বিশেষ প্রতিবেদন : বছর দেড়েক হল চেন্নাইয়ের এক বৃদ্ধাবাসের নিভৃতে নীরবে জীবনের রঙ্গশালা থেকে চিরকালের মতো প্রস্থান করেছেন তিনি । কিন্তু দেশে নির্বাচন আসলে তাঁর নাম ওঠে । এবারও উঠেছে । ভবিষ্যতেও উঠবে। তাঁর নাম তিরুনেল্লাই নারায়ণ আইয়ার শেষন । ভারত তাঁকে চেনে টি এন শেষন নামে । ১৯৫৫ ব্যাচের এই আইএএস ক্যাডার নিজের সুদীর্ঘ আমলা জীবনে ক্যাবিনেট সচিব সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করলেও ইতিহাস হয়ে থাকবেন ভারতের দশম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ( চিফ ইলেকশন কমিশনার ) হওয়ার সুবাদে ।
টি এন শেষন । একাধারে নন্দিত এবং নিন্দিত । যে কারণে এই এক বগ্গা তামিল ব্রাহ্মণ দেশের জনগণ দ্বারা নন্দিত সেই একই কারণে জীবদ্দশায় রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন তিনি । শেষনকে বলা হয় ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারক । এমন নয় যে শেষনের আগে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থা বা ইলেক্টোরাল সিস্টেমের কোনও গ্রহণযোগ্যতাই ছিল না জনগণের কাছে । ভারতের সংবিধান রচয়িতাদের দূরদর্শিতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই । স্বশাসিত সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের হাতে সংবিধানের ৩২৪ থেকে ৩২৯ অনুচ্ছেদের ভেতর যথেষ্টই রক্ষাকবচ দিয়েছিলেন তাঁরা । টি এন শেষনের আগেও অনেক যোগ্য মানুষ চিফ ইলেকশন কমিশনারের চেয়ারে বসেছেন । শেষনের আগেও জনগণ যা চেয়েছে ভোটে তারই সার্থক প্রতিফলন ঘটেছে এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে ।
গণতন্ত্রের শুদ্ধিকরণ করতে গিয়ে নেতাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন টি এন শেষন । |
ভারতের বহুদলীয় গণতন্ত্রে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের সূত্রপাত ১৯৫২ সালে । এর ঠিক পাঁচ বছর পরেই কেরল রাজ্যে ভোটে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে পরাস্ত করে সরকার গঠন করে কমিউনিস্টরা । পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জনগণের ভোটে নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকার গঠনের নজির সৃষ্টি করেছে কিন্তু বহু সমালোচিত ভারতীয় গণতন্ত্রই । মাত্র দশ বছরের একটি শিশু গণতন্ত্রে অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সির কারণে ভোটে সরকার উল্টে যাচ্ছে এটা কম কথা নয়। বরং বলা চলে ভারতীয় গণতন্ত্র ঊষালগ্নেই বুঝিয়ে দিয়েছিল কাকে বলে জনগণের শক্তি । প্রথম বহুদলীয় নির্বাচনের মাত্র বিশ বছরের মাথায় ১৯৬৭ সালে দেশের নয়টি রাজ্যে কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছিল জনগণের ভোটে। ৭৪ বছরের ভারতীয় গণতন্ত্রে এযাবৎকালের সবথেকে ল্যান্ডমার্ক ইভেন্টটি ঘটেছিল ১৯৭৭ এর বসন্তে।তখন স্বাধীন ভারতের বয়স মাত্র তিরিশ । সেটা ছিল সংবিধান প্রবর্তনের ২৬ তম বছর । দেশে বহুদলীয় নির্বাচন চালু হওয়ার মাত্র ২৫ বছর পরে স্রেফ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই একটি স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল ভারতের দারিদ্র পীড়িত , নিত্য লাঞ্ছিত জনগণ । দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিতান্তই টুটাফুটা , অকার্যকর হলে , নির্বাচন কমিশনাররা শাসকদলের আজ্ঞাবহ দাস হলে এইসব ঘটনা ঘটতই না । কিন্তু তারপরেও ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রি-শেষন ও পোস্ট-শেষন যুগে ভাগ করা হয়। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের চেয়ারে বসে টি এন শেষন নতুন কিছুই করেন নি । আবার কম কিছুও ঘটান নি । সংবিধান নির্বাচন কমিশনের হাতে যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার দ্বারা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষমুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এই দুঁদে আমলা। এবং এটা করতে গিয়েই বারেবারে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন তিনি । এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের জয় ছিনিয়ে এনেছেন একরোখা মানুষটি । টি এন শেষনের আগে দেশের আর কোনও মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে গিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শোধরানোর ঝুঁকি নেন নি । শেষন পূর্ববর্তী যুগে চাকরির পরীক্ষায় জিকের বাইরে চিফ ইলেকশন কমিশনারের নাম নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামাতো না মানুষ । এমনকি মিডিয়াতেও সিইসির নাম উচ্চারিত হত কালেভদ্রে ।
ইতিহাসের কী বিচিত্র খেয়াল ! চন্দ্রশেখরের মতো রাজনীতিকের জন্য যা ছিল প্রমাদ দেশের গণতন্ত্রের জন্য তাই হয়ে উঠল পরম আশীর্বাদ । নির্বাচন পরিচালনায় অনমনীয়তার জন্য নেতাদের চক্ষুশূল হলেও জনগণের কাছে শেষন হয়ে উঠলেন আইকন ।
টি এন শেষন ছিলেন জেদি , একরোখা অথচ ঠান্ডামাথা । ছিলেন ঠোঁটকাটা , স্পষ্টবক্তা কিন্তু রসবোধের অভাব ছিল না তাঁর । নজর ছিল তীক্ষ্ণ , লক্ষ্যে থাকতেন অবিচল । একজন আমলা হিসেবে শেষনের সবথেকে বড় গুণ ছিল তিনি আইনটা খুব ভালো বুঝতেন এবং সংবিধান গুলে খেয়েছিলেন । কিন্তু তারপরেও স্বীয় চরিত্রে সৎ সাহসের অভাব থাকলে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একের পর এক ঝাঁকুনি দিতে পারতেন না টিএন শেষন ।
১৯৯০ এর ১২ ডিসেম্বর দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার পদে ভি এস রামাদেবীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন টি এন শেষন। কেন্দ্রে তখন চন্দ্রশেখরের জামানা । রাজীব গান্ধীর বদান্যতায় কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে জীবনের বহু আকাঙ্খিত সাধটি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও পূর্ণ করতে পেরেছিলেন চন্দ্রশেখর । ঠিক কার পরামর্শে সিইসি পদে শেষনের নাম সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর তা স্পষ্ট নয় । তবে অনেকেই ধারণা করেন এর পেছনে রাজীব গান্ধীর প্রভাব ছিল । নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শেষনের খিটিমিটি যখন প্রায় নিত্যদিন মিডিয়ার খোরাক তখন চন্দ্রশেখরকে বলতে শোনা গিয়েছে , প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার সবথেকে বড় ভুল সিইসি পদে টি এন শেষনের নাম সুপারিশ করা ।
ইতিহাসের কী বিচিত্র খেয়াল ! চন্দ্রশেখরের মতো রাজনীতিকের জন্য যা ছিল প্রমাদ দেশের গণতন্ত্রের জন্য তাই হয়ে উঠল পরম আশীর্বাদ । নির্বাচন পরিচালনায় অনমনীয়তার জন্য নেতাদের চক্ষুশূল হলেও জনগণের কাছে শেষন হয়ে উঠলেন আইকন । ছাপ্পা , বুথ দখল , বুথ জ্যাম , ভুয়ো ভোটার , বলপ্রয়োগ করে মানুষকে ভোটদান থেকে বিরত রাখা , টাকা-মদ ছড়িয়ে ভোট কেনা সর্বোপরি হিংসা ছিল দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার অঙ্গ । দক্ষিণের রাজ্য গুলিতে বরাবরই ভোটে ছাপ্পা এবং হিংসা কম হত সেখানে মদ আর টাকা ছড়িয়ে গরীব লোকের ভোট কেনার রেওয়াজ ছিল বেশি। উত্তর ভারত জুড়ে ছাপ্পা এবং হিংসা ছিল ভয়ঙ্কর । বিহার-ইউপিতে ভোট ঘিরে সহিংসতায় চল্লিশ -পঞ্চাশ জন করে মানুষের মৃত্যু ঘটত । সিইসির দায়িত্ব পেয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিদ্যমান অরাজকতা দূর করতে একের পর নির্দেশ জারি করতে থাকলেন শেষন । সংবিধান প্রদত্ত এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে তিনি নতুন কিছুই করেন নি । এই কারণেই অপছন্দ হলেও শেষনের নেওয়া পদক্ষেপ গুলোর বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি রাজনৈতিক দল গুলো । ভোটের সময় আদর্শ আচরণ বিধি কী জিনিস আমরা জানতাম না । প্রথমবারের মতো তা লাগু করেন টিএন শেষন । কোনও সন্দেহ নেই টি এন শেষন গৃহীত সিদ্ধান্ত গুলোর মধ্যে সবথেকে নির্ণায়ক সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র বা ইলেকশন ফটো আইডেন্টিটি কার্ডের ( EPIC ) প্রচলন ।
সচিত্র ভোটার কার্ড প্রণয়নের প্রশ্নে শেষন ছিলেন আপোসহীন । |
সচিত্র ভোটার কার্ড চালু করাটাকে একটি ধর্মযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছিলেন টিএন শেষন । এপিক নিয়ে শেষনের পরিকল্পনায় যত রকমের বাগড়া দেওয়া সম্ভব তার সবই করেছিল বিভিন্ন রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল ও সরকার । সেই সময় বিহারে স্বচ্ছতার সঙ্গে ভোট পরিচালনা ছিল নির্বাচন কমিশনের জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ । সচিত্র পরিচয়পত্র চালুতে সবথেকে বেশি বাধা এসেছিল লালুপ্রসাদ যাদবের কাছ থেকে । এড়ে শেষনের সঙ্গে পেড়ে না উঠে লালু শেষে বলে বসলেন , পরপুরুষেরা ঘুঙ্ঘুট খুলিয়ে দেহাতি ঘরের মেয়ে-বউদের ফটো তুলবে তাও আবার হয় নাকি । সাংবাদিকেরা শেষনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই জ্যোতি বসু বলতেন , ও একটা পাগল । যদিও সব বাধা অতিক্রম করে , নেতাদের কটূক্তি-বিষোদগার জামার আস্তিন থেকে ধুলো ঝাড়ার মতো করে ঝেড়ে ফেলে পদে আসীন থাকতে থাকতেই সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র প্রণয়নের কাজটি প্রায় নব্বই শতাংশ সেরে ফেলেছিলেন টি এন শেষন ।
টি এন শেষনের আমলেই ভোটে অনিয়মের ১৫০টি তালিকা প্রস্তুত করেছিল নির্বাচন কমিশন । ১৯৯৫ সালে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে লালুপ্রসাদ যাদবকে , ১৯৯৬ এ তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে জয়ললিতাকে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছেড়েছিলেন শেষন । শেষনের নাম শুনলেই সেই সময় গাত্রদাহ হত দু’জনের । টিএন শেষনের কারণে আরও একটি বড় পরিবর্তন হয়েছিল জাতীয় নির্বাচন কমিশনের পরিকাঠামোয় । যদিও তাতে শেষনের সায় ছিল না । শেষনের দাপটে নাজেহাল হতে হতে শেষে তাঁর ডানাছাঁটার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রের নরসিমা রাও সরকার । এতে সম্মতি ছিল কমবেশি সব রাজনৈতিক দলের । শেষনের আগে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ছিল এক সদস্যের সংস্থা । ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে নির্বাচন কমিশনকে বহু সদস্য বিশিষ্ট আয়োগে পরিণত করে সরকার । এম এস গিল ও জিভিজি কৃষ্ণমূর্তি নামে দু’জন আমলাকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিযুক্ত করেন রাষ্ট্রপতি । বিষয়টি মেনে না নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের শরণাপন্ন হন শেষন । যদিও দীর্ঘ শুনানি শেষে সরকারের সিদ্ধান্তকেই বলবৎ রাখে আদালত ।
নির্বাচন কমিশনে নতুন যুগের সূচনা করে দিয়েই বিদায় নেন টি এন শেষন । |
ছয় বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৬এর ১১ ডিসেম্বর মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে অব্যাহতি পান শেষন । টি এন শেষনের ওপর প্রতিশোধ নিতে রাজনৈতিক দল পরিচালিত শাসন বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে একমাথার সংস্থা থেকে বহুমাথার সংস্থায় পরিণত করলেও শেষন নামক গোলগাল স্থূলকায় মানুষটি নির্বাচন কমিশনের ভেতরে যে আত্মবিশ্বাস ও শক্তির সঞ্চার করে দিয়ে গেলেন তার ফলশ্রুতিতে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থা অনেকাংশে কলুষমুক্ত হল । কমিশনের কঠোরতায় নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব বন্ধ না হলেও পেশি শক্তির আস্ফালন যে নিয়ন্ত্রণে এসেছে এর জন্য টি এন শেষনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকতে হবে ভারতের ভোটাদাতা নাগরিকবৃন্দকে ।
আরেক প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএস কৃষ্ণমূর্তি তাঁর Miracle of Democracy: India’s Amazing Journey নামক বইটিতে শেষন সম্পর্কে লিখেছেন , ‘ যদি কোনও দিন নির্বাচন কমিশনের ইতিহাস লেখা হয় তবে তাকে দুটি ভাগে ভাগ করতে হবে । একটি প্রি-শেষন যুগ , যখন কমিশন সরকারেরই একটি বিভাগ হিসেবে কাজ করত । আরেকটি পোস্ট-শেষন যুগ , যখন কমিশন অনেক বেশি স্বতন্ত্র হয়ে উঠল । ‘
Photo Credit – The Hindu , The Federal / twitter , The Indian Express