যুগ যুগ ধরে অসংখ্য সাধকের পদরেণু ধন্য কাশী বহুত্বের কথা, সহিষ্ণুতার কথাই বলে আসছে। তারপরেও আগ্রাসনের হাত থেকে রেহাই মেলে নি ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানীর। একটি বিশেষ প্রতিবেদন-
শুধু হিন্দুধর্মই নয় সমগ্র ভারতীয় ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ব্যাকরণ, দর্শন ও আধ্যাত্মবাদের প্রেক্ষাপটে কাশীর মাহাত্ম্য বলে শেষ করা সম্ভব নয়। ভারতীয় জীবনধারার সঙ্গে এই নগরী পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। বারাণসীর প্রতিটি ধূলিকণার ভেতরেই যেন ইতিহাস কথা বলে। বহুত্ববাদী হিন্দুধর্মের সেই অর্থে কোনও একক ভরকেন্দ্র নেই। তারপরেও হিন্দুদের আধ্যাত্মিক রাজধানী বলে যদি কিছু থাকে তবে তা কাশী ব্যতীত ভারতের অন্য কোনও নগরী নয়। কাশী জীবনের নগরী। কাশী মরণেরও নগরী। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মনোবাঞ্ছা নিয়ে এখনও প্রতি বছর কাশীতে পা রাখে শত শত মুমুক্ষু নরনারী। কাশীতে মাগঙ্গা বইছেন। গঙ্গা নিছক নদী নয়, গঙ্গা ভারতের জীবনধারা। কাশীতে পৌঁছে এই জীবনধারা যেন আরও মহিমান্বিত হয়েছে। কাশীতে বিরাজ করেন বিশ্বেশ্বর শিব আর অন্নপূর্ণা রূপে মহামায়া। কাশী পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত নগরী। এই নগরীকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে বহুবার। কিন্তু ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানীর অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তিকে বিনষ্ট করতে পারে নি কোনও আগ্রাসনই।
মধ্যযুগে কাশীর ইতিহাস ধ্বংস ও পুনরুত্থানের
চাইলেও ইতিহাসকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। মহাকালের মহাফেজখানায় এটাই লেখা আছে মধ্যযুগে ইসলামিক শাসনে কাশী আক্রান্ত বারংবার। কাশী হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। আর কাশীর প্রাণকেন্দ্র হল বিশ্বনাথ মন্দির। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের উপর প্রথম আগ্রাসন দ্বাদশ শতাব্দীতে- ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘোরীর সেনাপতি কুতুব আল-দিন আইবক সসৈন্যে বারাণসীতে ঢোকে এবং ঘোরীর নির্দেশে হিন্দুদের পবিত্র নগরী তছনছ করে। আইবকের বাহিনীর হাতে এক হাজার মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বাদ যায় নি কাশী নগরীর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বিশ্বেশ্বরের মন্দিরও। বিধর্মীদের হামলায় মন্দিরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর চূড়োটি ভেঙে পড়ে। মন্দির বিধ্বস্ত হলেও বিশ্বেশ্বরকে ছেড়ে যান নি ভক্তরা। বিধ্বস্ত মন্দিরেই বাবা বিশ্বনাথের আরাধনা চলতে থাকে।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/05/5ntgsglgvpgb6x0v_1639378537.jpeg)
মহম্মদ ঘোরীর সৈন্যবাহিনীর হাতে বিধ্বস্ত কাশী বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে টানা ৩৬টি বছর। ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বেশ্বরের মন্দির আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলেন এক গুজরাটি বণিক। দিল্লির মসনদে তখন সুলতান ইলতুতমিস। সুলতানি যুগে আরও একবার মুসলিম শাসকদের বিষ নজরে পড়ে কাশী। কাশীতে হামলা চালিয়ে আবার বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করে দেয় সুলতান সিকান্দার লোদি ( ১৪৮৯-১৫১৭)। বিধর্মী আগ্রাসনকারীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণে এবার এগিয়ে আসেন আমেরের রাজপুত রাজা মান সিংহ। দিল্লিতে তখন পুরোদস্তুর মোগল যুগ। সিংহাসনে সম্রাট আকবর। আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন মান সিংহ। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির আবার সংস্কার করেন আরেক বিখ্যাত রাজপুত রাজা টোডরমল। টোডরমলও ছিলেন একাধারে আকবরের অর্থমন্ত্রী ও সেনাপতি।
কাশী বিশ্বনাথে চরম আঘাত হানে আওরঙ্গজেব
কাশীর উপর চরম ও শেষ আঘাতটি হানে আওরঙ্গজেব ১৬৬৯ নাগাদ। চরম হিন্দু বিদ্বেষী এই মোগল সম্রাট শুধু বিশ্বনাথ মন্দিরকে বিধ্বস্ত করেই ক্ষান্ত দিল না গুড়িয়ে যাওয়া মন্দিরের উপরেই প্রতিষ্ঠা করল জ্ঞানবাপী মসজিদ। চোখ বোজার আগেই আওরঙ্গজেব দেখে যায় মোগল সাম্রাজ্যের পাপের কলস পূর্ণ হতেই উল্টোতে শুরু করেছে। মারাঠা শাসক মালহার রাও হোলকার ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে মসজিদ ভেঙে কাশীতে বিশ্বনাথ মন্দির সম্পূর্ণ নতুন করে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েও অবোধের মুসলিম নবাবের হস্তক্ষেপের কারণে পিছিয়ে আসেন। ১৭৫০ নাগাদ জয়পুরের মহারাজা বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের জন্য জমি মাপামাপির কাজ শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেই সুযোগ দেন নি ভাগ্যদেবী। ঠিক তিরিশ বছর পর এই সুযোগই বিধাতা দিলেন ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই হোলকারকে। বারাণসীতে বাবা বিশ্বনাথের যে মন্দিরটি বর্তমানে আমরা দেখে থাকি ১৭৮০ সালে তা নির্মাণ করেছেন রানি অহল্যাবাই। মসজিদটিকে অক্ষত রেখেই পাশে নতুন মন্দির নির্মাণ করেন ইন্দোরের রানি। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির কর্তৃপক্ষের হাতে এক টন সোনা তুলে দেন শিখ সম্রাট শের-ই-পাঞ্জাব মহারাজা রঞ্জিত সিং। এই সোনা দিয়ে পাত বানিয়েই মুড়িয়ে দেওয়া হয় বিশ্বনাথ মন্দিরের চূড়ো।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2022/05/swarajya_2019-08_62018e11-5931-4e81-b70c-85d8f90b3646_Maharani_Ahilya_Bai_Holkar_Website-1.png)
অতীতে হিন্দু রাজাদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের একটি ছিল কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের সেবায় অকৃপণ হস্তে দান করা। মধ্য যুগে বিধ্বস্ত বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের যখনই প্রশ্ন উঠেছে কোনও কোনও হিন্দু রাজা এগিয়ে এসেছেন। মধ্যযুগে এক দীর্ঘ দুর্যোগের মধ্যেই প্রাণপণে বারাণসীর মাহাত্ম্য রক্ষা করেছেন বিশ্বনাথ ও অন্নপূর্ণার ভক্তরা। যদিও ভক্তদের অটল বিশ্বাস- সবই বাবার কৃপা।
স্বাধীনতার পর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংস্কারে প্রথম উদ্যোগ মোদীর
দেড়শো বছরের ইংরেজ রাজত্বে পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত নগরী বারাণসীকে বড় কোনও অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে হয় নি। তবে কাশীর শ্রীবৃদ্ধিতে বিশেষ কোনও উদ্যোগও নেয় নি ইংরেজ সরকার। বিদেশী সরকারের কাছে সেই প্রত্যাশাও কারও ছিল না। হিন্দু সমাজের বড় বড় মাথা, রাজা-জমিদার ও সম্পদশালীরা অবশ্য কাশী বিশ্বনাথের সেবায় দানধ্যান কিছু করেছিলেন। স্বাধীনতার পরেও দীর্ঘ ৭২ বছর শুধু অবহেলাই প্রাপ্তি ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানীর। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও কাশী নগরীর সংস্কারে সরকারিভাবে প্রথম সবথেকে বড় পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। মোদী নিজে বারাণসী লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। বারাণসী নগরী ও কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের আধুনিকিকরণে ২০১৯-এর ৮ মার্চ বিরাট উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/12/IMG_20211213_230006_799.jpg)
কাশী বিশ্বনাথ করিডোর প্রকল্পের ফেজ ওয়ানের ৩৩৯ কোটি টাকার কাজ গত ডিসেম্বরেই শেষ হয়েছে। দোকানবাজার ও বাড়িঘরের ঘিঞ্জিতে ঢাকা পড়ে যাওয়া বিশ্বনাথ মন্দিরের পরিধি মাত্র তিন হাজার বর্গফুট থেকে বেড়ে আজ ৫ লক্ষ বর্গফুটের বিশাল সুসজ্জিত চত্বর। এখন মাগঙ্গায় অবগাহন করতে করতেই বাবা বিশ্বনাথের বাড়ি দর্শন করেন ভক্তরা। সংস্কার হওয়া বিশ্বনাথ মন্দির দেখে জুড়িয়ে যায় চোখ। মন্দিরকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে ২৩টি সুদৃশ্য পরিকাঠামো। এখন এক লপ্তে ৭৫ হাজার পুণ্যার্থীরও স্থান সংকুলান হয় মন্দির চত্বরে।
সহিষ্ণুতার পাঠ দিয়েও আক্রান্ত কাশী!
যুগ যুগ ধরে অসংখ্য সাধকের পদরেণু ধন্য কাশী বহুত্বের কথা, সহিষ্ণুতার কথাই বলে আসছে। ভারতীয় সাধন পরম্পরায় অজস্র বিভক্তি ও বৈচিত্র্য। কাশীর ধূলি, কাশীর গলি এবং কাশীর গঙ্গা কিন্তু সব পরম্পরার সাধু-সন্ন্যাসী-ত্যাগীকেই স্থান দিয়েছে। এমনকি কাশী পাপীকেও ফেরায় না। কাশী বিধর্মীকেও সাদরে টেনে নেয় কাছে। এই সহিষ্ণু, শান্ত, শোভন ও করুণাঘন কাশীকেই কতবার সহ্য করতে হয়েছে পদাঘাত ও লাঞ্ছনা। ধর্মের সঙ্গে ধর্মের সম্প্রীতি এবং সহাবস্থান সর্বদাই কাম্য। কিন্তু মধ্যযুগ ধরে সনাতন ধর্ম, সংস্কৃতি ও জীবনধারার ভরকেন্দ্র বারাণসীর উপর বারংবার ভিনধর্মী বহিঃ শত্রুদের আগ্রাসন সম্প্রীতি-সহাবস্থানের কথা মনে করায় কি?
Photo sources- Collected and file.