পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের যখন তখন ব্লাসফেমি আইনে ফেঁসে যাওয়ার ভয় তো আছেই । তার থেকেও বড় ভয় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কখন না জানি গণধোলাইয়ে প্রাণ যায়। ধর্ম অবমাননাকারীকে পুলিশে দেওয়ার চাইতে জায়গায় পিটিয়ে মেরে ফেলাই সওয়াবের কাজ বলে মনে করে পাকিস্তানের ধর্মোন্মত্ত জনতা।
সাউথ এশিয়া ডেস্ক : পাকিস্তানে বসবাসকারী সংখ্যালঘুদের কাছে ব্লাসফেমি অ্যাক্ট বা ধর্ম অবমাননা আইন একটা মূর্তিমান বিভীষিকার মতো । পাকিস্তানের পেনাল কোডে ধর্ম অবমাননার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কার ঘাড়ে কখন ধর্ম অবমাননার খাড়া নেমে আসবে কেউ জানে না। হিন্দু , খ্রিস্টান এবং আহমদিয়া মুসলিমদের অবস্থা পাকিস্তানে বকরি ঈদের পাঁঠার চেয়ে বেশি কিছু নয়। আসিয়া বিবির নাম সারা পৃথিবীর মানুষ জানেন। মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি মাথায় নিয়ে আট বছর পাকিস্তানের জেলে কাটিয়েছেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের এই নারী। ২০০৯ সালের ঘটনা। ফসল তোলার মরশুমে অন্য মুসলমান মহিলা শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে কাজে ব্যস্ত ছিলেন আসিয়া। আসিয়া ধর্মে খ্রিস্টান বলে তাঁর হাত থেকে জল পান করতে অস্বীকার করে মুসলমান মহিলারা । এই নিয়ে কথা কাটাকাটি চলতেই একসময় আসিয়াকে ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করে টানতে টানতে গ্রামের মৌলভীর কাছে নিয়ে যায় অন্যরা। আসিয়াকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় । ব্লাসফেমি আইনে নিম্ন আদালতে ফাঁসির সাজা হয় তাঁর। হাইকোর্টও ফাঁসি বহাল রাখে। আটটি বছর কনডেমড সেলে কাটে আসিয়া বিবির। ২০১৮-য় আসিয়াকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তি দেয় পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৯ এর ৮ মে কানাডায় আশ্রয় নেন আসিয়া বিবি। আসিয়া কারাবাসে থাকার সময়ই তাঁর স্বামী-সন্তানেরা কানাডায় পালিয়ে যায়। কানাডায় এখন সপরিবারে সুখে শান্তিতে বাস করছেন বছর পঞ্চাশের আসিয়া বিবি। আসিয়া ও অ্যান ইসাবেল টোলেটের যুগ্মভাবে লেখা ” বই ফ্রি অ্যাট লাস্ট : এ কাপ অব ওয়াটার, এ ডেথ সেন্টেন্স, অ্যান্ড এন ইনস্পায়ারিং স্টোরি অফ ওয়ান উওম্যান’স আনওয়েভারিং ফেইথ ” ধর্মান্ধ পাকিস্তান রাষ্ট্রের নগ্ন,নির্মম চেহারাটা বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করেছে।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/12/20200902T1330-ASIA-BIBI-AUTOBIOGRAPHY-1004550-scaled-1.jpg)
আসিয়া বিবির মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রচন্ড চাপ ছিল পাকিস্তানের উপর । পশ্চিমি দুনিয়ার সেই চাপ উপেক্ষা করে আসিয়াকে ফাঁসিতে চড়ানো বা বেশি দিন জেলে পচানোর সুযোগ ছিল না পাকিস্তানের সামনে । আসিয়া বিবিকে নিয়ে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পেছনে যে বিদেশি চাপ কাজ করে ছিল তা বলাই বাহুল্য। যদিও আসিয়ার খালাস পাকিস্তানের কট্টরপন্থী সংগঠনগুলিকে খুশি করে নি । শুক্রবার শিয়ালকোটে শ্রীলঙ্কান নাগরিক প্রিয়ান্তা কুমারাকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পিটিয়ে-পুড়িয়ে মারার সময় ঘটনাস্থলে তিরিশ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। ” তেহেরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান ” নামক মৌলবাদী ইসলামিক সংগঠনের প্ররোচনায় হাজার হাজার মানুষ পৈশাচিক উল্লাসের সাথে প্রিয়ান্তাকে খুন করে । সেই দৃশ্য মোবাইলে লাইভও করে শত শত লোক। ধর্মান্ধতা , ধর্মীয় উন্মাদনা এবং পরধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পাকিস্তানি সমাজের কত গভীরে এই ঘটনা তার প্রমাণ । ” তেহেরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান ” কোনও জনবিচ্ছিন্ন সংগঠন নয় । এদের সভা-সমাবেশে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয় । তেহেরিক-ই-লাব্বাইকের আন্দোলন দমাতে হিমশিম খেতে হয়েছে ইমরান খানের সরকারকে । দিন কয়েক আগের ঘটনা মাত্র। আন্দোলনের চোটে ইমরানের গদি উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ধর্ম অবমাননা ইস্যুতে তেহেরিক-ই-লাব্বাইক জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাস করে। এবং টিইএলপি’র এই অবস্থানের প্রতি সমর্থন আছে পাকিস্তানের বড় অংশের মানুষের। সব থেকে বড় কথা তেহেরিক-ই-লাব্বাইক যখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নাচাচ্ছিল তখন এই মৌলবাদী সংগঠনকে পেছন থেকে মদত দিচ্ছিল পাক আর্মির একাংশ।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/12/61aa259e3fd64-2.png)
পাকিস্তানে কারও বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার আওয়াজ ওঠার পর তিনি আইন মাফিক পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার সুযোগটুকু পেলে বরং নিজের নসিবকে বাধাই দেন অভিযুক্ত। কারণ ধর্ম অবমাননাকারীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার চেয়ে জায়গায় পিটিয়ে মেরে ফেলাই সওয়াবের কাজ বলে মনে করেন অধিকাংশ পাকিস্তানি। গত তিন দশকে কমপক্ষে ৭৫ জনকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে বলে ২০১৮-র অক্টোবরে স্বীকার করেছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট । প্রিয়ন্তা কুমারাকে হত্যার ঘটনায় পাকিস্তানের পুলিশ এই পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করেছে বলে জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত কার কী হবে , তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। ধর্মোন্মাদদের হাতে বিদেশি নাগরিকের নির্মম হত্যার ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে মুখ পুড়েছে পাকিস্তানের। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের যেই অংশটি সভ্যভব্য , তারা প্রশ্ন তুলেছে এই অরাজকতা আর কতদিন ? কিন্তু পাকিস্তানের সমাজে এখনও এরা আণুবীক্ষণিক সংখ্যালঘু মাত্র। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর উন্মাদনার বিষ পাকিস্তানের জনসমাজের এত গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে যে,বিষ ঝাড়তে গেলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটাকেই না শেষ কালে উচ্ছেদ করতে হয় । আপাতত ইমরান খানের দম থাকলে প্রিয়ন্তা কুমারাকে হত্যায় অভিযুক্ত তেহেরিক-ই-লাব্বাইক-কে নিষিদ্ধ করে দেখাক তো।
Photo Credit – CNN Photo and Dawn.