আজ শ্রীল ভক্তিবেদান্ত প্রভুপাদের তিরোধান দিবস । বাঙালি অভয়চরণ দে । আজ পৃথিবীতে ভারতীয় ভক্তিবাদের সবথেকে বড় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর তিনিই । হ্যাঁ । শরীর ছাড়ার চুয়াল্লিশ বছর পরেও । উন্নাসিক মধ্যবিত্ত বাঙালি তাঁকে যতই উপেক্ষা করুক তিনি যা করে গিয়েছেন তারই নাম শূন্য থেকে অভ্যুত্থান । তিরোভাবের দিনে স্মৃতিতর্পণ –
তিনি এমন এক বিপ্লবী ছিলেন,যিনি বিপ্লবের সূত্রপাত করেছিলেন ৬৯ বছর বয়সে । যে বয়সে জরাগ্রস্ত মানুষ স্বজনের গলগ্রহ হয়ে সদা মৃত্যু চিন্তায় কাতর থেকে শেষের দিন গোনে সেই বয়সে মানুষটি ছেঁড়া বস্ত্রখন্ডের ন্যায় বিষয়ের মায়া ত্যাগ করে একা বেরিয়ে পড়েছিলেন দিগ্বিজয়ে । তাঁর হাতে কোনও ধাতব তরবারি ছিল না। ছিল শ্রীমদ্ভাগবতের মাত্র দুশো সেট ইংরেজি অনুবাদ আর একটি বাংলা চৈতন্য চরিতামৃত । তাঁর কন্ঠে ছিল মহাপ্রভু প্রবর্তিত হরে কৃষ্ণ হরে রাম মহামন্ত্র। তাঁর অন্তরে ছিল গুরুর নির্দেশ । মাত্র একটি সুটকেস , বগলে একটি ছাতা আর সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার সম্বল করে ৬৯ বছরের শীর্ণকায় মানুষটি চড়ে বসেছিলেন মালবাহী জাহাজে। ১৯৬৫ সালের ১৩ অগাষ্ট জলদূত নামের মালবাহী জাহাজটি কলকাতা বন্দর থেকে নোঙর তুলেছিল । জাহাজটির গন্তব্য ছিল আমেরিকার নিউইয়র্কের ব্রুকলিন । মালবাহী জাহাজটিতে একটি মাত্র যাত্রী কেবিন ছিল । সেই কেবিনের একমাত্র যাত্রীটিই ছিলেন ৬৯ বছরের সেই বৃদ্ধ – জগৎ যাঁকে আজ চেনে প্রভুপাদ নামে । অভয়চরণ দে । কলকাতার বাঙালি । সুবর্ণবণিক পরিবারে জন্ম। সন্ন্যাসজীবনে নাম শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। এই অনিশ্চিত সমুদ্রযাত্রার বারো বছর পর ১৯৭৭ সালের ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় বৃন্দাবনধামে ৮১ বছর বয়সে যখন শরীর ত্যাগ করলেন প্রভুপাদ, তখন সারা পৃথিবী মহাপ্রভুর মহানাম মন্ত্রে ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি ।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/11/Swami-Prabhupada-400x225-1.jpg)
প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের নাম – ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস, ( আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ ) সংক্ষেপে ‘ ইসকন ‘। প্রভুপাদ যখন ভক্তদের সামনে থেকে অপ্রকট হলেন তখন সারা পৃথিবীতে ইসকনের ১০৮টি মন্দির । মাত্র বারো বছরে এই অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। যুগনায়ক চৈতন্য মহাপ্রভু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ” পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম “। গুরু শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তরুণ অভয়চরণকে বলেছিলেন, ” মহাপ্রভুর কন্ঠনিঃসৃত বাণী কখনও বিফলে যেতে পারে না। তোমরা শিক্ষিত যুবক । তোমরা কেন সারা পৃথিবী জুড়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করছ না ? “ গুরুর নির্দেশকেই জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ও লক্ষ্যে পরিণত করেছিলেন অভয়চরণ । মহাপ্রভু প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনকে বাংলার গন্ডি ছাড়িয়ে যেভাবে প্রভুপাদ গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিলেন তাকে বিপ্লব ছাড়া আর কীই বা বলা যায় ।
তারপরেও উন্নাসিক মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে প্রভুপাদ চর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ বাঙালিহিন্দুর যুগত্রাতা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী বিশ্বব্যাপী মূর্ত হয়েছে শ্রীল প্রভুপাদের মাধ্যমে। গৌরনিতাইয়ের চেয়ে বড় আত্মপরিচয় বাঙালির আর কী আছে । বাঙালির দুই সন্তান গৌরনিতাইয়ের শ্রীমুখনিঃসৃত হরে কৃষ্ণ হরে রাম মহানাম আজ সহস্রাধিক কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে নিউইয়র্ক , ওয়াশিংটন, শিকাগো , বার্লিন , প্যারিস , লন্ডন , স্টকহোম , সিডনি, মেলবোর্ন, অকল্যান্ড , মন্ট্রিল, ওসলো , অটোয়া, ওয়েলিংটন, ভিয়েনা, মস্কো , টোকিওর রাজপথে। ভারতীয় উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে অবশিষ্ট পৃথিবী জুড়ে আজ ইসকনের মন্দির ও সেন্টারের সংখ্যা চারশোর উপরে। আমেরিকা, ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ থেকে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ , রাশিয়ান থেকে জাপানি , স্প্যানিশ থেকে জিউস – হাজার হাজার ভিনদেশি ইসকনের আশ্রয়তলে শরণ নিয়ে কৃষ্ণভক্তে রূপান্তরিত হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে আজ ইসকনের সক্রিয় সদস্য সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। ভারতীয় ধর্ম , দর্শন ও ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত এ এল ভাসান প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত ধর্ম আন্দোলনের বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতিতে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছেন, ” রোমান সম্রাটদের সময় থেকে ধরলে এই প্রথম একটি নতুন প্রাচ্য ধর্ম কিংবা বলা যায় ইউরোপের মাটিতে নতুন একটি প্রাচ্য ধর্ম খ্রীষ্টধর্মের প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য দেশীয়দের দ্বারা আচরিত হচ্ছে। কুড়ি বছরেরও কম সময়ের মধ্যে শূন্য থেকে উত্থিত হয়ে আজ এটি সমস্ত পাশ্চাত্যে পরিচিত হয়েছে । পাশ্চাত্যের ইতিহাসে আমার মনে হয় এটি একটি উল্লেখযোগ্য সময় এবং ঘটনা । “
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/11/IMG_20211114_110919_051.jpg)
১৯৬৫‘র ১৩ অগাষ্ট যেদিন নিজের জন্মশহর কলকাতা থেকে আমেরিকাগামী জাহাজে ৬৯ বছরের প্রভুপাদ চেপে বসেছিলেন সেদিন তাঁর হৃদয়ে শক্তির একমাত্র উৎস ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ । দু’বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে । আগে কখনও দেশের বাইরে পা রাখেন নি। যেই দেশে যাচ্ছেন সেই দেশ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ধারণা পর্যন্ত নেই । নিষ্ঠাবান স্বপাক বৈষ্ণব । সম্পূর্ণ নিরামিষাশী । অচেনা অজানা ভিনদেশে কোথায় খাবেন । কোথায় থাকবেন। তার কোনও নিশ্চয়তা নেই । এমনকি শরীরকে রক্ষা করার উপযুক্ত শীতবস্ত্র পর্যন্ত সঙ্গে নেন নি । স্রেফ সমুদ্রপীড়ার ধকলেই মানুষটা জাহাজে মারা যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁর ধ্রুব বিশ্বাস ছিল তাঁর ভগবান তাঁকে রক্ষা করবেন । জাহাজে করে ভয়ঙ্কর আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিতে দিতে প্রভুপাদ লিখছেন, ” আটলান্টিক মহাসাগর যদি তার স্বাভাবিক রূপ ধারণ করত, তাহলে হয়ত আমি বাঁচতাম না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সেই জাহাজটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন । “ ৩৬ দিন জলভ্রমণ শেষে যখন ( ১৯ সেপ্টেম্বর , ১৯৬৫) প্রভুপাদ নিউইয়র্কের ব্রুকলিন বন্দরে নামলেন তখন তাঁর পকেটে মাত্র চল্লিশটি ভারতীয় টাকা আর জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে তিন খন্ড শ্রীমদ্ভাগবত বিক্রি করে প্রাপ্ত কুড়ি মার্কিন ডলার সম্বল ! ভারতীয় ভক্তিবাদের দূত হয়ে জড়বাদের দেশে গিয়েছিলেন শ্রীল প্রভুপাদ। পাশ্চাত্যে প্রাচ্যের এই বৃদ্ধ বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর প্রত্যেকটি দিন ছিল প্রবল সংগ্রামের । প্রবল তুষার ঝঞ্ঝায় বিধ্বস্ত নিউইয়র্কের রাস্তা দিয়ে তিনি একা হেঁটে গেছেন ভয়ঙ্কর শীতকে উপেক্ষা করে । সুদর্শন যুবক ছিলেন না প্রভুপাদ যে দেখেই লোকে তাঁর সামনে ভিড় জমাবে। আটপৌরে বাঙালি বৃদ্ধ । সর্বাঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণবের বসন । কপালে লম্বা তিলক । তিনি জানতেন না এই বিশাল , বিপুল , অজ্ঞাত ধনতান্ত্রিক সমাজে তাঁর ভবিষৎ পরিকল্পনা কী । তিনি শুধু জানতেন এই বিদেশে তাঁকে মহাপ্রভুর কৃষ্ণ নাম প্রচার করতে হবে। কৃষ্ণ তাঁর কান্ডারী ।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/11/prabhupad-2-768x534-1.jpg)
ভোগবাদের পীঠস্থানে প্রভুপাদ ছিলেন ভক্তিবাদের একলা সৈনিক। বিত্ত নিয়ে , জনবল নিয়ে কেউ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় নি । স্বদেশী কেউ কেউ তাঁকে কৃপা করে আশ্রয় দিয়েছেন । সেই আশ্রয় তিনি গ্রহণ করেছেন বৈষ্ণবোচিত দীনতায় । বেদান্তের জটিল তত্ত্বকথা প্রভুপাদ বলতেন না । তিনি প্রচার করতেন শ্রীমদ্ভাগবতের সরল ভক্তিরস । আমেরিকার সদা কর্মব্যস্ত শহর গুলির পার্কে তিনি একা কীর্তন গাইতেন । সেই কীর্তনের স্রষ্টা প্রভুপাদেরই আরেক স্বজাতি, গৌড়ীয় বৈষ্ণবকুল যাঁকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার বলে মানে । আক্ষরিক অর্থেই শূন্য থেকে কৃষ্ণ ভাবনামৃতের বিপ্লব শুরু করেছিলেন প্রভুপাদ । তিনি যে বীজ বপন করেছিলেন আমেরিকায়, আজ তা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত মহীরুহ । মৃদঙ্গ বাজিয়ে গ্রাম-নগরের পথে পথে কীর্তন করতে ভালবাসতেন মহাপ্রভু । আজ পৃথিবীর যে কোনও মহানগরের রাজপথে পা দেওয়া মাত্রই আপনার কানে যদি ভেসে আসে মৃদঙ্গ-করতালের শব্দ , ভেসে আসে হরে রামা , হরে কৃষ্ণা … বৃন্দগীত । বুঝবেন অভয়চরণ নামে এক বঙ্গজ বৈষ্ণবের পদাতিকেরা বেরিয়ে পড়েছে অভিযানে । অপ্রকট হওয়ার চুয়াল্লিশ বছর পরেও ভীষণভাবে প্রকট শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ।
Pictures Courtesy – ISKCON
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/11/IMG-20211108-WA0000-1024x708.jpg)