ওপার বাংলায় আবাদ করে এপার বাংলায় ফসল তুলবেন মোদী ! - nagariknewz.com

ওপার বাংলায় আবাদ করে এপার বাংলায় ফসল তুলবেন মোদী !


পলিটিক্যাল ডেস্ক,২৮ মার্চ,২০২ : হেফাজতে ইসলাম সহ বাংলাদেশের অন্যান্য ইসলামিক মৌলবাদী ‌গোষ্ঠীর‌ পাশাপাশি বামপন্থীদের বিরোধকে উপেক্ষা করেই সফলভাবে দু’দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী । বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মোদী বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন । করোনা অতিমারি শুরু হ‌ওয়ার পর এটাই প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বিদেশ সফর । বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের ভালমন্দ সাউথ ব্লকের সদিচ্ছার ওপর কতটা নির্ভরশীল তা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল প্রত্যেকের‌ই জানা । বাংলাদেশে এমন কোনও শক্তি ক্ষমতায় আসুক যার পরিণতিতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের  রাজনৈতিক স্থিতি নষ্ট হোক – এটা নয়াদিল্লি কখনোই আর বরদাস্ত করবে না । ২০০-২০০৬ – খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির রেজিম সাউথ‌ ব্লককে একটি বড় শিক্ষা দিয়েছে । ওই পাঁচ বছর আইএসআইয়ের মদতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের  বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে খুল্লামখুল্লা মদত দিয়ে ভারত সরকারের চোখে বিএনপি এতটাই বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছে যে পরবর্তীকালে একাধিকবার সাউথ ব্লকের কূটনীতিকদের সামনে অনেকবার নাকেখত দেওয়ার ‌পরেও খালেদা জিয়ার দলকে আর বিশ্বাস করতে পারে না নয়াদিল্লি । 

আওয়ামি লিগের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের সুসম্পর্কের কথা সুবিদিত । মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার‌ শেখ হাসিনা সরকারের আপদেবিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে । ২০৪য় নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন , তখন বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক মহল এই ভেবে উল্লসিত হয়েছিল যে মোদী সরকার বুঝি হাসিনা সরকারের ততটা বন্ধু হবে না । কিন্তু দিল্লিতে সরকার পাল্টালেও ভারতের বাংলাদেশ নীতি পাল্টায় নি । বরং মনমোহন সিংয়ের থেকেও অনেক নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের আওয়ামি লিগ সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন নরেন্দ্র মোদী ।

শাহজালাল বিমানবন্দরে নরেন্দ্র মোদীকে স্বাগত জানাচ্ছেন শেখ হাসিনা ।

এই মুহুর্তে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবথেকে মজবুত জায়গায় বলে মনে করছেন দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরাই । নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব নিয়েই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সত্তর বছর ধরে ঝুলে থাকা ছিটমহল সমস্যা মিটিয়ে ফেলেন । দুই দেশের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে সীমানা সংক্রান্ত যাবতীয় বিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরেই । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাগড়া না দিলে তিস্তার জলবন্টন চুক্তি‌ও এতদিনে স্বাক্ষরিত হয়ে যেত । বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে ভারত সরকার । তারপরেও বাংলাদেশের একটি মহল বাতাসে ভারত বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে । এটা সত্যি কথা আওয়ামি লিগ বারো বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশ থেকে ইসলামিক মৌলবাদীদের উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হয়েছে । হেফাজতে ইসলাম সহ একাধিক গোঁড়া সুন্নি ওয়াহাবি সংগঠনের রমরমা এতটাই বেড়েছে যে এরা প্রকাশ্যে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার হুমকি দিয়েও পার পেয়ে যায় । চট্টগ্রামের হাটহাজারী হেফাজতে ইসলামের সদর দফতর । নরেন্দ্র মোদীর সফরের বিরোধিতায় মৌলবাদীদের হিংসাত্মক বিক্ষোভের জেরে সেখানে পাঁচ-ছয় জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে । সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ‌ওপর বছরভর হামলা ও নির্যাতনের ‌পেছনেও আছে পরধর্মবিদ্বেষী মৌলবাদীরা । ধর্মীয় ওয়াজের নামে প্রকাশ্যে হাজার হাজার লোকের ‌জমায়েতে এরা ভিন্ন সম্প্রদায় ও নারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায় । সম্প্রতি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ন‌ওগাঁওয়ে হিন্দু গ্রামে হামলাও সংগঠিত হয়েছে ওয়াজ থেকে হেফাজতের এক নেতার উস্কানির কারণে। 


ওড়াকান্দির শ্রীধাম হরিচাঁদ মন্দিরে প্রণাম করছেন প্রধানমন্ত্রী ।

ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মবিশ্বাস খানিকটা বেড়েছে বলে অনেকের ধারণা । বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি ও সেদেশের হিন্দু উপাসনালয় ও পীঠস্থান গুলির ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে ভারতের বর্তমান সরকারের কোনও ‌কুন্ঠা নেই । যেটা ছিল পূর্বের কংগ্রেস সরকারের । এবারে নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল একাধিক সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি মতুয়া সম্প্রদায়ের মহাতীর্থস্থান ওড়াকান্দির শ্রীধাম হরিচাঁদ মন্দির দর্শন । শনিবার হরিচাঁদ মন্দির দর্শন করে হরিচাঁদ- গুরুচাঁদ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী । সেখানে মতুয়া সমাজের একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতাও দেন নরেন্দ্র মোদী । বাংলার ‌নিম্নবর্ণের উপেক্ষিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের জাগরণে হরিচাঁদ ঠাকুরের ভূমিকা আজ সর্বজনস্বীকৃত । মতুয়া জনগোষ্ঠী হরিচাঁদ ঠাকুরকে যুগাবতার বলে মানে । পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই বাংলাদেশে‌ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়‌ই সর্বাধিক সুসংগঠিত । নিম্নবর্ণের ঊত্থানে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের অবদানের কথা স্বীকার করে নিঃসন্দেহে দুই বাংলার মতুয়া সম্প্রদায়ের লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী । এদিন যশোরের সাতক্ষীরায় যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরেও পুজো দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী । 

যশোরেশ্বরী  কালীমন্দিরে পুজো দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী ।

পশ্চিমবঙ্গের ভোটের দিকে তাকিয়েই বাংলাদেশ সফরে গিয়ে মোদীর ওড়াকান্দির শ্রীধাম হরিচাঁদ মন্দির ও যশোরেশ্বরী কালীবাড়ি দর্শন বলে বিরোধীদের কটাক্ষ । বাংলার নির্বাচন বিজেপির কাছে পাখির চোখ তো বটেই । এটাও সত্যি কথা পশ্চিমবঙ্গের ৮৪টি বিধানসভা আসনে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ কমবেশি নির্ণায়ক শক্তি । পূর্বপাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত উদ্বাস্তুদের একটি বড় অংশ‌ই মতুয়াদের অন্তর্গত । সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অবিলম্বে অবিলম্বে কার্যকর ‌করে উদ্বাস্তু মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি জানিয়েছেন সারা ভারত মতুয়া মহাসংঘের সংঘাধিপতি বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুর । ওড়াকান্দিতে মোদীর সফরসঙ্গী ছিলেন শান্তনুও । এখন মোদীর মনে যাই থাক দু’দিনের বাংলাদেশ সফর থেকে তিনি যে রসদ নিয়ে দেশে ফিরলেন তা বাংলার ভোটে তাঁর দলকে ডিভিডেন্ড দেবে বলেই রাজনৈতিক মহলের ধারণা। প্রতিপক্ষের বলকে স্টেপ আউট করে ছক্কা হাঁকানোর বেলায় মোদীর টাইমিং যে মারাত্মক নিখুঁত তা তাঁর নিন্দুকেরাও স্বীকার করে । 



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *