ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কোভিড মোকাবিলায় পৃথিবীর বৃহত্তম টিকাকরণ - nagariknewz.com

ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কোভিড মোকাবিলায় পৃথিবীর বৃহত্তম টিকাকরণ


হাইলাইটস
  • ভ্যাকসিনেশন নিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠেছে ভারত ।
  • টিকার চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা গেছে ।
  • ২৭ জুন পর্যন্ত ৩২ কোটি ৩৬ লক্ষ ৬৩ হাজার ২৯৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে ভারতে ।
  • প্রতি মাসে ১৬ কোটি ২৮ লক্ষ নাগরিককে টিকা দেওয়া সম্ভব ।
  • ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৩৫ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে ভারত ।

বিশেষ প্রতিবেদন : টিকাকরণকেই কোভিড – নাইন্টিন অতিমারি প্রতিরোধের সবথেকে কার্যকর পদ্ধতি বলে মেনে নিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা । যদিও টিকা নিয়ে একটি মহলের সংশয় এখনও দূর হয় নি । টিকা শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টে দ্রুত মিউটেট হতে থাকা কোভিড ভাইরাসকে পর্যুদস্ত করতে পারবে কিনা তা সময়‌ই বলবে ।‌ তবে অতি সংক্রমক এই ভাইরাসের হাত থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে পৃথিবীর রাষ্ট্র গুলির সামনে টিকাকরণ ভিন্ন আর কোনও বিকল্প রাস্তা যে নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না । টিকা যদি শেষ পর্যন্ত কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয় তবে তা মানবজাতির জন্য খুব একটা সুখের বিষয় হবে না । তখন ভাইরাস আর ভগবানের মর্জির ওপর নিজেদের ভাগ্যকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর খুব বেশি কিছু করার থাকবে না আমাদের । লকডাউন বা লকডাউন জাতীয় পরিস্থিতির জেরে বিশ্ব অর্থনীতি বিধ্বস্ত । বাইশ থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে ব্যর্থ হলে পৃথিবীতে কোভিডের পাশাপাশি অভাবঅনটনেও বহু মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না ।

কোভিড নির্মূলের লক্ষ্যে জানুয়ারি মাসে ভারতে পৃথিবীর বৃহত্তম টিকাকরণ কর্মসূচী শুরু হলেও সরকারের পরিকল্পনায় ত্রুটি থাকায় তা হোঁচট খেয়ে পড়ে। আসলে দ্বিতীয় ঢেউ যে এত দ্রুত ভারতে আঘাত হানবে তা বুঝে উঠতে পারে নি কেন্দ্রীয় সরকার । যদিও সেই হুঁশিয়ারি দিয়েই যাচ্ছিলেন বিশেষজ্ঞরা । বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে নিঃসন্দেহে ভুল করেছে সরকার । মার্চ মাস পর্যন্ত ভ্যাকসিনেশন নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ধাপে ধাপে বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া । কিন্তু এপ্রিল থেকে দেশ জুড়ে কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক সংক্রমণ সব হিসেব গুলিয়ে দেয় । ভারত বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদক দেশ । কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে ভারতের কাছে সারা বিশ্বের প্রত্যাশা ছিল । সিরাম ইনষ্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রোজেনেকার কোভিশিল্ড পৃথিবীর অনেক দেশে সরবরাহ‌ও করেছে ভারত । এমনকি সম্পূর্ণ ‌দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন‌ও আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক ‌দেশে রপ্তানি করেছে সরকার । এই ভ্যাকসিন রপ্তানিকে মোদীর ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি বলে প্রশংসা বা কটাক্ষ করেছেন কেউ কেউ । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার‌ও ( হু ) ভ্যাকসিন উৎপাদক দেশ গুলির প্রতি পরামর্শ ছিল , নিজেদের নাগরিকদের পাশাপাশি অন্য দেশের বিশেষ করে আফ্রিকার গরীব দেশগুলোর নাগরিকদের কথাও মাথায় রাখা । সেই হিসেবে বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন পাঠিয়ে ভারতের সনাতন আদর্শ বসুধৈব কুটুম্বকমকেই রক্ষা করেছেন নরেন্দ্র মোদী । যদিও এপ্রিল-মে মাসে যখন দেশে প্রতিদিন চার লক্ষ করে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছিল তখন ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির জন্য মোদীকে কাঠগড়ায় তোলে বিরোধীরা ।

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে চলছে পৃথিবীর বৃহত্তম টিকাকরণ ।

ভ্যাকসিন নিয়ে দেশবাসী এবং বিরোধীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া খুব‌ই স্বাভাবিক । কেননা বিপদে পড়লে যেখানে নিজে বাঁচলে বাপের নাম সেখানে পরের দেশ তো দূর কি বাত । পৃথিবীর কোনও দেশের হৃদয়‌ই এত বড় নয় যে কোভিডের মতো ভয়ঙ্কর মহামারির সময় নিজের নাগরিকদের জন্য না রেখে ভ্যাকসিন অন্য দেশকে বিলোবে । কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন দেশ ভেসে যাচ্ছিল তখন দেশে ভ্যাকসিনের সঙ্কটটা খুব একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না । কারণ সরকার এবং উৎপাদকদের দিক দিয়ে এই ধরণের পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি ছিল না । ভ্যাকসিন জিনিসটা কোন‌ও ক্যান্ডি নয় যে চাইলেই রাতারাতি উৎপাদন তিন-চার গুন বাড়িয়ে দেওয়া যায় । প্রতিটি রাজ্য থেকে ভ্যাকসিন পাঠাও , ভ্যাকসিন পাঠাও দাবি উঠতে শুরু করল । পরিস্থিতির চাপে হতবিহ্বল কেন্দ্রীয় সরকার এক সময় দুম করে আঠারো ঊর্ধ্ব সকলকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দিল । যদিও ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও সরবরাহ তখন ভেঙে পড়ার মুখে ।চাপ নিতে না পেরে ইংল্যান্ডে পর্যন্ত পালিয়ে গেলেন সিরাম ইনষ্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার মালিক আদার পুনাওয়ালা ।

ভ্যাকসিন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে । হয়তো এটা সরকারের প্রাপ্য‌ই ছিল । ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় কেন্দ্রের ভ্যাকসিন পলিসি কিছু সময়ের জন্য নীতি পঙ্গুত্বে আক্রান্ত হয়েছিল । যদিও সেই সময় ডঃ দেবী শেঠীর মতোন প্রবাদপ্রতিম কার্ডিয়াক সার্জেন আশাবাদ হারিয়ে সরকারের বেলাগাম সমালোচনায় মেতে ওঠেন নি । ডঃ শেঠী বলেছিলেন , অক্সিজেন ঘাটতি হোক আর ভ্যাকসিন ঘাটতি – পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে ভারত । শেষ পর্যন্ত ডঃ দেবী শেঠির আশাবাদের‌ই জয় হচ্ছে বলে দেখতে পাচ্ছি আমরা । ভ্যাকসিন নিয়ে মে মাসের মাঝামাঝি সময়েও যেই দুশ্চিন্তার জায়গাটা ছিল জুনের শেষে তা কিন্তু সামলে উঠতে পেরেছে ভারত । প্রাথমিক ধাক্কা সামলে কোভিড মোকাবিলায় দেশে গণ টিকাকরণ কার্যক্রমকে একটা বলিষ্ঠ জায়গায় কিন্তু নিয়ে যেতে পেরেছে সরকার ।

২৭ জুন পর্যন্ত দেশে ভ্যাকসিনেশন হয়েছে ৩২ কোটি ৩৬ লক্ষ ৬৩ হাজার ২৯৭ জনের । আমেরিকার মোট ভ্যাকসিনেশনকে‌ও যা অতিক্রম করেছে । এটা সত্যি যে আমেরিকায় দুই ডোজ টিকাই পেয়েছেন , এমন মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৬.৬২ শতাংশ । ভারতে সেখানে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ পাওয়া নাগরিকের সংখ্যা কোটি ৫৪ লক্ষ , জনসংখ্যার নিরিখে যা মাত্র চার শতাংশ । কিন্তু মূল কথা হল ভ্যাকসিনেশন নিয়ে হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে পেয়েছে সরকার । ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহে যে স্থবিরতা এসেছিল তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে । তাই ডাবল ডোজ টিকা গ্রহণকারী নাগরিকের গ্রাফটিও জুলাই থেকে উর্দ্ধমুখী হবে বলে মনে করছেন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা । ২৭ জুন , রবিবার গোটাদেশে ভ্যাকসিনেশন হয়েছে ১৭ লক্ষ ২১ হাজার ২৬৮ জনের । তার আগের দিন ২৬ জুন , শনিবার সারা দেশে টিকা নিয়েছেন ৬৪ লক্ষ ২৫ হাজার ৮৯৩ জন । রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ বাড়িতে থাকায় রবিবার করে ভ্যাকসিনেশনের সংখ্যা অনেকটাই নেমে যায় । মাসের ২৬টি দিন যদি ৬০ লক্ষ করে টিকা দেওয়া যায় তবে সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে ১৫ কোটি ৬০ লক্ষ । চারটা রবিবার যদি ১৭ লক্ষ করেও টিকা দেওয়া হয় তবে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৬৮ লক্ষ । এইভাবে চললে প্রতি মাসে ১৬ কোটি ২৮ লক্ষকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব ।
৩২ কোটি ৩৬ লক্ষ নাগরিককে টিকার আওতায় আনা হয়েছে ।

কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে ২০২১ এর ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮ ঊর্ধ্ব দেশের সকল নাগরিককে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা হবে ।‌ এর জন্য দরকার ১৮৬.৬ কোটি ডোজ টিকা । যদিও ওই সময়ের মধ্যে ১৩৫ কোটি ডোজ টিকা পাওয়া সম্ভব বলে সরকার হিসেব দিয়েছে । তাহলে দেখা যাচ্ছে বছর শেষেও টিকার চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ৫০ কোটির ঘাটতি থাকবে । কিন্তু চেষ্টা করলে এই ৫০ কোটির ঘাটতি পূরণ করাও ভারতের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয় । দেশে এখন সিরাম ইনষ্টিটিউটে প্রস্তুত অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রোজেনেকার কোভিশিল্ড , ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের পাশাপাশি রাশিয়ার স্পুটনিক ভি’ও দেওয়া হচ্ছে । খুব শীঘ্রই ভারতে আমেরিকান ভ্যাকসিন কোভাভ্যাক্সের‌ও উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে ।

ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিঃসন্দেহে অজস্র ছিদ্র আছে । যৌক্তিক কারণে সরকারের সমালোচনা হাজার বার করতে হবে । কিন্তু সিস্টেমের অতিসমালোচক হতে গিয়ে দেশের কৃতিত্বকে এড়িয়ে যাওয়া বা খাটো করার প্রবণতা আমাদের ত্যাগ করা দরকার । নিজেদের ‌দোষত্রুটি গুলি খুঁটিয়ে দেখার পাশাপাশি সাফল্য নিয়েও খানিকটা উচ্ছ্বসিত হতে বাধা কোথায় ? ১৩০ কোটি মানুষের এই বিরাট দেশে পরিকাঠামো গত অনেক ‌দুর্বলতা থাকার পরেও প্রাথমিক বিপর্যয় সামলে ভারতের কোভিড ভ্যাকসিনেশন যে গতিতে এগোতে ‌শুরু করেছে মাঝ রাস্তায় কোন‌ও ছন্দপতন না ঘটলে ‌এই মেগা মিশন জাতির জন্য সাফল্যের একটি বড় নজির হয়ে থাকবে ।

Credit for photos – moneycontrol.com ,reuters and twitter .

প্রচ্ছদচিত্র প্রতীকি ।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *