর কিছুই নয়। একদলীয় রাজনীতি আর পুঁজিবাদী অর্থনীতির যুগলবন্দিতে চিনের সাফল্য নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। যদিও সেই সাফল্যের কতটা অতিকথন আর কতটা বাস্তব, তা নিয়ে সংশয় আছে। সমাজে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ, নিজের খুশিমতো জীবনযাপন ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব কতটা দুঃসহ যন্ত্রণার, চিন ও ইরানের মানুষ সেটা টের পাচ্ছেন। মাশা আমিনির মৃত্যুর জেরে হিজাব ইস্যুতে বিক্ষোভের সূত্রপাত হলেও ইরানের মানুষ আজ শুধু নারীর মাথা উন্মুক্ত রাখার স্বাধীনতাই নয় রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রও চাইছেন। লকডাউনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে গিয়ে চিনের মানুষও আঙুল তুলে বসেছেন কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
অমর্ত্য সেন চিনের উদাহরণ টেনে দেখিয়ে ছিলেন, গণতন্ত্রের অভাবে একটি দেশে দুর্ভিক্ষ কীভাবে তীব্র হয়ে ওঠে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাও জে দংয়ের নেতৃত্বাধীন চিনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে দেড় থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অনাহারে এই ব্যাপক মৃত্যুর জন্য চিনের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত গণতন্ত্র বর্জিত সর্বাত্মক শাসনব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন অমর্ত্য সেন। একই সময়কালে ভারতে যথেষ্ট খাদ্য ঘাটতি থাকলেও বড় আকারের কোনও দুর্ভিক্ষ ঘটে নি। সেই সময় ভারতের প্রশাসন ও পরিকাঠামো খুব নড়বড়ে অবস্থায় থাকলেও দেশে বড় দুর্ভিক্ষ না হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে গণতন্ত্রের উপস্থিতিকেই চিহ্নিত করেছেন অমর্ত্য। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রসঙ্গ উঠলেই চিনের সঙ্গে তুলনা টেনে ভারতকে খোঁটা দেওয়া আজ আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ভারতের গণতান্ত্রিক সরকার অজস্র পরিকাঠামোগত দুর্বলতা সত্ত্বেও কোভিড সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। সংক্রমণ মোকাবিলা করতে সরকার যখন ব্যর্থ হচ্ছিল, সংবাদ মাধ্যম- নাগরিক সমাজ থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ- কেউই সরকারকে ছেড়ে কথা বলে নি। জনসংখ্যায় ভারত আজ চিনের সমান সমান প্রায়। চিন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং চিনকে বলা হচ্ছে ‘সুপার পাওয়ার’। কিন্তু ১৪০ কোটির দেশ গণতান্ত্রিক ভারতের কোভিড ম্যানেজমেন্ট কি সুপার পাওয়ার চিনের থেকে অনেক বেশি দক্ষ ও সফল প্রমাণিত হয় নি?
কোভিডের আঁতুড়ঘর চিন। চিন থেকে কোভিড ছড়িয়েছে দুনিয়ায়। অথচ কোভিড মোকাবিলায় চিন সরকারের নীতি ও চিনের কোভিড পরিস্থিতি শুরু থেকেই রহস্যে মোড়া। কোভিড-নাইন্টিন নিয়ে চিন সরকারের দেওয়া যে কোনও বক্তব্য ও পরিসংখ্যানকে সন্দেহর চোখে দেখে আন্তর্জাতিক মহল। কোভিডের ‘ফার্স্ট আউটব্রেক’ যদি চিনে না হয়ে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হত, তবে পৃথিবীর সংক্রমক রোগ বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাজ আরও সহজ হতে পারত। সারা পৃথিবীতে কোভিড অতিমারি ছড়িয়ে পড়ার পরেও বাইরের কোনও গবেষক ও অনুসন্ধানী দলকে চিন স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় নি। আর চিন সরকারের দেওয়া তথ্যকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, সত্য গোপন ও তথ্যে জল মেশানোয় চিনের দক্ষতার কথা সবার জানা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও সংকটকালে সরকার তথ্য গোপনের চেষ্টা করে কিন্তু জনগণের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগটাই উগড়ে দিতে বাধ্য হয়। চিন হোক আর ইরান- একটা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকা মানুষ কখন সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খোলে, কখন পথে নামে, গণতান্ত্রিক শাসনে অভ্যস্ত আমরা সহজে অনুভব করতে পারব না। ইংরেজ রাজত্বে প্লেগের চেয়ে প্লেগ দমনে সরকারের ব্যবস্থা ভারতের মানুষের কাছে ভয়াবহ বলে মনে হত। আজ চিনের মানুষের কাছেও হয়তো কোভিডের চেয়ে সরকারের কোভিড নীতি অনেক বেশি পীড়াদায়ক ঠেকছে।
জনবিক্ষোভকে চিনের রেজিম কীভাবে দমন করে, দুনিয়ার মানুষ তা দেখেছে ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে। তেত্রিশ বছর আগে চিনে বিক্ষোভের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। বিশ-বাইশ বছরের চিনা তরুণ-তরুণীদের দাবি ছিল- গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দাও। শেষ পর্যন্ত প্রতিবিপ্লব আখ্যা দিয়ে ছাত্র বিক্ষোভকে ট্যাঙ্কের চাকায় পিষে দিয়েছিলেন দেং জিয়াও পিং। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৯- চিনে এই এগার বছর ছিল দেংয়ের জামানা। চেয়ারম্যান মাওয়ের পরে দেংকে বলা হয় চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সব থেকে শক্তিশালী নেতা। চিনের বহু আলোচিত অর্থনৈতিক সংস্কার চালু হয়েছিল দেং জিয়াও পিংয়ের হাত ধরেই। “বিড়াল সাদা না কালো দেখো না। বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারে কিনা আগে সেটা দেখো”- দেংয়ের এই বিখ্যাত উক্তি প্রবাদে পরিণত হয়েছে। পুঁজি ভাল না মন্দ বিষয় না। পুঁজি দেশের উন্নয়ন করতে পারলেই যথেষ্ট। এটা বোঝাতেই সাদা বিড়াল-কাল বিড়ালের কথা বলেছিলেন দেং। দেং জিয়াও পিংয়ের অর্থনৈতিক সংস্কার, পুঁজিবাদের হাত ধরে চিনকে সমৃদ্ধি দিলেও নাগরিকদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেয় নি। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে এসে ছাত্র-যুবরা যখন তা চাইল তাদের মেশিনগানের গুলি ও ট্যাঙ্কের গোলা উপহার দেয় চিনের কমিউনিস্ট সরকার। ক্ষমতা ছাড়ার ৭ বছর ৩ মাস পর ১৯৯৭-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি দেং জিয়াও পিং মারা যান ৯৩ বছর বয়সে।
২০১২ থেকে চিনে চলছে শি জিনপিং- এর জামানা। জিনপিংকে বলা হচ্ছে মাও ও দেংয়ের পর চিনের সবথেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক। জিনপিং একাধারে চিনের প্রেসিডেন্ট, কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ও দেশের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পদাধিকারী। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত চিনা কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতম কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে শি জিনপিংয়ের কর্তৃত্ব আরও দৃঢ় করেছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। চিনের সীমান্ত নীতি বরাবরই আগ্রাসী। জিনপিংয়ের সরকারও সেই ধারাবাহিকতায় কোনও ছেদ পড়তে দেয় নি। গালওয়ান সীমান্তে রক্তপাতের জেরে ঊনসত্তরের পর ভারত-চিন সম্পর্ক সবথেকে তিক্ততায় পৌঁছেছে জিনপিংয়ের আমলেই। জিনপিংয়ের চিন ভারতকে শত্রু মনে করে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে নানা ভাবে বিপদের মধ্যে ফেলা চিনের আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম লক্ষ্য। চিন বিশ্ব অর্থনীতির নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে উদগ্রীব। বিশ্বের ছোট, দরিদ্র ও দুর্বল দেশগুলির জন্য চিনা ঋণ ইতিমধ্যেই বিপদের আরেক নামে পরিণত হয়েছে। বলা হচ্ছে চিনা ঋণের ফাঁদ। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সমেত পৃথিবীর ৯৭টি দেশ চিনা ঋণের ফাঁদে পড়ে দেউলিয়া হতে বসেছে।
শি জিনপিং-এর এই উচ্চাভিলাষী-আগ্রাসী চিন যে কোভিড অতিমারির ধাক্কায় ধীরে ধীরে বেসামাল তা দুনিয়ার কাছে গোপন নেই। প্যান্ডেমিক পরবর্তী চিন থেকে বহুজাতিক পুঁজি সরতে শুরু করেছে, এই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এক বছর আগেই। বহুজাতিক পুঁজি চিন থেকে সরলে তার পরবর্তী গন্তব্য হবে নিশ্চিত ভাবেই ভারত। বিদেশি পুঁজি হারানোর ভয়ে কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চিন সরকার। নাগরিকদের দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে কোনও দিনই সংবেদনশীল নয় চিনের প্রশাসন। চিনের কোভিড নীতির মধ্যেও চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতার ছাপ। যেই হেতু জনগণের কাছে জবাবদিহিতার দায় সরকারের নেই, তাই চিনের সরকার জনগণের সঙ্গে যেমন খুশি আচরণ করার সাহস পাচ্ছে। চিনের নাগরিকেরা বিষয়টি ধরতে পেরেছে। তাই তারা প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই প্রতিবাদ জানাতে পথে। শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই নয় কলকারখানার কর্মীরাও বিক্ষোভে সামিল বলে খবর মিলছে। এই গণবিক্ষোভ, এই জনঅসন্তোষ কতদূর যাবে, তার পূর্বাভাস দেওয়ার সময় এখনও আসে নি। চিনের একদলীয় সরকার জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করতে কোন পন্থা নেয়, রাজপথে নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ সরকার কতদূর পর্যন্ত সহ্য করে দেখা যাক।
হয়তো মনে অসন্তোষ জমিয়ে রেখেই বিক্ষোভ শেষ করে চিনের জনগণ ঘরে ফিরে যাবে। সরকার কোভিড নীতি শিথিল করলে মূল দাবি পূরণ হওয়ায় মানুষ আন্দোলন তুলে নিতে পারে। আবার জনগণ সহজে রাস্তা নাও ছাড়তে পারে। লকডাউন বিরোধী আন্দোলন গণতন্ত্র, রাজনৈতিক সংস্কার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে বড় আন্দোলনে পরিণত হতে পারে, যদি জনগণের একটা বড় অংশ রেজিমের প্রতি সব রকমের ভয়কে জয় করতে শেখে। তেমন হলে ঘটনা রক্তপাতহীন থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ৩৩ বছর আগে তিয়েনআনমেন চত্বরে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর সেনাবাহিনীর আক্রমণে কতজনের মৃত্যু হয়েছিল, তার কোনও হিসেব নেই। চিন কি আরও একটি রক্তস্নানের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে?
Feature Image Credit- The New York Times/ Kevin Frayer/ Getty Images.