মন্ডপে হামলার আশঙ্কা! নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নিরানন্দে আনন্দময়ীর পুজো বাংলাদেশে - nagariknewz.com

মন্ডপে হামলার আশঙ্কা! নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নিরানন্দে আনন্দময়ীর পুজো বাংলাদেশে


একুশে দেশ জুড়ে মন্ডপে মন্ডপে হামলা। বাইশেও মন্ডপে হামলার আশঙ্কা! নিরাপত্তার ঘেরাটোপে, প্রশাসনের গুচ্ছের বিধিনিষেধের মধ্যে বাংলাদেশে এ কেমন পুজো আনন্দময়ীর?

ঢাকা : বাংলাদেশে একুশের দুর্গাপুজো মাটি হয়েছিল হিংসা আর তান্ডবের জেরে। মহাষ্টমীর সকালে মন্ডপ চত্বরে কোরআন পাওয়ার অভিযোগে কুমিল্লার নানুয়ার দিঘীর পাড়ে যে গন্ডগোলের সূত্রপাত, তা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশে। নোয়াখালীর পরিস্থিতি ছিল সবথেকে শোচনীয়। ইসকন মন্দিরে হামলার ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল পাঁচজনের। বাংলাদেশে হিন্দুরা কমতে কমতে ৭.৯৫ শতাংশে নামলেও এখনও তারা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায়। বাংলাদেশের ১ কোটি ৩১ লক্ষ ৩০ হাজার ১০৬ জন ( সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী) হিন্দু কেমন কাটাচ্ছে বাইশের পুজো? বাঙালি হিন্দুর কাছে আশ্বিন-কার্তিক উৎসবের দুই মাস। চারদিন ব্যাপী দুর্গাপুজো বাঙালিহিন্দুর সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসব ঘিরে এ’বছর কতটা আনন্দ-উদ্দীপনা বাংলাদেশের হিন্দুসমাজে? আসলে একুশের দুর্গাপুজোয় গন্ডগোলের স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের হিন্দুদের। এমনকি প্রশাসন‌ও সন্ত্রস্ত। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে গুচ্ছের নিরাপত্তা জনিত শর্ত চাপিয়েছে পুলিশ। দু’দিন আগেই ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে পুজোয় হামলার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন খোদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে আনন্দমুখর পরিবেশে পুজোর কটাদিন কাটাতে পারেন সংখ্যালঘুরা?

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সহ সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, পুজোকে কেন্দ্র করে সরকারের‌ই যখন এত আত্মবিশ্বাসের অভাব, তখন আমরা স্বস্তিতে থাকি কীভাবে? ঢাকার পুলিশ কমিশনার যা বলেছেন, তা শোনার পর পুজো উদ্যোক্তাদের পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠার‌ই কথা। পুলিশ কমিশনার বলেছেন, তাঁরা গোপন সূত্রে খবর পেয়েছেন যে, পঞ্চাশজন জঙ্গি মন্ডপে মন্ডপে হামলার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। মন্ডপে হামলা চালিয়ে পুজো কীভাবে পন্ড করতে হবে, এই বিষয়ে নাকি জঙ্গিদের বিশেষ প্রশিক্ষণ‌ও রয়েছে। পুলিশ মন্ডপে মন্ডপে হামলার পরিকল্পনার ব্যাপারে এত বিস্তারিত জানলেও ষড়যন্ত্রীদের ধরতে অপারগ কেন? প্রশ্ন তুলেছেন সংখ্যালঘু সংগঠনগুলির নেতারা।

এই বছর পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ার বহু আগে থেকেই পুজো নিয়ে উদ্যোক্তাদের চাপে রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। গত বছরের পুজোয় সহিংসতার কারণেই সরকারের এই অতি সক্রিয়তা বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। পুজোর সময়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পুজো উদ্যোক্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বৈঠক থেকে উদ্যোক্তাদের উপর প্রায় চব্বিশ রকমের বিধিনিষেধ চাপানো‌ হয়েছে। প্রত্যেকটি মন্ডপে সিসি ক্যামেরা বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২৪ ঘন্টা প্রতিটি মন্ডপে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থাকবেন। পুজো চলা কালীন সময়ে উদ্যোক্তাদের নিজেদের গরজে চব্বিশ ঘণ্টা ফেসবুক সহ যাবতীয় সামাজিক মাধ্যম মনিটরিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ডপে আনসার মোতায়েনের খরচ পুজোউদ্যোক্তাদের‌ই বহন করা উচিত বলে ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার। গাড়ি প্রবেশ করতে অসুবিধা হয়, এমন স্থানে প্রশাসন পুজো বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ায় বাংলাদেশের বহু জায়গায় উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত। পাঁচবার আজানের সময় মন্ডপে ঢাক-কাঁসর-ঘন্টা না বাজাতে উদ্যোক্তাদের নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।

চট্টগ্রামের দেওয়ানেশ্বরী কালী মন্দিরের দুর্গাপুজো।

এক কথায় এই বার বাংলাদেশে হিন্দুদের পুজো সারতে হচ্ছে পুলিশি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ও প্রশাসনের কঠোর ‌নজরদারির মধ্যে। এই পরিস্থিতিতে রাজধানী ঢাকা সহ‌ দেশের বড় বড় শহরে পুজো মোটের উপর ঠিকঠাক অনুষ্ঠিত হলেও প্রান্তিক এলাকাগুলি নিয়ে সংশয় আছে অনেকের‌ই। ঝামেলা এড়াতে গ্রামেগঞ্জে পুজো না করতে কিম্বা ‌নমনম করে সেরে ফেলতে উদ্যোক্তাদের উপর স্থানীয় প্রশাসনের অদৃশ্য চাপ থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা বলছেন, সরকারের মনোভাব দেখে এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, হিন্দুদের সর্ববৃহৎ উৎসবকে একটা হ্যাপা হিসেবেই দেখছে তারা। সরকারের আচরণে বিরক্ত মানবাধিকার কর্মীরাও। বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নেত্রী সুলতানা কামাল বলেছেন, “সাম্প্রদায়িক ঘৃণার শেকড় উপড়াতে না পারলে এইভাবে পুলিশি পাহারা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা কমানো যাবে না।” রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে কলাবাগান মাঠের দুর্গাপুজো ছিল ঢাকার বড় পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম। কলাবাগান মাঠের সেই পুজো বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। দু’বছর ধরে পুজো হয় না। ঠিক কী কারণে পুজো বন্ধ তার কোনও স্পষ্ট জবাব নেই পুলিশের কাছে। তবে এলাকার সংখ্যাগুরু বাসিন্দাদের চাপেই প্রশাসন ধানমন্ডিতে পুজো বন্ধ করে দিয়েছে বলে শোনা যায়।

বিশে কোভিড অতিমারির কারণে বাংলাদেশের হিন্দুরা সাড়ম্বরে পুজো করতে পারে নি। একুশে মহাষ্টমীর দুপুরের পর থেকে ভয়ে-আতঙ্কে বাংলাদেশ জুড়ে পুজো কার্যত ভেস্তে যায়। বাইশের পুজো শুরু হয়েছে। রবিবার সকালে মন্ডপে মন্ডপে সপ্তমীর পুজো যথারীতি সম্পন্ন হলেও মহাপুজোকে কেন্দ্র করে ভক্তদের মন থেকে আনন্দ উধাও। পুজোর চারটি দিন নির্বিঘ্নে কাটলেও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকেরা।

ফিচার ফটো- বাংলাদেশের একটি পুজো মন্ডপ। ফটো ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *