১৮ এপ্রিল , ১৯৩০ : বাঙালির গৌরবের দিন , বাঙালির স্পর্ধার দিন - nagariknewz.com

১৮ এপ্রিল , ১৯৩০ : বাঙালির গৌরবের দিন , বাঙালির স্পর্ধার দিন


                       

                           বিশেষ প্রতিবেদন

এপ্রিল । আজকের দিনটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন । বাঙালির জন্য যুগপৎ গৌরব এবং স্পর্ধার‌ও বটে । যদিও আত্মবিস্মৃত বাঙালি কোন‌ও দিন‌ই নিজের ইতিহাস চর্চায় মনোযোগী কিম্বা আন্তরিক নয় । তাই ৯৩০ এর এপ্রিল  সমকালীন বাংলা ও ভারতবর্ষে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করলেও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস বলতে যা বোঝায় পরবর্তীকালে সেই নিরিখে ঘটনাটি নিয়ে কোনও গবেষণা হয় নি । বাঙালি মিথ , গুজব , অতিকথন , ব্যক্তিপুজো পছন্দ করে । ৯৩০ এর এপ্রিলের আগে পরের ঘটনা নিয়েও সেসবের অভাব নেই কিন্তু সুসংহত প্রামাণ্য ইতিহাস এবং তথ্যের পরম্পরা অনুপস্থিত । পরিকল্পনামাফিক সুসংগঠিত আঘাত হেনে শত্রুপক্ষকে হতবিহ্বল করে দেওয়ার মতো ঘটনা ভারতের বিপ্লবীরা হাতে গোনা চার-পাঁচটির বেশি ঘটাতে পারে নি । সেই চার-পাঁচটির মধ্যে সবথেকে সুসংগঠিত এবং আক্রমণাত্মক একটিই । আর তার নাম – চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ । 

৯৩০ এর ই এপ্রিল  রাতে বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির ৬৫ জন যুবক চট্টগ্রামে প্রশাসনের মূল তিনটি স্তম্ভ পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার , টেলিফোন-টেলিগ্রাফ স্টেশন এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় আঘাত হেনেছিল । বিপ্লবীদের ঝটিকা আক্রমণের সামনে রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে বন্দরনগরীর ব্রিটিশ প্রশাসন । রাত দশটা থেকে ভোরের আলো ফোঁটা পর্যন্ত প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ পরাজিতের দলে। অপারেশন শেষ হ‌ওয়া মাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে গেরিলারা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করলেও পরবর্তী ৯৬ ঘন্টার আগে এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ফিরে পায় নি ব্রিটিশ প্রশাসন । সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের হাঁটুতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল মাত্র ৬৫ টি অকুতোভয় বাঙালি যুবক ।শুধু বাংলা নয় গোটা ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী ধারার স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সামান্য সরঞ্জামে এমন সুসংগঠিত অভিযানের উদাহরণ আর নেই   মাস্টারদা ,অম্বিকা চক্রবর্তী , গণেশ ঘোষ , নির্মলকুমার সেন এবং অনন্ত সিংহের মতো সিনিয়রদের বাদ দিলে প্রায় কারোরই বয়স বাইশ তেইশের বেশি নয় । দলে টেগরা ( হরিগোপাল বল ) ছিল সবথেকে ছোট , মাত্র  বছর বয়স ।  

এরপর বাইশে এপ্রিল । জালালাবাদ পাহাড়ের ঐতিহাসিক যুদ্ধ । বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ রয়্যাল আর্মির বিশাল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামলেন চারদিন অর্ধাহারে অনাহারে থাকা ৬৫ জনের বাঙালি যোদ্ধার দল । মাস্টারদা এই যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব দিলেন বাইশ বছরের লোকনাথ বলকে । রসদ ফুরোলে বিপ্লবীরা রণাঙ্গন ত্যাগে বাধ্য হন । ততক্ষণে বালক টেগরা সহ শহিদ দ্বাদশ বিপ্লবী । কিন্তু বিপ্লবীরা রণাঙ্গন ত্যাগের আগে পর্যন্ত জালালাবাদ পাহাড়ে উঠতে পারে নি ইংরেজ সৈন্য বাহিনী । জালালাবাদের যুদ্ধে ইংরেজদের তরফে ক্ষয়ক্ষতি ছিল মারাত্মক । বিপ্লবীদের বধ করতে এসে প্রাণ দেয় প্রায় একশ ব্রিটিশ সৈন্য । স্বাধীনতা আন্দোলনের গোটা পর্বে দেশের সশস্ত্র বিপ্লবীদের হাতে ইংরেজদের তরফে এত ব্যাপক প্রাণহানির দ্বিতীয় নজির ( আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াইয়ের কথা আলাদা ) কিন্তু নেই । 

ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধের দ্বাদশ শহিদ ।

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ব্রিটিশ সিংহের অহমিকায় ভীষণ আঘাত করেছিল । কয়েকজন সামান্য চাটগাঁইয়া বাঙালি যুবকের কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত অপমান কীভাবে ভোলে মহাপরাক্রমশালী ইংরেজ । মাস্টারমাইন্ড সূর্য সেনকে খাঁচায় না পোড়া পযন্ত ওপর‌ওয়ালাদের চাপে রাতের ঘুম‌ হারাম হয়ে গিয়েছিল  অবিভক্ত বাংলার ছোটলাটের । অসংখ্য বাঙালি বিপ্লবীকে ফাঁসিতে চড়িয়েছে ইংরেজ সরকার কিন্তু মৃত্যুর পর কার‌ও প্রতি এতটা প্রতিশোধ নেয় নি যতটা নিয়েছিল সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের বেলায় । ফাঁসির আগেই মারতে মারতে মাস্টারদাকে বেহুঁশ  করে দেয় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারেরা । এক‌ই পরিণতি হয়েছিল সহযোগী তারকেশ্বরের । দু’জন অর্ধমৃতকে  ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিয়ম রক্ষা করেছিল কারা কর্তৃপক্ষ । 

রাত ভোর হ‌ওয়ার আগেই মাস্টার দা আর তারকেশ্বর দস্তিদারের দেহ জেল থেকে বের করে ট্রাকে চাপিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের চার নম্বর জেটিতে নিয়ে যায় পুলিশের একটি বাহিনী। সেখান থেকে দেহ দুটি জাহাজে তুলে বঙ্গোপসাগরের গভীরে নিয়ে গিয়ে লম্বা লোহার শেকলে বেঁধে নিক্ষেপ করা হয় অতল সমুদ্রে । মুহুর্তেই বঙ্গোপসাগরের নোনা জলে তলিয়ে যায় এক বাঙালি বিপ্লবী মহানায়ক ও তাঁর বিশ্বস্ত বীর সহযোদ্ধার ক্ষতবিক্ষত দেহ । ঘটনার সময় উপস্থিত বাঙালি পুলিশ কর্মীদের বয়ান থেকে জানা যায় জাহাজ থেকে ফেলার আগেও দেহ দুটিতে পদাঘাত করেছিল গোরা পুলিশ অফিসারেরা । কত খানি আক্রোশ থাকলে মৃতের প্রতি এমন অবজ্ঞা-অসম্মান সম্ভব ! 

তৎকালীন সংবাদপত্রের শিরোনামে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ।

স্বাধীনতার পর খুব সচেতনভাবে‌ই স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র ধারার ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে । তাই আমাদের ‌জাতীয়বাদী আন্দোলনের কোনও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজ‌ও রচিত হয় নি । চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ শতবর্ষে পৌঁছানোর আগেই এই ঐতিহাসিক বিদ্রোহের ওপর নতুন করে আলোকপাত করতে পারব কি আমরা ? 

Pictures Sources – Archives 






Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *