চৈতন্য সম্ভব - nagariknewz.com

চৈতন্য সম্ভব


 

চৈতন্য মহাপ্রভুকে না জানলে বাঙালি জাতির চৈতন্যের আদি-অন্ত-ভূত-ভবিষ্যৎ – কোনও কিছুর‌ই সন্ধান পাব না আমরা । উত্তাল নদী পেরোতে একদল যাত্রীর যেমন নৌকায় একজন দক্ষ কান্ডারীর প্রয়োজন তেমনি ইতিহাসের ঝঞ্ঝা -বিক্ষুব্ধ‌ দরিয়া পেরোতে একটি জাতির‌ও একজন দক্ষ কান্ডারীর প্রয়োজন। শচীমাতার আদরের দুলাল , নদের দামাল নিমাই চৈতন্য মহাপ্রভু বাঙালি জাতির সেই কান্ডারী । তিনি হাল না ধরলে মধ্যযুগের ঘোর অমানিশায় বাঙালিকে ইতিহাসের গাঙ পার করাতো কে ? ৫৩৫ তম শুভ আবির্ভাব তিথিতে বাঙালির সর্বাধিনায়ককে যেভাবে বিশ্লেষণ করলেন ডঃ তমাল দাশগুপ্ত 

লা হয়, চৈতন্যের দীর্ঘকাল গর্ভবাস হয়েছিল। সে কাহিনীটি প্রায় অলৌকিক, তিনি নাকি শচীমাতার জঠরে ত্রয়োদশ মাস অতিবাহিত করেন, অমিয় নিমাই চরিত জানাচ্ছে। আমি বলতে চাই বাঙালির ইতিহাস চৈতন্যসম্ভবের জন্য প্রায় পাঁচশো বছর ধরে অপেক্ষারত ছিল, সেই পালযুগে সহজযানের উত্থানের সময় থেকেই। চৈতন্যসম্ভব গৌড়ের ইতিহাসজননীর এক সুদীর্ঘ gestation-এর ফসল। বাঙালির ঝঞ্ঝাময় মধ্যযুগের অমারাতে বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হয়ে চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল। চৈতন্য আবির্ভাব বাঙালির ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রভা। বাঙালির নিয়তি দ্বারা পূর্বনির্ধারিত ছিলেন চৈতন্য, এই জাতি গৌরচন্দ্রের অপেক্ষায় ছিল, গোরা রায়ের আবাহনে সদানিষ্ঠ ছিল। আমি সামান্য মানুষ, আমি সাতদিন ধরে বাঙালির সপ্তসম্ভব লেখার ব্রতে ব্রতী হয়েছিলাম, আজ চৈতন্যসম্ভব লিখে আমার ব্রত শেষ করব। 

মিত্ররা হ্লাদিত হোন, শত্রুরা তটস্থ হোন, আর পূর্বমানুষরা আমায় আশীর্বাদ করুন। মা কালী আমার দুর্বল লেখনীকে শক্তি দিন, চৈতন্যনামে অশ্রুসিক্ত বাষ্পাচ্ছন্ন আমার দুই নয়নে রাধারাণী দৃষ্টি হয়ে অবতীর্ণ হোন, নতুবা এ কাজে তো আমার সাধ্য হয় না।

চৈতন্যর মধ্যে বিপ্লবী খুঁজে পায় জনআন্দোলনের জয়ধ্বনি আর রক্ষণশীল খুঁজে পায় আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শিখর। নাস্তিক এই আন্দোলনে মানব অস্তিত্বের অবলম্বন খুঁজে পায় আর আস্তিক এই আন্দোলনে পায় ঈশ্বরের বিভূতি। একাধিক কমিউনিস্ট নেতা চৈতন্যর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন গৌড়বঙ্গের প্রথম কমিউনিস্ট, আর গান্ধী স্বয়ং চৈতন্য আন্দোলনে খুঁজে পেয়েছিলেন মধ্যযুগের প্রথম অহিংস আন্দোলনের নজির। চৈতন্যস্মরণে রত হন যুক্তিবাদী থেকে ভাববাদী, লিটল ম্যাগ থেকে আনন্দবাজার, কফি হাউজ থেকে বটতলা, পণ্ডিত থেকে অজ্ঞ। তাঁর নামে ভজ গৌরাঙ্গ বলে উদ্বাহু নৃত্য করেছে সাহেব, আর অতীতে সাহেব তাড়িয়ে ভারত স্বাধীন করতে যাওয়া আত্মঘাতী বাঙালি জঙ্গী। ব্রাহ্মণ আর চণ্ডাল এই চৈতন্য আন্দোলনে পরস্পরের হাত ধরে নৃত্য করেছে। চৈতন্যের নামে এই আন্দোলনে কবির সঙ্গে অকবির আঁতাত হয়, কেজোর সঙ্গে অকেজোর মিত্রতা হয়। এই আন্দোলন সমস্ত গৌড়বঙ্গীয়ের মহামিলনমেলা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির অভিজ্ঞান।

যে নবদ্বীপে চৈতন্য অবতীর্ণ, সে নবদ্বীপ তখন ভারতশ্রেষ্ঠ, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সারস্বত পীঠস্থান। জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনচর্চায় নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য ছিল। মধ্যযুগের অন্ধকারে নবদ্বীপের এই সুতীব্র আলোকচ্ছটাকে বঙ্কিম বাঙালির প্রথম রেনেসাঁস আখ্যা দিয়েছিলেন। 

আমাদিগেরও একবার সেই দিন হইয়াছিল। অকস্মাৎ নবদ্বীপে চৈতন্যচন্দ্রোদয়; তার পর রূপসনাতন প্রভৃতি অসংখ্য কবি ধৰ্ম্মতত্ত্ববিৎ পন্ডিত। এ দিকে দর্শনে রঘুনাথ শিরোমণি, গদাধর, জগদীশ; স্মৃতিতে রঘুনন্দন, এবং তৎপরগামিগণ। আবার বাঙ্গালা কাব্যের জলোচ্ছ্বাস। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, চৈতন্যের পূর্বগামী। কিন্তু তাহার পরে চৈতন্যের পরবর্ত্তিনী যে বাঙ্গালা কৃষ্ণবিষয়িণী কবিতা, তাহা অপরিমেয় তেজস্বিনী, জগতে অতুলনীয়া; সে কোথা হইতে ? আমাদের এই Renaissance কোথা হইতে ? কোথা হইতে সহসা এই জাতির এই মানসিক উদ্দীপ্তি হইল? ‘

সেযুগের ভারতে বাসুদেব সার্বভৌম বোধকরি শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত-দার্শনিক-নৈয়ায়িক, পরে ইনি পুরীতে চলে যান। নীলাচলে মহাপ্রভুর আগমনের জমি প্রস্তুত হয়েছিল এতদ্বারা। বাসুদেব রচিত এই বিখ্যাত শ্লোকটি রমাকান্ত চক্রবর্তীর বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মে উদ্ধৃতঃ 

‘ কণাদের দর্শন পড়েছি। ন্যায়শাস্ত্র আমার জানা আছে। মীমাংসাও জানি। জানি সাংখ্য। যোগশাস্ত্রের সঙ্গেও পরিচয় আছে। যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে বেদান্তের চর্চা করেছি। এ সবের কোনওটাই আমার মনকে তেমনভাবে টানে না, যেমন টানে কোনও এক নন্দের ছেলের বাঁশরীর মাধুরী ধারা । ‘

চৈতন্য আন্দোলন পাণ্ডিত্যের বিরোধী নয়, কিন্তু অবভাস প্রশ্রয় দেয় না। চৈতন্যর ভক্তি আন্দোলন ঋজু ও স্পষ্টবক্তা, সেজন্য নব্যন্যায়ের দাঁতভাঙা পাণ্ডিত্যকে পাষণ্ডী আখ্যা দেওয়া হয় এই আন্দোলনে (রমাকান্ত চক্রবর্তী)। চৈতন্য আন্দোলন জ্ঞানমার্গের বিরোধী নয়, তবে সহজিয়া লোকায়ত চেতনা বরাবরই জ্ঞানমার্গের নামে অবভাসের যথেচ্ছাচারের বিরোধী। কারণ চৈতন্যর উত্থান বাঙালির মধ্যযুগের প্রথম জন আন্দোলন, আর অবভাসের প্রধান উদ্দেশ্য গণমানুষকে বিভ্রান্ত করা।

 

চৈতন্যর মধ্যে বিপ্লবী খুঁজে পায় জনআন্দোলনের জয়ধ্বনি আর রক্ষণশীল খুঁজে পায় আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শিখর। নাস্তিক এই আন্দোলনে মানব অস্তিত্বের অবলম্বন খুঁজে পায় আর আস্তিক এই আন্দোলনে পায় ঈশ্বরের বিভূতি। একাধিক কমিউনিস্ট নেতা চৈতন্যর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন গৌড়বঙ্গের প্রথম কমিউনিস্ট, আর গান্ধী স্বয়ং চৈতন্য আন্দোলনে খুঁজে পেয়েছিলেন মধ্যযুগের প্রথম অহিংস আন্দোলনের নজির । 


চৈতন্য আন্দোলন বনমালীর পরজন্মে রাধা হওয়ার আন্দোলনও বটে। সেজন্য এ আন্দোলন পুরুষতান্ত্রিকতাকে সমূলে আঘাত করে। সহজিয়া সাম্যের চেতনা শুধু তাত্ত্বিক স্তরে নয়, ব্যবহারিক স্তরেও ছিল। অসংখ্য নারী, অসংখ্য অব্রাহ্মণ গুরুপদে আসীন হয়েছেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনে, এ আন্দোলনের মধ্যে স্থানে স্থানে (উদাহরণস্বরূপ অদ্বৈত অনুগামীদের) ব্রাহ্মন্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক ঝোঁক সত্ত্বেও। একটি বহুল প্রচলিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী চৈতন্যের ৪৯০ জন পরিকরের মধ্যে ২৩৯ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ, ৩৭ জন বৈদ্য (প্রসঙ্গত চৈতন্যের দীক্ষাগুরু ঈশ্বরপুরী এবং চৈতন্যের প্রথম জীবনীকার, চৈতন্যপরিকর মুরারিগুপ্ত, দুজনেই জাতিতে বৈদ্য), ২৯ জন কায়স্থ, ৬ জন স্ত্রীলোক ও ২ জন মুসলমান। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি তথাকথিত অব্রাহ্মণ। নিত্যানন্দের সময় থেকে সহজিয়ারা বৈষ্ণব আন্দোলনের অংশীদার হয়েছিলেন, তাঁদেরকেই জাত বোষ্টম বলা হয়, কারণ তাঁরা সহজিয়া ছিলেন বলে জাতপাত মানতেন না, ফলে জাতপরিচয় ছিল না। এ কথা অনস্বীকার্য যে সমাজে যাঁরা আউটকাস্ট, তাঁদের দৃঢ়ভাবে একসূত্রে গ্রন্থিত করেছিল বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলন । 

স্মর্তব্য, তন্ত্রও জাত মানে না। এটিই বাঙালির বিপ্লবী অর্থোডক্সি, বাঙালির বিপ্লবী হেজিমনি, বাঙালির শক্তিকেন্দ্রর আদর্শ। 

এইভাবে চৈতন্য আন্দোলন বাঙালির সমাজজীবনে বিপ্লবী অর্থোডক্সির সেলিব্রেশন। এটি প্রান্তিক আন্দোলন নয়, গৌণ নয়, এটি কেন্দ্রীয় এবং অর্থোডক্স, এবং আর্যাবর্তের কেন্দ্রে বৃন্দাবনে বাঙালি বৈষ্ণবরা যে ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন চৈতন্য আন্দোলনে, তা বাঙালির প্রাচীন সাম্রাজ্যস্মৃতিরই অভিনব স্থাপনা, যেভাবে বাঙালির চিরাচরিত উপনিবেশ উৎকলে চৈতন্য আন্দোলন পুনরায় বাঙালির নেতৃত্বকে আধ্যাত্মিক কাঠামোয় পুনর্নিমাণ করেছে।

বিমানবিহারী মজুমদার একটি চিত্তাকর্ষক তথ্য দিয়ে বলছেন, রামমোহনই বাঙালির আধুনিকযুগে প্রথম চৈতন্যবিরোধিতার ডাক দিয়েছিলেন তাঁর লেখায়। হ্যাঁ, রামমোহন সম্পর্কে অধুনা বিস্মৃত একটি তথ্য হল তিনি চৈতন্যবিরোধী ছিলেন। তবে অদূর ভবিষ্যতে সেই রামমোহনের ব্রাহ্ম আন্দোলনেই চৈতন্যপ্রভাব এসে গেল। ব্রহ্মানন্দ কেশব সেন চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের আদর্শ গ্রহণ করলেন আর পূজ্যপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, তিনি তাঁর পূর্বজ অদ্বৈতকে স্মরণ করে চৈতন্যয় ফিরলেন। বিমানবিহারী বলছেন গৌড়বঙ্গে চৈতন্যবিরোধিতার কোনও স্থায়ী ধারা নেই, মাঝেমধ্যে বৃথা চেষ্টা ইতস্তত যা ছড়িয়ে আছে, তা যে কোনও চৈতন্যজীবনীকার অবহেলায় অবজ্ঞা করবেন, কারণ সারবস্তুবিহীন ও অকিঞ্চিৎকর। আশা করা যায় আজ যে চৈতন্যবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদীদের ইতিউতি দেখা মেলে, সেই মূঢ়মতিরাও ভবিষ্যতে চৈতন্যে প্রত্যাবর্তন করবে।

চৈতন্য মহাপ্রভু : বাঙালির চৈতন্যের ভরকেন্দ্র

আমাদের বাঙালিদের আদিতে, উৎসবিন্দুতে, আমাদের শেকড়ে প্রকৃতি-উপাসক একটি ধর্ম আছে, তন্ত্র ধর্ম, যার শুরুটা সম্ভবত হরপ্পা সভ্যতায়, পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে মাতৃকা-উপাসকদের সভ্যতার প্রত্নচিহ্নও তন্ত্রাশ্রয়ী সাক্ষ্য দিচ্ছে। আদিবিদ্বান কপিলের রচিত আদি সাংখ্য। অনেকে মনে করেন আদি সাংখ্য প্রকৃতিপ্রধান ধর্ম ছিল, এবং অবৈদিক ব্রাত্য আর্য, যাঁরা আমাদের পূর্বজ, যাঁদের আউটার এরিয়ান বলা হয়, তাঁদের ধর্মীয় দর্শনের প্রথম উন্নত কাঠামো কপিলের তত্ত্বে প্রকাশিত। এরকম অনুমানের পেছনে একাধিক যুক্তি আছে, সে আলোচনার স্থান আজ নয়। তো এরপর ধ্রুপদী সাংখ্য পুরুষের ধারণা আনল, এবং প্রকৃতি থেকে পুরুষের বিচ্ছিন্নতার আদর্শ তুলে ধরল (উচ্ছিত্তি, একেই থেরবাদী বৌদ্ধধর্মে মোক্ষ বলে) । 

এই ধ্রুপদী সাংখ্য থেকে অনেকগুলি বৌদ্ধ জৈন, আজীবিক সহ অনেকগুলি ধর্ম তৈরি হয়েছে, এবং ভারতের হিন্দুধর্মও মোটের ওপর সাংখ্যাশ্রিত। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের পুনর্মিলন ঘটানোর জন্য বাঙালির/পূর্বভারতের ইতিহাস বহুদিন ধরে ষড়যন্ত্র করে এসেছেন। গঙ্গালদের উত্থান, অথবা গুপ্তপরবর্তীকালে জয়নাগ-শশাঙ্কর উত্থান একটা দীর্ঘ প্রিলিউড। পালযুগে যে বজ্র থেকে সহজ তৈরি হবে, এবং তারপর আদি বাংলা ভাষায় রাধা-কৃষ্ণের সহজিয়া লোকায়ত প্রেমের প্রচলিত জনপ্রিয় কাহিনী (কৃষ্ণধামালী নামে একরকম গানের প্রচলন ছিল) – সেখান থেকে সেনযুগে কবি জয়দেব তাঁর অমর কাব্য গীতগোবিন্দ রচনা করবেন, যা একাধারে পদাবলীসঙ্গীত, মঙ্গলকাব্য এবং রাধাকৃষ্ণযাত্রা, তার একটা সমসাময়িক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তো ছিলই, কিন্তু ইতিহাসের এই দীর্ঘ চাহিদাটিকেও অস্বীকার করা যায় না। প্রকৃতিকে দেহি পদপল্লবমুদারম বলার জন্য পুরুষ দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষারত ছিল বাঙালির ইতিহাসে। জয়দেব এসে তাঁর কৃষ্ণকে দিয়ে বলালেন রাধার প্রতি। প্রকৃতির পায়ের তলায় শুয়ে পড়ার জন্য পুরুষ দীর্ঘদিন ধরেই অপেক্ষা করছিল বাঙালির ইতিহাসে, পালযুগে চামুণ্ডা মূর্তিতে সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছিল। 

কেননা আমরা মাতৃকা-উপাসক জাতি। তন্ত্রের প্রকৃতি-উপাসনায় এ জাতি সংজ্ঞায়িত হয়। প্রগতির একটা অর্থ নাকি অতীতের দিকে ফেরা। রেভলিউশন মানেও অবশ্য তাই। আবর্তন। সম্ভবত শেকড়ে ফেরার থেকে বড় বিপ্লব আর নেই। চৈতন্যসম্ভব বাঙালির সবথেকে বড় বিপ্লব।

১৪০৭ শকে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে চৈতন্যের জন্ম (বঙ্গাব্দের ব্যাপক প্রচলন সেযুগে ছিল না, সমস্ত চৈতন্যজীবনী শকেই তারিখের বিবরণ দেয়)। তাঁর জন্মের পরেই চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল, কথিত আছে। বৈষ্ণব কবিরা বড় চমৎকার বর্ণনা দেনঃ নবদ্বীপে গৌরচন্দ্র উদিত হয়েছেন, অতএব আকাশে আর চন্দ্রের কি প্রয়োজন, এই বলে রাহু চন্দ্রকে গ্রাস করেছিল। ইংরেজি হিসেবে (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার) ২৭শে ফেব্রুয়ারি, ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দ। তাঁর পিতা জগন্নাথ মিশ্র শ্রীহট্ট থেকে এসেছিলেন নবদ্বীপে। প্রসঙ্গত অদ্বৈত নিজেও শ্রীহট্ট থেকেই নবদ্বীপে আসেন। শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে আসা একটি বৈষ্ণবগোষ্ঠী সক্রিয় ছিল, এঁদের বৈষ্ণব হওয়ার ইতিহাসে চৈতন্যের গুরুর গুরু (অর্থাৎ ঈশ্বর পুরীর গুরু) মাধবেন্দ্র পুরীর একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয় (রমাকান্ত চক্রবর্তী)। চৈতন্য তিরোধান নিয়ে আমি দীর্ঘদিন লেখালেখি করেছি, সে নিয়ে আজ কিছু লিখব না। তিনি সাতচল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন, ৪৫৫ শকের আষাঢ়ে শুক্লা সপ্তমী তিথি (গৌড়ীয় মত), অথবা বৈশাখে অক্ষয় তৃতীয়া তিথি (ঔড্র মত) তাঁর তিরোধান দিবস। ইংরেজি হিসেবে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দ।

চৈতন্য যে সময় এসেছিলেন আমাদের মধ্যে, সেই মধ্যযুগে বাংলার হিন্দু নির্যাতিত, ছত্রভঙ্গ। নবদ্বীপে নেতৃত্ব করছে, শাসন করছে জগাই মাধাই। হিন্দুধর্মের নাম করে যে রক্ষণশীল সমাজপতিরা আধিপত্য করছেন তাঁরা অনেকেই বিজাতীয় শক্তির দালাল। কাজির বিচারে বাঙালির প্রাণ ওষ্ঠাগত। গৌড়ে একের পর এক হাবসি বসছে সিংহাসনে, কিছুদিন রাজত্ব করছে, তারপর তাকে মেরে আরেকজন সিংহাসনে। এর মাঝখানে রটল, নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ রাজা হবে। রাজা গণেশের স্মৃতি তখনও অমলিন, গণেশ চৈতন্যজন্মের সত্তর বছর আগে গৌড় শাসন করে গেছেন। গণেশের মন্ত্রী নরসিংহ নাড়িয়াল ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের পূর্বপুরুষ। কাজেই নবদ্বীপে ব্রাহ্মণ রাজা হওয়ার আশঙ্কা নেহাত আজগুবি ছিল না । ফলে নবদ্বীপ উজাড় হয়ে গেল সুলতানি সৈন্যের আক্রমণে। বাসুদেব সার্বভৌম এইসময়েই উৎকল চলে যান। বৈষ্ণব কবি জয়ানন্দ লিখছেন, এ অত্যাচারে নবদ্বীপ উৎসন্নে যাচ্ছিল, অবশেষে মা কালী সুলতানের স্বপ্নে এসে চুলের মুঠি ধরে নাকে কানে গরম তেল ঢেলে দিয়ে সুলতানকে ভয়াবহ পরিণতির জন্য সতর্ক করলেন। এভাবে গৌড়ের সুলতানের দুঃস্বপ্নে এসে মা কালী বাঙালির দুঃস্বপ্নের রাত শেষ করেছিলেন। এভাবে মা কালী রাধারাণীর উত্থানের পথ সুগম করেছিলেন, এভাবে বাংলায় শাক্ত ও বৈষ্ণব এক হয়ে গিয়েছিল চৈতন্যসম্ভবে। কাজিদলনের একটি টেমপ্লেট চৈতন্যসম্ভবে এইভাবে মিশে রয়েছে। 

চৈতন্য মহাপ্রভু : মধ্যযুগে বাঙালির ত্রাতা , বাঙালির অবিসংবাদি নেতা 

প্রাণের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল। তুহিন মুখোপাধ্যায়ের লোকায়ত শ্রীচৈতন্য দ্রষ্টব্যঃ চৈতন্যের সারা জীবন ধরেই দেখি, গৌড় জুড়ে হিন্দুনির্যাতন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। চৈতন্য বাংলা ত্যাগ করেছিলেন তাঁর ওপর হুসেন শাহের আক্রমণের আশঙ্কা ছিল বলে। এইভাবে বাঙালির অন্ধকার সময়ে চৈতন্য আন্দোলন, তার দর্শন, তার সংগঠন, তার নামসঙ্কীর্তন, সর্বোপরি তার প্রতিস্পর্ধা মহাদীপাবলির আলোকমালার মত এসেছিল।

রাধা হলেন প্রকৃতিস্বরূপা। চৈতন্য আন্দোলন রাধাকেন্দ্রিক। বাঙালির বৈষ্ণব ধর্মে রাধাধারণার সর্বোচ্চ গুরুত্ব। প্রকৃতি-পুরুষের এই তান্ত্রিক ধর্মে অবধূত নিত্যানন্দও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তিনিই বৈষ্ণব আন্দোলনের মূল সংগঠক, তাঁর দ্বাদশ গোপাল ও তাঁদের শ্রীপাট আজও বাঙালির বৈষ্ণব ধর্মে নেতৃত্ব দেয়। অপর দিকে যবন হরিদাস যখন বাইশ বাজারে বেত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত, তিনিও এই চৈতন্যসম্ভবের পটভূমিকা রচনা করে যান। 

বৈষ্ণব আন্দোলন প্রায়শ আউটকাস্টদের ক্ষমতায়ন, ক্ষতবিক্ষত মানুষদের শুশ্রূষালয়, আহত মানবসত্তার বাস্তব আশ্রয়। সেটাই অবশ্য ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য, মার্ক্সের ভাষায়ঃ আত্মাহীন জগতের আত্মা, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, নির্যাতিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, জনতার ওষুধ। ঐহিক আবিলতা থেকে উত্তরণ চাইছিলেন যারা, যাঁরা অন্যরকম মানুষ, যাঁরা বিপ্লবী, ভূতগ্রস্ত, তাঁদের অনেক দীর্ঘশ্বাস মন্থন করে এই চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল । রমাকান্ত চক্রবর্তী একজন বৈষ্ণব কবির গভীর আর্তনাদ উদ্ধৃত করেছেনঃ

‘ নীতিবাগীশদের মতে আমি মোহগ্রস্ত। বেদবাদীদের মতে আমি ভ্রান্ত। বন্ধুদের বিচারে আমি বাজে লোক। আমাকে বোকা ভেবে আমার ভাইরা আমাকে ভালবাসে না। ধনীদের ধারণা আমি পাগল। বিবেকী লোকদের মতে আমি দাম্ভিক.. .’

বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া, সত্যেন দত্ত যথার্থই বলেছিলেন। তবে বাঙালির অসীম বেদনা মন্থন করেও চৈতন্যসম্ভব ঘটেছিল। আর্যাবর্তের হাতে আক্রান্ত; ইসলামের হাতে আক্রান্ত; পুরুষতান্ত্রিকতার হাতে আক্রান্ত; বিস্মৃতির হাতে আক্রান্ত; নালন্দা বিক্রমশীলা পুড়ে যাওয়ার আগুনে আক্রান্ত; মধ্যযুগের অনিবার্য মহাঝঞ্ঝায় আক্রান্ত বাঙালির বেদনা, বাঙালির ক্রমশঃ কোনঠাসা হয়ে যাওয়ার বেদনা; এভাবে অনেক বেদনার বারুদ একসঙ্গে জমে চৈতন্য বিস্ফোরণ ঘটেছিল।

সবশেষে, সাংখ্য-আশ্রিত গীতার সেই শ্লোক পুনর্বার স্মরণ করি –

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত । অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥ পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ । ধর্মসংস্থাপনার্থায়  সম্ভবামি যুগে যুগে ॥

বাঙালি জাতির কান্ডারী



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *