একচল্লিশ বছর পর আবার ইতিহাস গড়ল ভারতীয় হকি । ধ্যানচাঁদের দেশে হকির হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে আড়াল থেকে যিনি গড়ার কাজটি করলেন , তিনি নবীন পট্টনায়েক ।
তিনিও খেলতে পছন্দ করেন । খেলেন । খেললেনও । কিন্তু তিনি খেলেন নীরবে । একচল্লিশ বছর পর অলিম্পিক্সে পদক তুলল ভারতীয় পুরুষ হকি টিম । বৃহস্পতিবার জার্মানিকে ৫-৪ গোলে হারিয়ে ব্রোঞ্জ ছিনিয়ে নিল ভারত । অনবদ্য এই জয়ের জন্য মনপ্রীত-রুপিন্দর-সিমরনজিৎ-হার্দিক-শ্রীজেশদের পাশাপাশি দেশবাসীর বাহবা পাচ্ছেন ৭৪ বছরের এক যুবকও । তিনি খেলেছেন মাঠের বাইরে । কিন্তু তাঁকে ই বলা হচ্ছে ভারতীয় হকির স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার নেপথ্যের কারিগর । তাঁর নাম নবীন পট্টনায়েক । ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী ।

ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা হকি দলের স্পনসর কোনও কর্পোরেট জায়েন্ট নয় বরং ওড়িশা রাজ্য সরকার । ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ভারতীয় হকির একমাত্র স্পনসর ওড়িশা । দীর্ঘদিন ভারতীয় হকি দলের স্পনসর ছিল সুব্রত রায়ের সাহারা গোষ্ঠী । সাহারা হাত তুলে নেওয়ার পর ভারতীয় হকি বোর্ড ( হকি ইন্ডিয়া ) বেসাহারা হয়ে পড়ে । ধ্যানচাঁদের দেশে হকির দুরাবস্থা বহুদিন ধরেই । মাঝে কিছু বিক্ষিপ্ত সাফল্য আসলেও হকি নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কর্পোরেট সংস্থা সবাই । সাহারা সরে পড়ার পর হকি ইন্ডিয়া যখন হন্যে হয়ে স্পনসর খুঁজছে তখন এগিয়ে আসেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক । ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা হকি দলকে স্পনসর করার দায়িত্ব নেয় ওড়িশা সরকার । ১৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ নিয়ে হকি ইন্ডিয়ার পাশে এসে দাঁড়ায় ওড়িশা ।
নবীন নিজে হকির ভক্ত । একসময় স্টিক হাতে মাঠেও নামতেন । বক্সে গোল সামলাতেন । তাই শুধু টাকা দিয়েই খালাস নয় হকির পরিকাঠামো উন্নয়ন ও প্লেয়ার সাপ্লাই লাইনের দিকেও নজর দেন তিনি । নবীনের প্রচেষ্টায় ২০১৮য় চতুর্দশ ম্যানস হকি ওয়ার্ল্ড কাপের আসর বসে ভুবনেশ্বরে । রাউরকেল্লায় বিরসা মুন্ডা আন্তর্জাতিক হকি স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে । দেশের সর্বাধিক বৃহত্তম এই হকি স্টেডিয়ামের দর্শক ধারণ ক্ষমতা ২০ হাজার । বাইশে পরবর্তী ম্যানস হকি ওয়ার্ল্ড কাপের ম্যাচ গুলি ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামের পাশাপাশি বিরসা মুন্ডা স্টেডিয়ামেও অনুষ্ঠিত হবে । জাতীয় পুরুষ ও মহিলা হকি দলের খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণে যাতে কোনও ঘাটতি না থাকে সেই লক্ষ্যে কলিঙ্গ স্পোর্টস কমপ্লেক্সের চেহারা পাল্টে দিয়েছে ওড়িশা সরকার । সর্বাধুনিক অ্যাস্ট্রোটার্ফ , অত্যাধুনিক জিম এবং সুদক্ষ ফিজিওথেরাপিস্ট – কোনও কিছুর অভাব নেই সেখানে । এককথায় ভারতীয় হকির ভরকেন্দ্র এখন নবীনের ওড়িশা । জাতীয় পুরুষ ও মহিলা হকি দলে রয়েছে ওড়িশার একাধিক খেলোয়াড়ও । বরাবরই ভারতীয় হকিকে সমৃদ্ধ করেছে ওড়িশার খেলোয়াড়েরা ।
ভারতীয় হকি টিমের ছেলেরা ব্রোঞ্জ জিতে নিয়েছে ইতিমধ্যেই । অলিম্পিক্সের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে উঠে রেকর্ড গড়ে ফেলেছে হিন্দুস্থানের মেয়েরাও। এবার লক্ষ্য ব্রোঞ্জ ছিনিয়ে আনা । বৃহস্পতিবার সকালে কামাল করেছে ছেলেরা । শুক্রবার সকালে দেখিয়ে দেওয়ার পালা মেয়েদের । বৃহস্পতিবার টোকিওতে ভারতীয় হকি দল জার্মানির বিরুদ্ধে মাঠে নামার পর থেকে টিভির স্ক্রিন থেকে আর চোখ সরান নি নবীন পট্টনায়েক । টানটান উত্তেজনা শেষে যখন ম্যাচ শেষ হল তখন একচল্লিশ বছর পর ফের ইতিহাস গড়ে ফেলেছে ভারত । এমনিতে চাপা স্বভাবের মানুষ । কিন্তু দেশের ঐতিহাসিক জয়ে উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারেন নি নীরব কর্মী নবীনও । মনপ্রীত সিংহরা স্বপ্ন ছুঁতেই নিজের ড্রইং রুমে হর্ষোল্লাসে ফেটে পড়েন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী । হারিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় হকির জৌলুস । হকি হারিয়ে যাচ্ছিল ভারতবাসীর মন থেকে । নিঃসন্দেহে ২০২১ এর পাঁচ আগস্ট ভারতীয় হকির ইতিহাসে একটি স্বর্ণখচিত দিন । পাঁচ আগস্ট মাঠের ভেতরে বীরদর্পে খেলে নায়ক মনপ্রীত-রুপিন্দর-সিমরনজিৎ-হার্দিক-শ্রীজেশরা । আর নেপথ্যে খেলে নায়ক একজনই । তিনি নবীন পট্টনায়েক । নবীন খেলতে ভালবাসেন । খেলে জিতেনও । কিন্তু হাঁকডাক না পেড়েই ।
Photo Credit – Twitter