বামনেতায়, ডাননেতায় কত পিরিত! নেতাদের মহাপ্রয়াণ হলে জানতে পারি আমরা। নেতায় নেতায় ভাব খুবই ভাল কথা। কিন্তু নিচুতলায় পার্টিতে পার্টিতে খুনোখুনি। মারামারি। মামলা। হামলা। তার বেলা? সে সব বন্ধ না হলে নেতাদের এই মাখামাখি, গলাগলির গল্প ধুয়ে কি জল খাবে জনগণ? লিখলেন উত্তম দেব-
সংসদীয় গণতন্ত্রে একই ছাদের নিচে শাসক ও বিরোধী পক্ষকে মুখোমুখি বসতে হয়। মুখোমুখি বসলে শত্রু-মিত্রে মুখ দেখাদেখি হবেই। মানুষে-মানুষে রোজ মুখ দেখাদেখি হলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সৌজন্য আপনা থেকেই চলে আসে। এই জন্যই বলা হয় পরিষদীয় রাজনীতিতে শাসক-বিরোধী পরস্পরের শত্রু নয় প্রতিপক্ষ মাত্র। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। রাজনীতিতে হেভিওয়েট বলতে যা বোঝায়, পশ্চিমবঙ্গে তিনি ছিলেন তাই। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে উত্থান। বাহাত্তরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে মন্ত্রী হয়েছেন, তার উপর আবার ওই বয়সেই পুলিশ ও তথ্যসংস্কৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতর সামলেছেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের গুণমুগ্ধদের অনেকেই মনে করেন, মানুষটার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা ছিল। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে দলমত নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। বিরোধীদলের নেতারাও তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। সব ছাপিয়ে উঠে এসেছে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যবোধের কথা।
গণতন্ত্রে শাসক-বিরোধীতে খাতির খুব ভাল জিনিস। ডানে-বামে নেতায় নেতায় খাতিরের অনেক গল্প মুখে মুখে ঘোরে। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় নিজের গাড়িতে তুলে বিরোধীনেতা জ্যোতি বসুকে চাট্টি লুচি খাইয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বন্ধু জ্যোতির বাড়িতে গিয়ে হাঁড়ির খবর নিয়ে আসতেন। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে ডেকে বিমান বসুদের সামনে ফিসরোলের প্লেট এগিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী মমতার বাসায় একবার মালপোয়া খেতে এসেছিলেন বলে খবর বেরিয়েছিল। অর্থাৎ নেতায়-নেতায় মালপোয়া ভাগাভাগি করে খাওয়ার চল বেশ ভালোই আছে রাজনীতিতে।

খবরের কাগজের পাতায় , চ্যানেল-পোর্টালের স্ক্রিনে শাসক-বিরোধী নেতায়নেতায় নৈকট্যের গল্প শুনতে আমাদের দারুণ লাগে । শুধু প্রশ্ন একটাই – উপরতলায় নেতায়-নেতায় এত সৌজন্য , এত খাতিরদারি থাকার পরেও নিচের তলায় হানাহানি কেন ? জ্যোতি বসুর প্রতি বিধান রায়ের এমন পুত্রসম স্নেহ ! তারপরেও ঊনষাটের ৩১ অগাষ্ট কলকাতায় বামপন্থীদের খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে সহিংসতা এড়ানো যায় নি। সেদিন পুলিশের গুলি ও বেধড়ক পিটুনতে রাজপথে মৃত্যু হয়েছিল যাদের তাদের সবাই ছিলেন গ্রামের দরিদ্র মানুষ । তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী-বিরোধীনেতায় এত মধুর সম্পর্কের পরেও গ্রাম থেকে গরীবগুর্বোদের ধরে এনে কলকাতার রাস্তায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল কেন ? সিদ্ধার্থশংকর রায় ও জ্যোতি বসু দুই বন্ধু । তুই-তোকারির সম্পর্ক। অথচ আজও ৭২ থেকে ৭৭ সিদ্ধার্থ জামানায় এগারোশো কমরেড খুন হয়ে যাওয়ার কাঁদুনে গেয়ে শোকে ফেসবুক ভাসান সিপিএমের প্রবীণেরা । খুন হওয়া এই এগারোশো কমরেড কারা ? গ্রাম-মফস্বল- মহানগর কলকাতার অলিগলিতে মাথা গুঁজে থাকা নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিল এরা সবাই। জ্যোতি-সিদ্ধার্থের সখ্যতা দিয়ে তো ১৯৭০ এর ১৭ মার্চ বর্ধমানের সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ডও রোধ করা যায় নি। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘরে ঢুকতে কংগ্রেসনেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের অনুমতি পর্যন্ত লাগত না , এমনই ছিল দু’জনের সম্পর্কের বন্ধন । সোমেন মিত্রের সঙ্গেও সিপিএম নেতাদের খাতির ছিল দেখার মতো। কংগ্রেস ও সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের এমন মহব্বতের পরেও ৩৪ বছরের বাম শাসনে সিপিএমের হাতে খুন হয়ে যাওয়া সমর্থকদের একটা বিশাল তালিকা আছে কংগ্রেস নেতাদের কাছে । বামেদের হাতে মৃত এই কংগ্রেসীরা কারা ? গ্রামের চাষীর ঘরের ছেলে। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারের বাপমরা ভাইপো। শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী বাপের বেকার সন্তান। কংগ্রেসীদের রক্তে হাত রাঙানো সিপিএম করা ছেলেরাই বা কারা ছিল ? পার্টির নামে কসম খেয়ে নিজের প্রতিবেশীকেই মেরেছে এরা।

বরাহনগর-কাশীপুর , সাঁইবাড়ি , ১৯৯৩ এর একুশে জুলাইয়ের কলকাতা, নানুর, ছোট আঙারিয়া, কেশপুর, নেতাই, নন্দীগ্রাম। বামে হোক কি ডানে, মরেছে কারা ? সাধারণ মানুষ। মেরেছে কারা? সাধারণ মানুষ। পার্টির নাম করে সাধারণ মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে তোমরা নেতারা সৌজন্যের রাজনীতি মারাও ? একদলের শীর্ষ নেতা মারা গেলে আরেক দলের শীর্ষ নেতা কেঁদে বুক ভাসাও। তোমাদের মধ্যে এত ভালবাসাবাসি থাকলে বাংলার রাজনীতিতে এত হিংসা , মারামারি , খুনোখুনি কেন ? এক-একটা ভোটের আগে-পরে কত লোক খুন হয় রাজ্যে ! নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে বসে থেকে ভোটের দিন কর্মী-সমর্থকদের হুলিয়ে দাও তোমরা নেতারা। বোমা বাঁধতে গিয়ে দলের লোকেরা বিস্ফোরণে দলা পাকিয়ে মরে , আরও হতভাগাদের হাত-পা উড়ে যায়। বাকি জীবন লুলা হয়ে কাটায়। রাজনৈতিক মামলায় জেরবার হয়ে শেষ হয়ে যায় কত পরিবার। উকিলের খরচ জোগাতে গিয়ে জমি-বাড়ি পর্যন্ত বেচে দেয়। পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য যেখানে পছন্দসই প্রতীকে ভোট দেওয়ার অপরাধে মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়। জমির ধান কাটার শ্রমিক পায় না গ্রামে বিরোধী দল করা গেরস্ত চাষী। রাতের অন্ধকারে বিপক্ষ দলের সমর্থকের পুকুরে ফলিডল ফেলে দেওয়া, ছোট দোকানঘরটি পুড়িয়ে ফেলে তাকে ভাতে মারার ব্যবস্থা করা এই রাজ্যে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। প্রবাদ আছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে , উলুখাগড়ায় মারা পড়ে। বাংলায় নেতায় নেতায় সেটিং চলে কর্মী-সমর্থকেরা খুনোখুনি করে মরে। কোনও একজন হেভিওয়েট নেতার পরিণত বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু হলে মিডিয়ায় পক্ষে – বিপক্ষের জীবিত নেতাদের মধ্যে সৌজন্যের ন্যাকামি দেখে হেসে বাঁচি না। সমাজের নিচুতলায় রাজনৈতিক কারণে মানুষে মানুষে হানাহানি বন্ধ না হলে এই সৌজন্য ধুয়ে আমরা জল খাবো?
Photo Courtesy- PTI , FB and HT
