বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে মসজিদের মাইকে ডেকে লোক জড়ো করে হিন্দু গ্রামে হামলা , মারধর , মন্দিরের বিগ্রহ নষ্ট , বাড়ি ভাঙচুর , ঘরে ঘরে লুটপাট - nagariknewz.com

বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে মসজিদের মাইকে ডেকে লোক জড়ো করে হিন্দু গ্রামে হামলা , মারধর , মন্দিরের বিগ্রহ নষ্ট , বাড়ি ভাঙচুর , ঘরে ঘরে লুটপাট


সুনামগঞ্জ,১৭ মার্চ,২০২১ : বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ দৈনন্দিন ঘটনা মাত্র । এমনকি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনেও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই মিলল না হিন্দুদের । ১৭ মার্চ সকালে গোটা বাংলাদেশ যখন  বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে মাতোয়ারা তখন সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা চালিয়ে  বাড়িঘর ভেঙে তছনছ করল হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের অনুগামীরা । 

হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক: ওয়াজে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েও আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে ।

  ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে মামুনুল হককে অপমান করা হয়েছে এই অভিযোগে বুধবার সকালে মসজিদের মাইকে ডেকে লোক জড়ো করে হিন্দু গ্রামে আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে । মসজিদের মাইকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাচনি, চন্ডিপুর , সন্তোষপুর , সরমঙ্গল , শোল্লার  এবং কাশিপুর গ্রাম থেকে কয়েক হাজার লোক  লাঠিসোটা এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে এসে পাশের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াপাড়ায় চড়াও হয় বলে অভিযোগ । হাতের কাছে যাদের পায় তাদেরকেই  মামুনুল হকের উন্মত্ত সশস্ত্র অনুসারীরা মারধর করতে শুরু করে । বহু গ্রামবাসী ভয়ে পালিয়ে যায় । ঘরে ঘরে ঢুকে মহিলাদের‌ও পেটাতে থাকে হিংস্র জনতা । একাধিক বাড়ি ভেঙে তছনছ করা হয় । ঘরের আসবাবপত্র‌ও ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। মহিলাদের গলায় অস্ত্র ঠেকিয়ে হেফাজত ইসলামের সদস্যরা সোনার গয়না , টাকাপয়সাও লুটপাট করে বলে নিগৃহীত গ্রামবাসীদের অভিযোগ । 

মামুনুল হকের অনুগামীদের হাতে আক্রান্ত সংখ্যালঘু নারী এবং সংখ্যালঘুর লুটপাট হয়ে যাওয়া ঘরদোর ।

  ঘটনার সূত্রপাত ১৫ই মার্চ দিরাইয়ে অনুষ্ঠিত মামুনুল হকের একটি ওয়াজ মাহফিল থেকে । ওয়াজ মাহফিলে মামুনুল হক হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা উদ্রেককারী কথাবার্তা বলেন বলে অভিযোগ । এই নিয়ে শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের বছর‌ পঁচিশের যুবক ঝুমন দাস ফেসবুকে প্রতিবাদ জানালে মামুনুল অনুগামীরা ক্ষেপে যান । ঝুমন দাসের ফেসবুক পোস্টের উছিলায় মামুনুল হকের লোকেরা গ্রাম আক্রমণ করবে এটা অনুমান করতে পেরে ঝুমনকে নিজেরাই পুলিশের হাতে তুলে দেন নোয়াগাঁও গ্রামের মুরুব্বীরা ।  কিন্তু তারপরেও মামুনুল হকের অনুগামীদের শান্ত করতে ব্যর্থ হন অসহায় সংখ্যালঘুরা । বুধবার সকাল থেকেই আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের মসজিদের মাইকে প্ররোচনা দিয়ে লোক জড়ো করার কাজ শুরু হয়ে যায় । গ্রামের পর গ্রাম থেকে দলে দলে লোক রামদা , কিরিচ , চাপাতি , বল্লম এবং লাঠিসোটা হাতে বেরিয়ে আসে । মালাউনের বাচ্চারা তরা আমাগো হুজুররে অসম্মান করছস , তদের আইজ ছাড়তাম না ‘ – এইভাবে হুঙ্কার দিতে দিতে উন্মত্ত জনতা গ্রামের বাড়ি বাড়ি আক্রমণ করে বলে আক্রান্তরা জানিয়েছেন । ঘটনার সময় ধারেকাছে কোন‌ও পুলিশ দেখা যায় নি । পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। গ্রামের মোট ৮৮টি বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে আক্রান্তরা । গ্রামের মন্দির এবং আক্রান্তদের ঠাকুরঘর‌ও উন্মত্ত জনতার রোষ থেকে রেহাই পায় নি । মন্দিরের বিগ্রহ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা । ঝুমন দাস নামে যে যুবকের ফেসবুক পোস্ট ঘিরে মামুনুর অনুগামীদের তান্ডব বাড়িতে ঢুকে তাঁর স্ত্রীকে মারধর করে তারা । ঝুমনের স্ত্রী সুইটি রানী দাসের গলায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ঘরে থাকা ৪৮ হাজার টাকা , গলার চেইন সহ অন্যান্য সোনার গয়না লুঠ করে হামলাকারীরা । 

হিন্দু গ্রাম আক্রমণের উদ্দেশ্যে জড়ো হওয়া হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা ।


  গ্রামের হিন্দু মুক্তিযোদ্ধারা পর্যন্ত হেফাজতে ইসলামের লোকদের হাত থেকে রেহাই পান নি । ‘ মালাউনের বাচ্চা । তরা কিয়ের মুক্তিযুদ্ধা । আমাগো হুজুরকে অপমান করছস । এতদিন মুক্তিযুদ্ধা ব‌ইল্যা তরারে বাইচ দিতাম । আইজ আর তরারে ছাড়তাম না ।’ এইভাবে অশ্রাব্য  গালিগালাজ করতে করতে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি হামলা চালানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানিয়েছেন । বুধবার সকালে হেফাজতে ইসলামের হামলায় হিন্দু গ্রাম তছনছ হয়ে যাওয়ার পরেও বিকেল পর্যন্ত ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায় নি । স্থানীয় প্রশাসন হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিলেও প্রশাসনের আশ্বাসে আর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা । গোটা গ্রাম ভয়ে আতঙ্কে সিঁটিয়ে রয়েছে বলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা দেখতে পেয়েছেন । গ্রামের বয়স্ক হিন্দুরা কপাল চাপড়ে নিজেদের ভাগ্যকেই দোষ দিচ্ছেন । কীভাবে তাঁকে ‌মারধর করা হয়েছে অশ্রুসজল কন্ঠে সাংবাদিকদের সামনে বর্ণনা দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিলচন্দ্র দাস । 

সুনামগঞ্জের আক্রান্ত হিন্দুদের তছনছ হয়ে যাওয়া  বাড়িঘর ।


  মাস তিনেক আগে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের বিতর্কিত নেতা মামুনুল হক । এই নিয়ে সেই সময় কম তোলপাড় হয় নি বাংলাদেশ । বাংলাদেশের বর্তমান সরকার হেফাজতে ইসলামের প্রতি নরম বলেও অভিযোগ ওঠে রাজনৈতিক মহলে । বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিল গুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়  , নারী ও সমাজের উদারপন্থীদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কথাবার্তা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে বলে অভিযোগ । ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা উদ্রেক বন্ধে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রশাসন কোন‌ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নি বলে  মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের  সংগঠন গুলির অভিযোগ । 



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *