রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের সামনে একটা সুযোগ এসেছিল নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার। রবিবারের ভোটচিত্র বলছে তারা সুযোগটি হারিয়েছেন। ভোট দিতে গিয়ে একজন নাগরিকও লাঞ্ছিত হলে তার দায় নির্বাচন কমিশনের। মীরা পান্ডের পর রাজ্য নির্বাচন কমিশনে এমন কেউ আর আসেন নি, যিনি নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় শেষ পর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত।
বিশেষ প্রতিবেদন : ২০১৫-য় কলকাতা ও বিধাননগর পুরসভার ভোট সুষ্ঠুভাবে করতে ব্যর্থ হয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীনই লজ্জায় পদত্যাগ করেছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে তো বটেই ভূভারতেও স্বাধীনতার পর এমন কান্ড ঘটে নি। তার আগে ২০১৩’র পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে আসীন ছিলেন মীরা পান্ডে। নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা থেকে ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন – প্রত্যেকটি বিষয়ে রাজ্য সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চেয়েছিলেন দৃঢ়চেতা মীরা পান্ডে। মীরা পান্ডের জামানায় ভোট ঘিরে রাজ্য সরকার বনাম রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনি লড়াই হাইকোর্ট গড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে থেমেছিল । নির্বাচনের নির্ঘন্ট থেকে নিরাপত্তা – শেষ পর্যন্ত সব বিষয়েই নির্বাচন কমিশনের অবস্থান মেনে নিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল – কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের মতোই রাজ্যের নির্বাচন কমিশনও সাংবিধানিকভাবে স্বশাসিত সংস্থা। নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে তাই নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মীরা পান্ডের দৃঢ়তায় তেরোর পঞ্চায়েত নির্বাচন অনেকটাই সুষ্ঠু হয়েছিল। কিন্তু মীরা পান্ডের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। চোখ-কান ও শিরদাঁড়া পরীক্ষা করে সেই আমলাকেই এই গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যিনি সরকারের ইচ্ছাকেই নিজের ইচ্ছা মনে করে মাসের শেষে বেতন তুলেই তুষ্ট থাকবেন ।

সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় মীরা পান্ডের স্থলাভিষিক্ত হয়েই সরকারের সঙ্গে কমিশনের মামলাটামলা সব মিটিয়ে নেন । ২০১৫’ও ছিল এমনই পুরভোটের বছর। ভোটে যথারীতি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানায় বিরোধীরা । সুশান্তবাবু কর্ণপাত করেন নি । কমিশন-সরকার-শাসকদল-বিরোধীদের মধ্যে বিস্তর চাপান-উতোরের পর রাজ্যের শতাধিক পুরসভা ও কলকাতা-বিধাননগরে ভোট হয়ে পৃথক দিনে। কলকাতা ও বিধাননগর পুরসভার ভোট ঘিরে গোলমাল এবং অনিয়ম এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে স্নায়ুর চাপ নিতে না পেরে নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বসেন সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে বসিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্বস্ত আলাপনবাবু এসে বাকি নির্বাচন প্রক্রিয়া সারেন। দুর্বল চিত্তের হলেও খানিকটা বিবেক ও চক্ষুলজ্জা ছিল বলেই অন্ততঃ পদত্যাগটা করতে পেরেছিলেন সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। সুশান্তরঞ্জনের মতো বিবেকবানও বিপজ্জনক – এটা বুঝতে পেরেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে লোক নিয়োগের আগে আরও সতর্ক হয়ে পড়ে সরকার। তারই ফলশ্রুতি অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অমরেন্দ্রকুমার সিং। আঠারোর পঞ্চায়েত ভোটের সময় অমরেন্দ্রকুমার সিংই ছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের চেয়ারে । আদালতে মামলার পর মামলার জেরে দফায় দফায় পিছিয়ে যায় পঞ্চায়েত নির্বাচন। মনোনয়নপত্র পেশ থেকে ভোটগ্রহণ এমনকি ভোটগণনাকে কেন্দ্র করেও নজিরবিহীন অনিয়ম ও হিংসা নীরব দর্শক হয়ে দিব্যি উপভোগ করে গিয়েছিলেন অমরেন্দ্রকুমার সিং।

অমরেন্দ্রকুমার সিং মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নিতেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পান আরেক অবসরপ্রাপ্ত আইএএস সৌরভ দাস। সৌরভ দাসের অধীনে কলকাতার পুরভোটই প্রথম নির্বাচন । পশ্চিমবঙ্গে এখন স্থানীয় নির্বাচন মানেই একপ্রস্থ মামলা । সমস্ত পুরসভার ভোটগ্রহণ ও ভোটগণনা একই দিনে এবং ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার দাবিতে আদালতে যায় বিজেপি। আদালতে বিজেপি তেমন সুবিধা করতে পেরেছে এই কথা বলার সুযোগ নেই।তবে কলকাতার পুরভোটের প্রাক্কালে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে , নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের। কমিশন ও পুলিশের কাজের উপর কড়া দৃষ্টি রাখবে আদালত। নির্বাচন নিয়ে আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই রবিবার কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডে ভোট গ্রহণ হয়েছে। ভোট কেমন হয়েছে আমরা সবাই তা চাক্ষুষ করেছি দিনভর । একমাত্র দলকানা ছাড়া সবাই স্বীকার করবেন অবাধ , সুষ্ঠু , নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ভোট বলতে যা বোঝায় কলকাতার রবিবাসরীয় পুরভোট তা ছিল না। বিরোধী প্রার্থীকে মারধর, এজেন্টকে মেরে বের করে দেওয়া থেকে বুথ দখল , ছাপ্পা – সবই হয়েছে পুলিশের চোখের সামনে। বোমা পড়েছে বুথের বাইরে । ভোট দিতে এসে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে নাগরিককে। মানুষের লাশ পড়ে নি ।এই যা স্বস্তির ।

কলকাতার এবারের পুরভোট এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন বাংলা তথা কলকাতার রাজনীতিতে শাসকদলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত । ভোট শতভাগ অবাধ হলেও তৃণমূলের বিজয় ছিল নিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে শাসকদলের গায়ের জোর খাটানোর খুব একটা দরকারও ছিল না। ভোটের দিন দলের ছেলেরা শান্ত-সুবোধ থাকবে – এ’রকম একটি আশ্বাসও দিয়েছিলেন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় নি। ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হলে হয়ত কিছু ওয়ার্ড হাতছাড়া হত তৃণমূলের। কিন্তু এই ঝুঁকিও নিতে চায় নি শাসকদল। শীর্ষ নেতৃত্ব চাইলেও প্রার্থীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শ্রদ্ধা জানিয়ে হারতে রাজি হবেন কেন , যখন গায়ের জোরেই জেতার যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ নিরপেক্ষ ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলে এই সুযোগ মিলত না। রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের সামনে একটা সুযোগ এসেছিল নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার। রবিবারের ভোটচিত্র বলছে তারা সুযোগটি হারিয়েছেন। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তো জানিয়েছে , কমিশন ও পুলিশের কাজের উপর কড়া নজর রাখবে আদালত । ভোট বাতিল ও নির্বাচনে হস্তক্ষেপ চেয়ে সোমবারই ফের কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে বিরোধীরা । ২৩ ডিসেম্বর সেই মামলার শুনানি। যদিও তার আগেই মঙ্গলবার ভোট গণনা। গণনা হয়ে যাওয়ার পর পুরভোটের উপর আদালতের পর্যবেক্ষণের আর কী মূল্য থাকল ? প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলের।

বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ছিঁটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই। গায়ের জোরে জেতাই আমাদের অভীষ্ট। অন্যান্য রাজ্যের স্থানীয় নির্বাচন ঘিরেও আর তেমন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ শোনা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা ব্যতিক্রম। দুই রাজ্যই বাঙালি প্রধান। কলকাতার পুরভোটে অনিয়ম হলেও প্রাণহানি ঘটে নি। রাজ্যের আরও শতাধিক পুরসভায় ভোট বাকি । কলকাতার পুরভোট যদি ট্রেলার হয় তবে পিকচার তো আভি বাকি হ্যায়। কলকাতার ভোটে পুলিশের দায়িত্ব পালনের যা নমুনা দেখা গেল বাকি ভোটে তেমনই দেখা গেলে বড় মাপের হিংসাত্মক ঘটনা এবং নাগরিকদের প্রাণনাশের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না । সংবিধানের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা ও পদের প্রতি সামান্য সম্মান থাকলেও অবশিষ্ট পুরভোট অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাস করবেন বলে আশা করতে পারি আমরা ।
Photo Credit- Indian Express. Ei Samay and Official FB page of Bengal BJP.