বধির ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কানের গোড়ায় যিনি প্রচন্ড জোরে আওয়াজ করেছিলেন । জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি –
” ম্যাজিস্ট্রেট স্যার , আপনি সত্যি সত্যিই বড় ভাগ্যবান । কারণ আপনি এই দৃশ্য দেখার সুযোগ পাচ্ছেন যে, একজন ভারতীয় বিপ্লবী তাঁর মহান আদর্শের জন্য কীভাবে হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। ” ফাঁসির মঞ্চে পা দেওয়ার আগে কে বলেছিলেন জানেন ? বিপ্লবী সর্দার ভগৎ সিং । ১৯৩১ এর ২৩ মার্চ সন্ধ্যেবেলা । লাহোর সেন্ট্রাল জেল । তাঁর দুই পাশে দুই অকুতোভয় সহযোদ্ধা রাজগুরু ও সুখদেব । মৃত্যুঞ্জয়ী তিন বীর মাথা উঁচু করে হাসতে হাসতে মৃত্যুফাঁস গলায় বরণ করলেন । দেখে তাজ্জব শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেট । হ্যাঁ ; ভারতীয় বিপ্লবীরা এমনই ছিলেন । মৃত্যু যেন তাঁদের কাছে ছিল সত্যিই এ ঘর থেকে ও ঘরে যাওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনা । মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে যিনি কনডেমড সেলে লেনিনের জীবনী পড়ে শেষ করতে পারেন তিনিই ভগৎ সিং । আজ সর্দারের জন্মদিন । ১৯০৭ এর ২৮ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত পাঞ্জাবের লায়লপুর গ্রামে বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের জন্ম ।
ভারতের বিপ্লবী আন্দোলন অসংখ্য অনবদ্য সব চরিত্রের জন্ম দিয়েছে । ভগৎ সিং তাঁদেরই একজন । মৃত্যুর সময় বয়স চব্বিশও পেরোয় নি । অথচ সঙ্কল্প , তেজ , বীরত্ব ও দেশপ্রেমের এমন হিমালয়সম দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন যে ভগৎ সিং হয়ে উঠেছেন একটি অমর কাব্য । অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আজও তরুণদের বুকে আগুন জ্বালান তিনি । জেলে এক সহযোদ্ধা বিপ্লবী ফাঁসির দিনকয়েক আগে ভগৎ সিংকে প্রশ্ন করেছিলেন -” সর্দার তুমি মরতে যাচ্ছ । আমি জানতে চাই তুমি এর জন্য আফশোষ করছ না তো ? ” জবাবে সর্দার ভগৎ সিং বলেছিলেন -” বিপ্লবের পথে পা বাড়ানোর সময় আমি ভেবেছিলাম যদি আমি আমার জীবন দিয়ে দেশের চতুর্দিকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ এর ধ্বনি পৌঁছে দিতে পারি তাহলে মনে করব যে আমি আমার জীবনের মূল্য পেয়ে গেছি । আজ ফাঁসির এই কুঠুরির মধ্যে গরাদের পেছনে বসেও আমি কোটি কোটি দেশবাসীর কন্ঠ থেকে সেই ধ্বনির হুঙ্কার শুনতে পাই। আমি বিশ্বাস করি আমার এই ধ্বনি স্বাধীনতা সংগ্রামের চালিকাশক্তি রূপে সম্রাজ্যবাদীদের ওপর শেষ পর্যন্ত আঘাত করতে থাকবে । আর এত ছোট্ট জীবনের এর চেয়ে মূল্য আর কীই বা হতে পারে ? “
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/09/b3091656b65e00cc587f69f5ebf59775.jpg)
রক্তের মধ্যেই ছিল বিপ্লবের ধারা । কাকা অজিত সিং ছিলেন গদর বিপ্লবী দলের সদস্য । লাহোরের ডিএভি স্কুল ছিল দেশপ্রেমিক বিপ্লবী তৈরীর আঁতুড়ঘর । স্কুলে পড়তে পড়তেই বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হন ভগৎ সিং । কলেজে যখন পা দিলেন তখন পুরোদস্তুর গুপ্ত সমিতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন সর্দার । সুখদেব , ভগবতীচরণ ভোড়া এবং যশপাল সহ অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলে ১৯২৬ সালে লাহোরে নও জওয়ান ভারত সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভগৎ সিং । হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের পুনরুজ্জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ভগৎ সিংয়ের । মূলতঃ ভগৎ সিংয়ের উদ্যোগেই ১৯২৮ এর সেপ্টেম্বরে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় দেশের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপ্লবীরা একত্রিত হয়েছিলেন । সভায় ভেঙে পড়া হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেন বিপ্লবীরা । সংগঠনটির নতুন নামকরণ হয় – হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন বা এইচ এস আর এ । দলের সাত সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন ছিলেন ভগৎ সিং । বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদকে করা হয়েছিল দলের সর্বাধিনায়ক ।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/09/2018_3largeimg23_Friday_2018_001312059.jpg)
লাহোরে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে ১৯২৮ এর ৩০ অক্টোবর পুলিশের মারে গুরুতর আহত হয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা লালা লাজপত রায় । ঊনিশ দিন পর লাজপত রায়ের মৃত্যু হয় হাসপাতালে । লালাজিকে রাস্তায় ফেলে লাঠিপেটা করেছিলেন ডিএসপি স্যান্ডার্স । জাতীয় নেতার মৃত্যুর বদলা নিতে ১৭ ডিসেম্বর লাহোরের পুলিশের দফতর থেকে স্যান্ডার্স সাহেব যখন নিজের মোটর সাইকেলে চেপে বেরিয়ে আসছিলেন তখন গুলি মেরে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেন রাজগুরু ও ভগৎ সিং । এই অভিযানের শরিক ছিলেন চন্দ্রশেখরও । ঘটনাস্থলে থাকা হেড কনস্টেবল চনন সিং পিছু ধাওয়া করলে চননকে গুলি করে মারতে বাধ্য হন আজাদ ।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/09/Bhagat-Singh.jpg)
আজ যেটা দিল্লিতে স্বাধীন ভারতের সংসদ ভবন। যেখানে বসে লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশন । ইংরেজ রাজত্বে সেটাই ছিল নখদন্তহীন কেন্দ্রীয় আইনসভা । শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ট্রেড ডিসপিউট বিলের প্রতিবাদে আইনসভায় বোমা হামলা চালিয়েছিলেন বিপ্লবী ভগৎ সিং । সঙ্গে ছিলেন বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত । ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ৮ এপ্রিল, ১৯২৯ । চাইলে ব্রিটিশের পুতুল খেলার আইনসভা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারতেন দুই বিপ্লবী । অধিবেশন চলা কালে বিনা বাধায় হাউসে ঢুকে দর্শক গ্যালারিতে বসে পড়েন ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত । সঙ্গে পাস থাকায় গ্যালারিতে বসতে কোনও অসুবিধা হয় নি দু’জনের। ট্রেড ডিসপিউট বিলের ওপর ভোটাভুটি শেষ হতেই প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে বিশাল অধিবেশন কক্ষ ।সঙ্গে প্রচন্ড ধোঁয়া । আসলে বোমাটি ছিল স্প্লিন্টার বিহীন স্মোক বোম্ব ।কক্ষে থাকা লোকজন প্রাণভয়ে হাওয়া । দর্শক গ্যালারি থেকে নিচে শত শত লাল লিফলেট উড়িয়ে দিয়ে দুই বিপ্লবী গগনভেদী চিৎকার করে উঠলেন নির্ভয়ে – ” ইনকিলাব জিন্দাবাদ , ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক । ” লিফলেটের শিরোনাম ছিল – ” বধিরকে শোনাতে হলে বড় করে বলতে হয় । ” এটাই ছিল সেদিন ভগৎ সিংদের মুল উদ্দেশ্য । বধির ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কানে নিপীড়িত ভারতবাসীর আওয়াজ পৌঁছে দেওয়া । ভয়ে পুলিশ পর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়েছিল । চাইলে বোমা ফাটিয়ে অনায়াসেই পালিয়ে যেতে পারতেন দু’জন । কিন্তু ভগৎ সিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে ব্রিটিশের আদালতকে নিজেদের আদর্শ প্রচারের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা ।
![](https://nagariknewz.com/wp-content/uploads/2021/09/bhagat_sing_pic.jpg)
লাহোর সেন্ট্রাল জেলে বসেই ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীরা ইংরেজের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিলেন । বন্দী থেকেও কাঁপিয়ে ছেড়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদের ভিত । লাহোর জেলেই ৬৩ দিন অনশন করে প্রাণ বলি দিয়েছিলেন বিপ্লবী যতীন দাশ । যতীন দাশের শবানুগমনে জনস্রোতে ভেসে গিয়েছিলছিল লাহোর থেকে কলকাতা । ভগৎ সিং-সুখদেব-রাজগুরুর মৃত্যদন্ড ঠেকাতে উদ্যোগ না নেওয়ায় জনরোষে মুখ লুকোতে বাধ্য হয়েছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ।
তথ্যসূত্র – শহীদ স্মৃতি , শিব বর্মা
ছবি – আর্কাইভস