প্রকৃতির নষ্ট সন্তানের নাম কি ' হোমো স্যাপিয়েন্স ' ? - nagariknewz.com

প্রকৃতির নষ্ট সন্তানের নাম কি ‘ হোমো স্যাপিয়েন্স ‘ ?


                                   উত্তম দেব

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের দাবি বর্তমান পৃথিবীতে অনুজীব,ছত্রাক, উদ্ভিদ এবং প্রাণী মিলিয়ে এক ট্রিলিয়ন প্রজাতি আছে। এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা খেটেখুটে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে মাত্র ২ লক্ষ প্রজাতির জীব গণনা করতে সক্ষম হয়েছেন। পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির পর থেকে বহু লক্ষ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ চিরতরে অবলুপ্ত হয়ে গেছে এবং রোজ যাচ্ছে। জীববিজ্ঞানীরা বলছেন প্রত্যেক বছর পৃথিবী থেকে প্রায়০ হাজার প্রজাতির জীব বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বয়স আনুমানিক ৪.৫৪ বিলিয়ন বছর। সাড়ে তিনশো কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান। হোমিনিড গোত্রের স্তন্যপায়ী প্রাণী মানুষ। আর মানুষের সর্বশেষ গোত্র আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্সের যাত্রা শুরু আনুমানিক মাত্র ২ লক্ষ বছর আগে। আর মানবসভ্যতা বলতে যা বোঝায়।তার বয়স মেরেকেটে ৭০-৮০ হাজারের বেশি নয়। 

পৃথিবীর মতো জীববৈচিত্রে ট‌ইটম্বুর গ্রহ এই ব্রহ্মান্ডে আরও আছে কিনা আমাদের এখন‌ও অজানা। তবে এই অনন্ত মহাজগতে প্রাণের প্রদীপ যে আরও অনেক গ্রহেই জ্বলে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা সে ব্যাপারে মহাকাশ গবেষকদের মনে সংশয় নেই। মানুষ আসার আগেও পৃথিবীতে প্রাণের লীলা ছিল। হোমো স্যাপিয়েন্সের অবলুপ্তির পরেও পৃথিবীতে প্রাণের প্রবাহ বন্ধ হবে না। অন্যান্য জীব-অনুজীবের মতো মানুষ‌ও প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির ভেতরে যে স্বতস্ফূর্ত ইচ্ছাশক্তি প্রবহমান সেই ইচ্ছাশক্তি বা উইল অব নেচার বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মনুষ্য নামক দ্বিপদ প্রাণীর জন্ম দিয়েছে যার দেহের তুলনায় মস্তিষ্কের ওজন এবং পরিসর দুইই বেশি। লিকলিকে ধড়ের উপর দন্ডায়মান তিন পাউন্ড ওজনের মানব মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষ বা নিউরোনের সংখ্যা ৮৬ বিলিয়ন! আর এই প্রাকৃতিক সুপার কম্পিউটারের জোরেই মানুষ ধরিত্রীর সকল প্রাণী থেকে বুদ্ধিমান। 

পৃথিবীতে হোমো স্যাপিয়েন্সের বয়স দুই লক্ষ বছরের বেশি নয়। এরই মধ্যে কি অতি আদরে প্রকৃতির  স্পয়েল্ড চাইল্ডে  পরিণত হয়েছে মানুষ ?

প্রকৃতি জগতের প্রত্যেকটি প্রাণীর ভেতর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি দিয়েছে। অজস্র মানবেতর প্রাণীর শব্দ, গন্ধ এবং দৃষ্টি শক্তি মানুষের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু প্রাকৃতিক শক্তিকে বিনির্মাণ করে নিজের অনুকূলে আনার ক্ষমতা পৃথিবীতে মানুষের একচ্ছত্র। যেদিন থেকে মানুষ অগ্নি প্রজ্জ্বলনের কৌশল রপ্ত করল সেই দিন থেকেই মানুষ নিজের স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির জন্য প্রকৃতিকে ব্যবহার করতে শিখল। এরপর মানুষ পশুচর্ম , বৃক্ষবল্কল গায়ে চড়িয়ে দেহের আরাম এবং সুরক্ষা দুইই বৃদ্ধি করল। মৃত পশুর হাড় এবং পাথর ঘষে হাতিয়ার তৈরি করল। যে মাটির উপর মানুষের আশ্রয় সেই মাটিকেই তালগোল পাকিয়ে নিজের ব্যবহারসামগ্রী বানালো। গুহা ছেড়ে বেরিয়ে মানুষ যেদিন মাটির উপর বসত গড়া শিখে নিল সেদিনই মানুষ প্রকৃতির আশ্রয় ছেড়ে নিজের সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের পথে যাত্রা শুরু করল। যেদিন মানুষ ভূমিখন্ডের উপর স্বত্ব আরোপ করতে আরম্ভ করে দিল সেদিন থেকে প্রকৃতিকে শুধু নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার নয় প্রকৃতিকে দখল করতে শুরু করে দিল মানুষ। পৃথিবীতে আর কোনও প্রাণী সজ্ঞানে ভূমির উপর স্বত্ব বা মালিকানা কায়েম করতে জানে না। 

একদিন মানুষ ইতর প্রাণীকে বাগে এনে তার শক্তিকে নিজের কাজে লাগিয়ে দিল। পশু মানুষের ভার ব‌ইতে শুরু করল । এবং পশুর পিঠে চেপে স্থানান্তরে গমন করে পথের শ্রম লাঘব করার কৌশল‌ও রপ্ত করে ফেলল। মানুষ ক্রমে কাষ্ঠখন্ডকে গোলাকার আকৃতি দিতে শিখল। এবং গোলাকার কাষ্ঠখন্ড একসময় চাকায় পরিণত হল। যেদিন মানুষ চাকার উপর চাপতে শুরু করল সেদিন থেকেই প্রাকৃতিক গতির সমান্তরাল মানুষ নিজের গতিতেও গড়াতে শুরু করল। ক্রমে চারটে চাকার উপর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তাকে গতিশীল পশুর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে রথ তৈরি করল মানুষ। সমগ্র মানবসভ্যতাই একটি রথের সঙ্গে তুলনীয়। সভ্যতার রথে চেপেই হোমো স্যাপিয়েন্স আজ এতদূর পর্যন্ত এসেছে। মানুষের এই অগ্রগমন , মানুষের এত উদ্ভাবন । এর সকল উৎস মানুষের বুদ্ধি। যা ৮৬ বিলিয়ন নিউরন থেকে উৎসারিতএই স্নায়ুপুঞ্জ মানুষের নিজের হাতে গড়া কোন‌ও জৈব কম্পিউটার নয়। প্রকৃতির বিবর্তনে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভাসিত। 

জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ১২ লক্ষ প্রজাতির জীবের অস্তিত্ব গণনা করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা ।

        

সভ্যতার উষাকাল থেকেই মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের মতো করে রূপান্তরের কৌশল শিখলেও প্রকৃতিকে নিংড়ে নেবার প্রযুক্তি মানুষের দীর্ঘকাল জানা ছিল না। সভ্যতার আদি থেকেই বুদ্ধি ব্যয় করে যন্ত্রের উদ্ভাবন করেছে মানুষ। যন্ত্রের ব্যবহার মানুষের হাতের কাজকে সহজ ও দ্রুত করেছে। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের আগে পর্যন্ত সভ্যতা যন্ত্রনির্ভর হয়ে ওঠে নি। ভূগর্ভ থেকে কয়লা উত্তোলন। লোহার ব্যাপক প্রচলন । বাষ্পীয় শক্তির উদ্ভাবন। এবং পুঁজির সম্প্রসারণ শিল্পবিপ্লবের অবদান। শিল্পবিপ্লব থেকেই প্রকৃতিকে নির্মমভাবে দহন শুরু করল হোমো স্যাপিয়েন্স । 

প্রকৃতির স্বাভাবিক জীবনচক্র থেকে মানবসভ্যতার গতিপথ আজ অনেকটাই পৃথক। প্রকৃতির সহজাত গতি এবং মানবসভ্যতার বেগ পরস্পরের পরিপূরকের পরিবর্তে ভীষণভাবে প্রতিস্পর্ধী । আজ এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে সভ্যতার বিকাশ মানে প্রকৃতির অনিবার্য বিনাশ। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্টের নাম করে অজস্র প্রাণীকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিয়েছে মানুষ। প্রকৃতি প্রদত্ত খাদ্যশৃঙ্খল মেনে জীবজগতে এক প্রাণী আরেক প্রাণীর স্বাভাবিক আহার। কিন্তু দ্বিপদী মনুষ্য বাদে আর কোনও প্রাণী তা সে যত হিংস্র‌ই হোক অন্য প্রাণীর অবলুপ্তির হেতু নয়। 

মানব সভ্যতা আর প্রকৃতি যেন পরস্পরের প্রতিপ্রক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

সব দেখেশুনে মাঝেমাঝে মনে হয় সভ্যতা নামক বুলেট ট্রেনের ব্রেক বুঝি ফেল করেছে। চালকের আসনে আসীন মানুষ অসহায়। কোটি কোটি ডলার খসিয়ে বিশ্বনেতারা বসুন্ধরা সম্মেলন বসিয়ে। কত রকমের আন্তর্জাতিক প্রোটোকলে স্বাক্ষর করে। দেশে দেশে শতশত লোকলস্কর নিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গড়েও ধরার দূষণ‌ একছটাক‌ও কমানো যায় নি । শেষে ব্যাক্টেরিয়ার থেকেও ক্ষুদ্রতর এক অদৃশ্য ঘাতকের সন্ত্রাসে নাকানিচোবানি খেতে খেতে কূলকিনারা পাচ্ছে না দিশেহারা মানুষ ।

অণুজীবের কাছে দর্প চূর্ণ হতে বসেছে অহঙ্কারী মানুষের ।

অতি আদরে ধনীর দুলাল স্পয়েল্ড চাইল্ড হয়। মানুষ‌ও কি প্রকৃতির অতি আদরে স্পয়েল্ড চাইল্ড নয় ? অনন্ত বিশ্বপ্রকৃতিতে নিরন্তর চলছে শক্তির অনন্ত স্ফূরণ । মানুষের মস্তিষ্ক সেই শক্তির‌ই শরিক এবং অংশীদার। সুখ দুঃখের অনুভূতি , বংশবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা , আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি জগতের প্রায় সকল প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টির সৌন্দর্য সজ্ঞানে অনুভব করে বিস্ময়ে অভিভূত হ‌ওয়ার ক্ষমতা একান্ত‌ই মানুষের। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর সহজাত অনবদ্যতায় – তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর তুমি তাই এসেছ নীচে/ আমায় ন‌ইলে ত্রিভুবনেশ্বর , তোমার প্রেম হত যে মিছে / আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা / মোর জীবনে বিচিত্র রূপ ধরে তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে ।আসলে মানব জীবনের প্রকৃত সার্থকতা মহাজগতের সঙ্গে স্বীয় একাত্মতা অনুভবে। প্রকৃতির ওপর আত্মঘাতী প্রভুত্ব বিস্তারে নয় ।


Photo Credits – Phantom Forest , Financial Times , Shutterstock , Japan Times and The Conversation . 



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *