সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেই বিরোধীদের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমকেও নিশানা করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরোনো অভ্যেস। বগটুইকান্ডে সরকার চাপে পড়তেই ফের মিডিয়াকে কাঠগড়ায় তুললেন তৃণমূল সুপ্রিমো।
শিলিগুড়ি :ফের বগটুই হত্যাকান্ডের দায় বিরোধীদের ঘাড়েই ঝাড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও রামপুরহাটের গণহত্যা নিয়ে তিনি যে যথেষ্টই চাপে তার প্রমাণ মিলল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর রবিবারের বক্তৃতায়। এদিন শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানে মমতার ভাষণের বড় অংশ জুড়েই ছিল বগটুই হত্যাকান্ড।
সিবিআই নিয়ে কী বললেন মমতা?
বগটুইকান্ডের তদন্তভার রাজ্য পুলিশের সিটের হাতে দিয়েছিল সরকার। যদিও সিটের হাত থেকে তদন্তের দায়িত্ব কেড়ে নিয়ে সিবিআইয়ের হাতে সঁপেছে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে না গেলেও সিবিআই তদন্ত নিয়ে নিজেদের অস্বস্তি লুকোতে পারছে না তৃণমূল। শুকনো মুখে হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানালেও সিবিআই তদন্ত নিয়ে কটাক্ষ ছুঁড়ে দিতে বিলম্ব করেন নি তৃণমূল নেতৃত্ব। শুক্রবার ডিভিশন বেঞ্চ বগটুই কান্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেও মুখ্যমন্ত্রী মুখ খুললেন দু’দিন বাদে। হাইকোর্টের রায় বেরোনোর দিন রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ যা বলেছিলেন এদিন সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন,” সিবিআই করেছেন, ভালো করেছেন। সিবিআই কাজটা করুক। আমাদের সহযোগিতা থাকবে। কিন্তু এই কাজটা না করে যদি অন্য কাজ করতে যায় বিজেপির কথা মতো, সিপিএম-কংগ্রেসের কথা মতো, আসল কাজ না করে। তাহলে মনে রাখবেন রাস্তায় আন্দোলনে আবার আমরাই কিন্তু নামব।”
মমতার বড় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব!
রবিবার থেকে উত্তরবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পাঁচদিনের কর্মসূচি শুরু। বগটুই গণহত্যার পর প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী কী বলেন সেই দিকে তাকিয়ে ছিল রাজনৈতিক মহল। শিলিগুড়ির সরকারি কর্মসূচিতে মমতা স্পষ্ট করে দেন রামপুরহাটের ঘটনায় ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব থেকে তিনি সরছেন না। মমতা বলেন, “আমি এখনও বলছি রামপুরহাটের ঘটনায় বড় ষড়যন্ত্র আছে পেছনে। ষড়যন্ত্র করে করা হয়েছে। আমরা চাই এর বিচার হোক।”
বগটুই গণহত্যার খবর রাজ্য জুড়ে তোলপাড় তুলতেই ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুলতে শুরু করেন তৃণমূলের নেতারা। পরে তাতে সায় দেন মমতা। বৃহস্পতিবার বগটুই গিয়েও হাল্কার উপর দিয়ে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন,” খুন হয়েছে তৃণমূল নেতা। যাদের বাড়িতে আগুন লেগেছে তারাও তৃণমূলের। খুন হল তৃণমূলের। আগুন লাগল যাদের বাড়িতে, তারাও তৃণমূল। আর রাজনৈতিক টিভিগুলো ব্যবসা করতে নেমেছে তৃণমূলকেই গালাগালি দিয়ে। তাহলেই বুঝুন। আমার হাত কাটল। আমার পা কাটল। আমার মাথা কাটল। আবার আমাকেই গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে।”
তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা?
রামপুরহাটের বগটুইয়ে তৃণমূলের উপপ্রধান খুন ও তার বদলা নিতে আগুনে পুড়িয়ে দশজনকে মারার ঘটনায় এখনও পর্যন্ত তৃণমূলেরই ব্লক সভাপতি আনারুল হোসেন সহ একুশজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে একজনও অন্য কোনও দল করে, এমন খবর পাওয়া যায় নি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরেই আনারুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বগটুই গ্রামে বিরোধী দলগুলির কার্যত কোনও অস্তিত্বই নেই। উপপ্রধান ভাদু শেখ খুনে ধৃতরা তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত। ভাদুর অনুগামীরা বদলা নিতে যাদের পুড়িয়ে মারল তারাও তৃণমূলের সমর্থক। নিজের মুখেই তা স্বীকারও করে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন তাহলে বগটুই কান্ডে বিরোধীরা এল কোথা থেকে? শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সমস্ত প্রমাণ যখন সুস্পষ্ট তখন বারেবারে বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কি তদন্তকেই প্রভাবিত করছেন না? প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলের।
বগটুইকান্ডের জন্য একবার মমতা বামেদের দোষ দিচ্ছেন তো আরেকবার বিজেপিকে। শিলিগুড়িতে তৃণমূল সুপ্রিমোর অভিযোগ- ” ডেউচা-পাঁচামির প্রকল্পে বাধা দিতেই হয়তো রামপুরহাটে ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বাংলায় কর্মসংস্থান হোক, উন্নয়ন হোক, বিরোধীরা চায় না।” পরক্ষণেই আবার মমতার দাবি, যাতে মানুষ গ্যাস,পেট্রোল এবং ওষুধের দাম বাড়লে প্রতিবাদ করতে না পারে সেই জন্য মানুষের নজর ঘোরাতেই রামপুরহাটে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে কেন্দ্রের শাসকদল।
আবার মিডিয়ার ওপর খাপ্পা মমতা
বগটুইয়ের গণহত্যার খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করায় গণমাধ্যমের উপরেও ক্ষিপ্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চাপে পড়লেই মিডিয়াকে তিরস্কার করা তৃণমূল সুপ্রিমোর পুরোনো আদত। একুশে বিপুলভাবে জিতে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর মমতার মিডিয়া বিদ্বেষ বন্ধ ছিল। রামপুরহাটের ঘটনার পর ফের সংবাদমাধ্যমকে নিশানা করা শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী। শিলিগুড়িতে বিরোধীদের পাশাপাশি চ্যানেলগুলিকেও তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করেন তিনি। মমতার রাগ- চ্যানেলগুলি যতটা গুরুত্বের সঙ্গে খুনোখুনির খবর দেখায় ততটা রাজ্যের উন্নয়নের খবর দেখায় না। টিআরপি বাড়াতেই চ্যানেলে চ্যানেলে অশান্তির খবর বাড়িয়ে চড়িয়ে দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় বলে কটাক্ষ করেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কোনও একটা লোক খুন হলে সারাক্ষণ দেখিয়ে বেড়াবে। ওতে যে বাচ্চাদের মধ্যে প্রভাব পড়বে তা বোঝার ক্ষমতা নেই। ওতে নাকি টিআরপি বাড়বে। টিআরপির আগুন দেখতে দেখতে না একদিন টিআরপির আগুনেই পুড়ে মরবে।”
চ্যানেলগুলি মানুষের মৃত্যু দেখিয়ে ব্যবসা করছে বলেও অভিযোগ করেন মমতা। বগটুইয়ের ঘটনার পর বাংলাকে বদনাম করতে দিল্লি থেকে একশ মিডিয়াকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে বলে কটাক্ষ করেন তৃণমূল সুপ্রিমো। এমনকি সংবাদমাধ্যম মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্ররোচনা ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।সংবাদমাধ্যমকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন,” মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্ররোচনা ছড়ানো। উত্তেজনা ছড়ানো- এটা একটা ক্রাইম। এটা মাথায় রাখতে হবে।”
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরার বছর ঘোরার আগেই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘিরে প্রশ্নের মুখে তৃণমূল সরকার। ছাত্রনেতা আনিস খানের নিজ বাড়িতে রহস্যমৃত্যু। একই দিনে দুই কাউন্সিলর খুন। কাউন্সিলর খুনের রেশ মিটতে না মিটতেই রামপুরহাটে উপপ্রধান খুন ও তার জেরে নারকীয় গণহত্যা। রাজনৈতিক মহল বলছে সব মিলিয়ে হঠাৎ করে চাপে মমতা। গোয়ায় দলের শোচনীয় পারফরম্যান্স। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশ সহ চার রাজ্যে বিজেপির জয়। জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন ক্রমেই দুরে সরে যাচ্ছে দেখেও মনমেজাজ ঠিক নেই তৃণমূল সুপ্রিমোর। আনিস খানের মৃত্যু থেকে রামপূরহাটকান্ড- সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা মমতাকে আরও চিন্তায় ফেলেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। বগটুই হত্যাকান্ডের সিবিআই তদন্তে শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, এই নিয়েও মুখ্যমন্ত্রী টেনশনে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। শিলিগুড়িতে মমতার বক্তৃতায় এইসবেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
Photo-Reporter and file.