সন্ধ্যা অবসান! দেহ‌ই শুধু গেল, বাঙালিকে গান শুনিয়েই যাবেন 'গীতশ্রী' - nagariknewz.com

সন্ধ্যা অবসান! দেহ‌ই শুধু গেল, বাঙালিকে গান শুনিয়েই যাবেন ‘গীতশ্রী’


মাত্র একদিন আগেই বসন্তের সমাগম বাংলায়। বসন্তের দ্বিতীয় সন্ধ্যায় জীবনাবসান গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। গত ২৭ জানুয়ারি থেকে এস‌এসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন এই প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী। ফুসফুসে সংক্রমণের সমস্যা ছিল। খানিকটা সেরেও উঠেছিলেন সম্প্রতি। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকেই ফের অবস্থার অবনতি। কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যু- জাগতিক সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গেলেন সন্ধ্যা।

১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। বাংলা আধুনিক সঙ্গীতের জগতে পুরুষ কন্ঠ মানেই হেমন্ত-মান্না-শ্যামল। নারী কন্ঠে কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় একাই একশো। বিশেষ করে বাংলা সিনেমার প্লেব্যাক গানে কোন‌ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না সন্ধ্যার। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। মা হেমপ্রভা দেবী। ছয় ভাইবোনের কনিষ্ঠ ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বংশে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা ছিল। বাবার কাছেই প্রথম গান শেখা। সন্ধ্যার স্বরে ছিল অদ্ভুত স্বকীয়তা। অত্যন্ত মিহি। ষাটের দশক জুড়ে একের পর এক কালজয়ী প্লেব্যাক সঙ্গীতের স্রষ্টা সন্ধ্যা। সেলুলয়েডের পর্দায় সুচিত্রা সেনের লিপে সেইসব গান শুনে মুগ্ধতায় মগ্ন হয়ে যেত বাঙালি।

মাত্র ১২ বছর বয়সে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতার ভজন বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই বয়সেই প্রথম রেডিয়োতে গান গাওয়া। মাত্র তেরো বছর বয়সে এইচ‌এমভি থেকে প্রথম রেকর্ড। রাইচাঁদ বড়াল পরিচালিত অঞ্জনগড় ছায়াছবিতে প্রথম নেপথ্য সঙ্গীতে কন্ঠদান। আধুনিক বাংলা সঙ্গীতের জগতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীতেও তাঁর দখল ছিল সহজাত। বাংলা প্লেব্যাক সঙ্গীতের নারী কন্ঠে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমার প্লেব্যাকেও নিজের দাপট দেখিয়েছেন গীতশ্রী। মুম্বাইয়ে প্লেব্যাকে কাজ করতে গিয়েই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে পরিচয়। দুই কিংবদন্তি শিল্পীর মধ্যে গড়ে উঠেছিল ব্যক্তিগত সখ্যতাও।

নিয়তি লিখেছিল সন্ধ্যা হবেন আধুনিক বাংলা গানের রাণী। তাই অল্পদিনেই মুম্বাইয়ের পাট চুকিয়ে ঘরে ফিরতে হয় সন্ধ্যাকে। কবি ও গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ষাটের দশকে উত্তম-সুচিত্রার যত বাংলা ছবি বক্স অফিসে হিট করেছিল সুচিত্রার লিপে তার প্রত্যেকটি গানেই কন্ঠ দিয়েছিলেন সন্ধ্যা। ডুয়েট গানে পুরুষ কন্ঠে হেমন্ত-মান্নার বিপরীতে সন্ধ্যাকে ছাড়া অন্য কার‌ও নাম‌ই ভাবতে পারতেন না ছবির সঙ্গীত পরিচালকেরা।

বাঙালির হৃদয়ে সম্মানের আসন বহু আগেই পেয়ে গেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ‘ গীতশ্রী ‘ খেতাব কোনও প্রতিষ্ঠান বা সরকার দেয় নি। ভালবেসে সন্ধ্যাকে গীতশ্রী দিয়েছে তাঁর স্বজাতি। জীবনের একেবারে অন্তিম লগ্নে কেন্দ্রীয় সরকার ‘ পদ্মশ্রী’ সম্মান দিতে চাইলেও প্রত্যাখ্যান করেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী। গানেই গাইয়ের পরিচয়। যা রেখে গেলেন তাতে কোন‌ও দিন কালের সন্ধ্যা নামবে না। বাঙালির কাছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মানেই – ” এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার। ” বাঙালিকে গান শুনিয়েই যাবেন সন্ধ্যা।

Photos- Collected.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *