১৯১৪ সালে দার্জিলিং পাহাড়ে প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করে বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন । ১৯২৯ সালে দার্জিলিঙের রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন স্বামী অভেদানন্দ । গিরিরাজের দেশে কন্যা উমার পুজোর বিষয়ে আরও জানালেন অরুণকুমার –
শরৎ এলে জগজ্জননীকে বরণ করার জন্যই মনে হয় বাংলার প্রকৃতি এমন অনবদ্য অনুপম হয়ে ওঠে । চিরসুন্দরী দার্জিলিং পাহাড়েও শরৎ আসে আলোর ঝর্ণাধারা হয়ে । দার্জিলিং বাঙালির , বাংলার শৈলরাণী । পুজো এলে শরতের পাহাড়ে পা রাখতে না পারলে সমতলবাসী অনেক বাঙালির উদরে অগ্নিমান্দ্য শুরু হয়ে যায় । বাঙালির কাছে দার্জিলিঙের এমনই অমোঘ আকর্ষণ । গোটা বাংলার মতো পাহাড় জুড়েও এখন প্রকৃতি হাসছে । দীর্ঘ অতিমারি খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছে । তাই ফের সুদিনের আশায় হাসছেন পাহাড়ের মানুষও । যেভাব সমতল বাংলা শরতে আনন্দময়ীর প্রত্যাশায় দিন গোনে ঠিক সেভাবেই দিন গোনে পাহাড়ও । গিরিরাজের কন্যা উমা । কৈলাসবাসী শিবের ঘরণী । ঘরের মেয়ে ঘরে আসায় পাহাড় জুড়ে আনন্দের হিল্লোল বইবে না তো বইবে কোথায় । দার্জিলিং জুড়ে এখন দুর্গাপুজোর আমেজ । নেপালি-বাঙালি মিলেমিশে মেতে উঠেছেন দেবী দুর্গার আরাধনায় ।
দার্জিলিং পাহাড়ের সবথেকে প্রাচীন দুর্গাপুজোটি এ’বার ১০৭ বছরে পা দিল । দার্জিলিং থানার পাশেই মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ হল । ১৯১৪ সালে এখানে প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেন স্থানীয় বাঙালিরা । আগে হলটির নাম ছিল বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন হল । পরে কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের নামে হলটির নাম পাল্টে হয় নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হল । হলের জমিটি মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে দান হিসেবে পেয়েছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা । হলটি প্রথমে কাঠের ছিল বলে জানা যায়। আগুনে সেটি ভস্মীভূত হলে বর্ধমানের মহারাজা হরেকৃষ্ণ মহতাব ও অন্যান্য ধনাঢ্য বাঙালিদের অর্থানূকুল্যে বর্তমান ভবনটি নির্মিত হয় । নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের দুর্গাপুজো বরাবরই আড়ম্বরের সঙ্গে উদযাপিত হয়ে আসছে । দার্জিলিং শহরের বাঙালিহিন্দু সম্প্রদায় পুজোর আয়োজক হলেও এতে হাত মেলান নেপালিভাষীরাও । এক সময় পুজোয় পাহাড়ে বেড়াতে আসা বিশিষ্ট বাঙালিরাও কটা দিন নৃপেন্দ্রনারায়ণ হলের দুর্গাপুজোয় মেতে উঠতেন । বর্ধমানের মহারাজারাও এই পুজোয় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন । নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হল দুর্গাপুজো কমিটির বর্তমান সম্পাদকের নাম ডা: প্রতাপাদিত্য গুহ । পেশায় চিকিৎসক প্রতাপাদিত্যবাবুর তিন পুরুষের নিবাস দার্জিলিঙে । প্রতাপাদিত্যবাবুর কাছ থেকে জানা গেল , ব্রিটিশ আমলে সমতলবাসী অজস্র বাঙালি জীবিকার কারণে শৈলরাণী দার্জিলিঙে এসে আর ফিরে যান নি। এদের উদ্যোগেই তৈরি হয় বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন। বাঙালি এবং দুর্গা পুজো সমার্থক । বাঙালি যে মুলূকেই যাক দুর্গাপুজোর প্রচলন করে । ১৯১৪ সাল থেকে দার্জিলিং পাহাড়ে দুর্গাপুজার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশন। এর আগে দার্জিলিং পাহাড়ে সামাজিকভাবে শারদীয়া দুর্গাপুজোর আর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি ।
সেই আমলে দার্জিলিং বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিমা আসত শিলিগুড়ি থেকে টয়ট্রেনে চেপে। ঢাকিরা আসতেন নদীয়া জেলা থেকে । পুজোর সামগ্রীর কেনাকাটা করতে নামতে হত সমতলে । মহাষ্টমীর পুজো শেষে নৃপেন্দ্রনারায়ণ হলের অন্নভোগ ছিল রীতিমতো বিখ্যাত । ভোগের খিচুড়ি পেতে পুজোস্থলে ভেঙে পড়ত গোটা শৈলশহরের মানুষ । প্রসাদ বিতরণে হাত লাগাতেন বর্ধমানের মহারাজা হরেকৃষ্ণ মহতাব ও তাঁর সহধর্মিণীও । নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের দুর্গা পুজোর বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানও ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। হল থেকে প্রতিমা কাঁধে নিয়ে শোভাযাত্রা করে শহর পরিক্রমা শেষে সবাই যেতেন কাকঝোড়াতে । ঝোড়ার জলে প্রতিমা নিরঞ্জন পর্ব সাঙ্গ করে হলে ফিরতেন সকলে মিলে । সেখানে বিজয়া সম্মিলনীতে কোলাকুলি , শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে চলত মিষ্টিমুখের পালা । পুজো উপলক্ষে চারদিন ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়ে থাকে এখানে ।নৃপেন্দ্রনারায়ণ বেঙ্গলি হিন্দু হলের দুর্গাপুজোর আগের জৌলুস এখন অনেকটাই ম্লান বলে মনে করেন ডা: প্রতাপাদিত্য গুহ । গত বছর থেকে কোভিড অতিমারির ছাপও পড়েছে পুজোয় । এই বছরও মহাষ্টমীতে কুমারিপুজো ও ভোগ বিতরণ অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হয়েছে করোনার কথা মাথায় রেখে । তবে পুজোয় রীতিনীতি ও নিয়মনিষ্ঠা পালনে কোনও ঘাটতি থাকবে না বলে জানিয়েছেন পুরোহিত লিটন ভট্টাচার্য্য ।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম পার্ষদ ও সন্ন্যাসীশিষ্য স্বামী অভেদানন্দ ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে দার্জিলিঙে রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ প্রতিষ্ঠা করেন । চার বছর বাদেই মঠে শারদীয়া দুর্গাপুজোর সূচনা হয় । প্রতিমা এসেছিল শিলিগুড়ি থেকে । এই পুজোয় স্বামী অভেদানন্দের নির্দেশে সন্ন্যাসী এবং জাতিবর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ এক পঙক্তিতে বসে প্রসাদ গ্রহণ করতেন বলে জানা যায়। এবারও দার্জিলিঙের স্বামী অভেদানন্দ প্রতিষ্ঠিত মঠে নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে দেবী দুর্গার আরাধনা হচ্ছে । দুর্গাপুজো হচ্ছে দার্জিলিঙের রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমেও। ম্যাল, ঘুম , জোরবাংলো এবং সোনাদা সহ দার্জিলিং মহকুমা জুড়ে এই বছর মোট বাইশটি পুজো হচ্ছে বলে স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে ।
শৈলশহর দার্জিলিঙের সবথেকে বড় সর্বজনীন দুর্গাপুজোটি হয় শহরের কেন্দ্রস্থল ম্যালে । ১৯৯৯ সাল থেকে ম্যালের স্থায়ী মঞ্চে এই পুজোর শুরু। পাহাড়ে তখন সুবাস ঘিসিংয়ের জামানা। প্রথমদিকে দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল ( DGHC) ও দার্জিলিং পুরসভার হাতে ছিল পুজোর দায়িত্ব। একসময় প্রতিমা পুজো বন্ধ করে পাথর পুজো করার নির্দেশ দেন ঘিসিং । সুবাস ঘিসিংয়ের এই তুঘলকি কান্ডকারখানাকে মন থেকে মেনে নেন নি নেপালি-বাঙালি নির্বিশেষে পাহাড়ের কোনও সম্প্রদায়ের মানুষই । বিমল গুরুং জামানায় রাজনৈতিক অশান্তির জেরে ম্যালের পুজো কয়েক বছর বন্ধ ছিল । ২০১৭তে বিনয় তামাং জিটিএ’র শীর্ষে বসার পর ম্যালে ফের সাড়ম্বরে দুর্গাপুজো শুরু হয় । বিগত তিনবছর ধরে আর সরকারি ব্যবস্থাপনায় নয় ম্যালের পুজো আয়োজিত হচ্ছে স্থানীয়দের উদ্যোগে । পুজোর দায়িত্বে রয়েছে ম্যাল দুর্গা পুজো কমিটি । কমিটির সম্পাদক সঞ্জীব মোথে জানিয়েছেন , ” নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে মায়ের পুজো করে থাকি আমরা । সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পুজো অনুষ্ঠিত হয় এখানে । ম্যালের পুজোয় স্থানীয় নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষ তো বটেই এমনকি সমতলের মানুষ ও বাইরে থেকে আসা পর্যটকেরাও সোৎসাহে যোগ দেন । ” পর্যটন মরশুমে দার্জিলিঙের ম্যাল এমনিতেই জমজমাট থাকে । পুজোর কটাদিন আনন্দের হাট বসে যায় সেখানে । যদিও এবার কোভিড পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে বেশ সতর্ক পুজো উদ্যোক্তারা । মহালয়ার দিন থেকেই ম্যালে পুজো শুরু হয়ে গেছে । দুর্গাপুজোকে ঘিরে দার্জিলিঙের নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আলাদা কিছু রীতি আছে। সপ্তমীতে পালিত হয় ফুলপাতি উৎসব । বিজয়াদশমীতে হয় ভাইটিকা । প্রতিমা নিরঞ্জন পর্ব চলে ত্রিবেণীতে তিস্তা-রঙ্গিতের সংযোগস্থলে । এই সুন্দর শরতে আনন্দময়ীর আগমনে সব বিষাদ ভুলে আনন্দে মাতোয়ারা পাহাড়ের মানুষ ।
তথ্য ও ছবির জন্য যাঁদের কাছে ঋণী –
- গৌরীশংকর ভট্টাচার্য্য , লেখক ( শিলিগুড়ি )
- ডঃ প্রতাপাদিত্য গুহ ( দার্জিলিং )
- সঞ্জয় বিশ্বাস ( দার্জিলিং )
- সঞ্জীব মোথে ( দার্জিলিং )
Darun