বছর গেল করোনা গেল না , কবে যাবে কেউ জানে না || করোনা শুধু রোগের নয় বিভ্রান্তির‌ও অতিমারি - nagariknewz.com

বছর গেল করোনা গেল না , কবে যাবে কেউ জানে না || করোনা শুধু রোগের নয় বিভ্রান্তির‌ও অতিমারি


                            উত্তম দেব

ছর গেল । কিন্তু করোনা গেল না । কবে যাবে । আদৌ যাবে কিনা ।  না  গেলেই বা‌ শেষ পর্যন্ত কী যাবে-আসবে । ভ্যাকসিন বেরুবে কিনা । বের হলেও তাহা করোনা প্রতিরোধে সক্ষম কিনা । আদৌ ভ্যাকসিনের দরকার আছে কিনা । এই সমস্ত ব্যাপারটাই একটা জটিল ধাঁধা । সরকারি মতে ২০১৯ এর ৩১ ডিসেম্বর চিনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে নভেল করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় । যদিও সাউথ চায়না পোস্ট নামে একটি সংবাদপত্র দাবি করে ২০১৯ এর ১৭ নভেম্বর হুবেই প্রদেশের বছর ৫৫র এক পৌঢ়ের দেহে করোনার প্রথম উপসর্গ ধরা পড়ে । ঘটনা যাই হোক আর কিছু ঘন্টা বাদেই বছর ঘুরে যাবে কিন্তু  করোনা উইকেটে আছে । ইতিমধ্যে তার নাম দু’তিনবার পাল্টে গেছে । নভেল করোনা ভাইরাস নামে বাজারে আসলেও বিশেষজ্ঞদের খাতায় এর নাম ছিল কোভিড- নাইন্টিন । পরে আরেকদফা সংশোধন করে পন্ডিতেরা নাম  রাখেন সার্স কোভ-টু ( SARS-Cov-2 ) ভাইরাস । আমরা যারা আম আদমি তাদের নাম দিয়ে কাম কী । অবতারদের অষ্টত্তোরশত নাম থাকেই । আসল ঘটনা হল পুরো বিশ সালটা আমরা করোনার বিষে জর্জরিত  হয়েছি এবং একুশেও যে করোনা কামড়ে যাবে তা বোঝা যাচ্ছে  ঘটনাপ্রবাহ থেকেই । করোনার থেকেও ভয়ঙ্কর করোনা নিয়ে বিভ্রান্তি , পরস্পর বিরোধী তথ্যের স্রোত  এবং নানা মুনির নানা মত । সবথেকে আশঙ্কার কথা এই একবছরে কোভিড নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের বিভ্রান্তি এবং পরস্পর বিরোধী ন্যারেটিভের ক্ষেত্রটি দিনে দিনে  ছোট হ‌য়ে আসা দূরে থাকুক আর‌ও বিস্তৃত হয়েছে ।  এ কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না, করোনা শুধু ব্যধিরই অতিমারি নয় বিভ্রান্তিরও , এ প্যান্ডেমিক অব কনফিউশন । 

বছর গেল কিন্তু করোনার রক্তচক্ষু ঠান্ডা হল না 

এমনিতেই তথ্য বিপ্লবের এমন এক যুগে আমরা এসে পৌঁছেছি যখন কোনটা সত্য তথ্য , কোনটা অর্ধসত্য তথ্য আর কোনটা ডাহা মিথ্যা তথ্য সাধারণের পক্ষে নির্ণয় করা শক্ত । মানুষ এখন তথ্যের দাস । এটা  অস্বীকার করার জায়গা নেই করোনার সংক্রমণ যদি দক্ষিণ এশিয়া কিম্বা সাব সাহারান আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ থাকত কিম্বা কোন‌ও ট্রপিকাল এপিডেমিক হত করোনা গ্লোবাল প্যান্ডেমিক বা বৈশ্বিক অতিমারির আকার নিত না । মানে করোনার সংক্রমণকে প্যান্ডেমিক বা অতিমারি বলে  ঘোষণাই করত না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা । মারি-মড়ক সভ্যতায় নতুন কিছু নয়। তবে পৃথিবী পুরোদস্তুর গ্লোবালাইজড  বা ভুবনায়িত এবং আন্তর্জালিক হয়ে ওঠার পর মানব প্রজাতির কাছে অতিমারির অভিজ্ঞতা এই প্রথম । 

করোনাকালে  তথ্যের জালে বিভ্রান্ত মানুষ । প্যান্ডেমিক অব কনফিউশন বললেও ভুল হয় না। 

পৃথিবীর মানুষ । রাষ্ট্র সমূহের পরিচালকবৃন্দ এবং  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রকৃতি প্রদত্ত এতবড় আঘাতের জন্য যে প্রস্তুত ছিল না তা বলাই বাহুল্য । দু’একজন অনুজীববিজ্ঞানী , দূরদর্শী বিশেষজ্ঞ আগাম সতর্কতা দিলেও কেউ তাতে কর্ণপাত করে নি । যেখানে বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রস্তুতির অভাব থাকে সেখানে বিভ্রান্তির অবকাশ আছে । করোনা নিয়ে বিভ্রান্তির একটা অন্যতম কারণ রোগটির উৎসস্থল । তথ্য প্রকাশে চিন যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির একথা চিনের অতি বড় সমর্থক‌ও দাবি করবে না । করোনার আউটব্রেক যদি চিনে না হয়ে তাইওয়ান , জাপান কিম্বা দক্ষিণ কোরিয়ায় হত তবে কোভিড নিয়ে এত রহস্যের ধূম্রজাল তৈরি হত না । করোনা প্রকৃতি সৃষ্ট না উহানের ল্যাবে কৃত্রিম উপায়ে উদ্ভাবিত এ নিয়ে কম শব্দ এবং ফুটেজ খরচ করে নি আন্তর্জাতিক মিডিয়া । যদিও এক বছর পর  বিশেষজ্ঞরা মোটের ওপর নিশ্চিত যে, ল্যাবরেটরির বাইরে প্রকৃতিতেই কোভিড ভাইরাসের উদ্ভব এবং বিবর্তন । 

করোনার দ্রুত সংক্রমণ বিশ্ববাসীকে দিশেহারা করে দিয়েছে । যদিও শেষ পর্যন্ত  এর স্বল্প মৃত্যু হার নিঃসন্দেহে বিপর্যয় থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করেছে । তবে বছর পার করেও করোনা নিয়ে বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের নিরসন হয় নি । কোভিডের রহস্যময় চরিত্র‌ই রোগটিকে নিয়ে এত দ্বন্দ্বের একটা বড় কারণ সম্ভবত । যেই চিন থেকে সারা বিশ্বে করোনা ছড়িয়ে পড়ে প্যান্ডেমিক বাঁধিয়ে দিল   পরিসংখ্যান বলছে আক্রান্তের সংখ্যায়  পৃথিবীতে সেই চিনের স্থান আজ আশিতে ! মোট সংক্রমিত   লক্ষ হাজার ৯৭৬ জন । মৃত  চার হাজার ছয়শো চৌত্রিশ মাত্র । সংক্রমণ এবং মৃত্যু হার – এই মুুহুর্তে দু’দিকেই  আমেরিকা শীর্ষে । প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আমেরিকায় মোট সংক্রমিত কোটি ৯৭ লক্ষ ৮১ হাজার ৮৪৭ জন । মৃত লক্ষ ৪৩ হাজার ১৮২ । দ্বিতীয় ভারত । ভারতে আক্রান্ত কোটি লক্ষ ২৪ হাজার ৭৯৭ জন। মৃত লক্ষ ৪৮ হাজার ১৯০। আমেরিকয় যেখানে প্রতি দশ লক্ষে মৃত্যু হাজার ৩৪ জন মানুষের সেখানে ভারতে মৃত্যু প্রতি দশ লক্ষে মাত্র ১০৭ জনের ।  যুক্তরাজ্যে হাজার ৪৫ , ফ্রান্সে ৯৬৬, ব্রাজিলে ৮৯৮ , রাশিয়ায় ৩৭৯  আর তুরস্কে ২৩৭ । গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রে হিসেবটা প্রতি দশ লক্ষে ২২৭.৫ । ভারতে কোভিডে মৃত্যু  হার আন্তর্জাতিক হারের‌ও নিচে । ২৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় সকাল ১০টা ৩৪ মিনিট নাগাদ  করোনা সম্পর্কিত worldometer এর লাইভ ডাটাবেস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যাচ্ছে সেই মুহুর্ত পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট করোনা সংক্রমিত কোটি ১৬ লক্ষ ৭২ হাজার ২২৯ ।  অ্যাক্টিভ পজিটিভ কেস অর্থাৎ এই মুহুর্তে আক্রান্ত ২২ লক্ষ ৯২ হাজার ৪২০ । মৃত ১৭ লক্ষ ৮১ হাজার ৫০৫ । 

ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ায় ঢোকার পর করোনার হনন ক্ষমতা যে যথেষ্ট মাত্রায় সংকোচিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যবেক্ষণও তাই বলছে ।‌ এশিয়ার বৃহত্তম  বস্তি মুম্বাইয়ের ধারাবি নিয়ে সরকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার অন্ত ছিল না ।‌ কিন্তু ধারাবির দরিদ্র মানুষের জীবনীশক্তির কাছে  হার মেনেছে করোনাও । সেখানে সংক্রমণের হার শূন্যে নেমেছে সম্প্রতি । ভারতের মতো দেশে সরকারি পরিসংখ্যানে বাস্তব চিত্র উঠে আসে না সত্যি কথা । তবে কিনা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাদা চোখের পর্যবেক্ষণও  পরিসংখ্যানের অনুরূপ । জীবিকার তাগিদে শহরে আসা গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে করোনা নিয়ে তত্ত্ব-তালাশ করতে গেলে হেসে উড়িয়ে দেন তারা । বলে, ‘ ও আপনাদের শহরের রোগ । আমাদের গ্রামে করোনা টরোনা নাই । ‘ অথচ চেনাজানার মধ্যে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে করোনায় । আক্রান্ত হয়ে সুস্থ‌ও হয়েছেন অনেকে । আমাদের ছোট্ট জলপাইগুড়ি শহরেই কোভিডের বলি হয়েছেন তিনজন চিকিৎসক । কোভিড কি সমাজের নগরজীবী ধনী , বিলাসি এবং অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মানুষকে বেশি কাবু করছে ? করোনার দংশন কি গরমের চেয়ে ঠান্ডার দেশ গুলোতেই বেশি মারাত্মক ? করোনা কি কালো বা পীতাভ বর্ণের মানুষের চেয়ে শ্বেতাঙ্গদের জন্য বেশি ভয়ঙ্কর ‌?  পরিসংখ্যান এবং পর্যবেক্ষণ কিন্তু এইসব প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষিত রচনা করছে । 

দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র মানুষের জীবনীশক্তির কাছে কি কোভিড কোনঠাসা ?

বিশেষজ্ঞরা , গবেষকেরা নিশ্চয় প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজবেন । কোভিড মানব সভ্যতার সামনে নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ । সভ্যতা এই ধরণের অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি হ‌ওয়ার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না । তাই কোভিড গোটা বিশ্ব ব্যবস্থাকে একটা গভীর আতান্তরের মধ্যে ফেলে দিয়েছে । করোনার বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে লকডাউনের মতো ইতিহাসে নজীরবিহীন পদক্ষেপ পর্যন্ত করতে  বাধ্য হয়েছে আন্তর্জাতিক সমাজ । যদিও শেষ পর্যন্ত লকডাউনের ফলে করোনা কতটুকু প্রতিহত হয়েছে এই প্রশ্ন থেকেই যায় । লকডাউন কোভিডকে কাবু করতে পারুক আর নাই পারুক বিশ্ব অর্থনীতিকে কাবু করতে পেরেছে ।  গরীবকে  করোনায় ধরুক আর নাই ধরুক লকডাউনে ধরেছে এবং  শুধু ধরেই  নি  ঠেলতে ঠেলতে একটি বড় অংশকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরেছে ।  প্রাণের ধর্ম‌ই হল চঞ্চলতা । ভয় কাটিয়ে ( মানুষের)   পৃথিবী আবার কবে পূর্ণদ্যমে প্রাণচঞ্চল হবে কেউ জানে না । আগামী বারোটা মাস ফেলে আসা বারোটা মাসের ধূসরতা কাটিয়ে উঠতে পারবে তো ? আশায় বাঁচে মানবজমিনের  চাষা । 

ভয় কাটিয়ে ( মানুষের)   পৃথিবী আবার কবে পূর্ণোদ্যমে প্রাণচঞ্চল হবে কে জানে 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *