উত্তম দেব
বছর গেল কিন্তু করোনার রক্তচক্ষু ঠান্ডা হল না |
এমনিতেই তথ্য বিপ্লবের এমন এক যুগে আমরা এসে পৌঁছেছি যখন কোনটা সত্য তথ্য , কোনটা অর্ধসত্য তথ্য আর কোনটা ডাহা মিথ্যা তথ্য সাধারণের পক্ষে নির্ণয় করা শক্ত । মানুষ এখন তথ্যের দাস । এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই করোনার সংক্রমণ যদি দক্ষিণ এশিয়া কিম্বা সাব সাহারান আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ থাকত কিম্বা কোনও ট্রপিকাল এপিডেমিক হত করোনা গ্লোবাল প্যান্ডেমিক বা বৈশ্বিক অতিমারির আকার নিত না । মানে করোনার সংক্রমণকে প্যান্ডেমিক বা অতিমারি বলে ঘোষণাই করত না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা । মারি-মড়ক সভ্যতায় নতুন কিছু নয়। তবে পৃথিবী পুরোদস্তুর গ্লোবালাইজড বা ভুবনায়িত এবং আন্তর্জালিক হয়ে ওঠার পর মানব প্রজাতির কাছে অতিমারির অভিজ্ঞতা এই প্রথম ।
করোনাকালে তথ্যের জালে বিভ্রান্ত মানুষ । প্যান্ডেমিক অব কনফিউশন বললেও ভুল হয় না। |
পৃথিবীর মানুষ । রাষ্ট্র সমূহের পরিচালকবৃন্দ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রকৃতি প্রদত্ত এতবড় আঘাতের জন্য যে প্রস্তুত ছিল না তা বলাই বাহুল্য । দু’একজন অনুজীববিজ্ঞানী , দূরদর্শী বিশেষজ্ঞ আগাম সতর্কতা দিলেও কেউ তাতে কর্ণপাত করে নি । যেখানে বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রস্তুতির অভাব থাকে সেখানে বিভ্রান্তির অবকাশ আছে । করোনা নিয়ে বিভ্রান্তির একটা অন্যতম কারণ রোগটির উৎসস্থল । তথ্য প্রকাশে চিন যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির একথা চিনের অতি বড় সমর্থকও দাবি করবে না । করোনার আউটব্রেক যদি চিনে না হয়ে তাইওয়ান , জাপান কিম্বা দক্ষিণ কোরিয়ায় হত তবে কোভিড নিয়ে এত রহস্যের ধূম্রজাল তৈরি হত না । করোনা প্রকৃতি সৃষ্ট না উহানের ল্যাবে কৃত্রিম উপায়ে উদ্ভাবিত এ নিয়ে কম শব্দ এবং ফুটেজ খরচ করে নি আন্তর্জাতিক মিডিয়া । যদিও এক বছর পর বিশেষজ্ঞরা মোটের ওপর নিশ্চিত যে, ল্যাবরেটরির বাইরে প্রকৃতিতেই কোভিড ভাইরাসের উদ্ভব এবং বিবর্তন ।
করোনার দ্রুত সংক্রমণ বিশ্ববাসীকে দিশেহারা করে দিয়েছে । যদিও শেষ পর্যন্ত এর স্বল্প মৃত্যু হার নিঃসন্দেহে বিপর্যয় থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করেছে । তবে বছর পার করেও করোনা নিয়ে বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের নিরসন হয় নি । কোভিডের রহস্যময় চরিত্রই রোগটিকে নিয়ে এত দ্বন্দ্বের একটা বড় কারণ সম্ভবত । যেই চিন থেকে সারা বিশ্বে করোনা ছড়িয়ে পড়ে প্যান্ডেমিক বাঁধিয়ে দিল পরিসংখ্যান বলছে আক্রান্তের সংখ্যায় পৃথিবীতে সেই চিনের স্থান আজ আশিতে ! মোট সংক্রমিত ৮ লক্ষ ৬ হাজার ৯৭৬ জন । মৃত চার হাজার ছয়শো চৌত্রিশ মাত্র । সংক্রমণ এবং মৃত্যু হার – এই মুুহুর্তে দু’দিকেই আমেরিকা শীর্ষে । প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আমেরিকায় মোট সংক্রমিত ১ কোটি ৯৭ লক্ষ ৮১ হাজার ৮৪৭ জন । মৃত ৩ লক্ষ ৪৩ হাজার ১৮২ । দ্বিতীয় ভারত । ভারতে আক্রান্ত ১ কোটি ২ লক্ষ ২৪ হাজার ৭৯৭ জন। মৃত ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ১৯০। আমেরিকয় যেখানে প্রতি দশ লক্ষে মৃত্যু ১ হাজার ৩৪ জন মানুষের সেখানে ভারতে মৃত্যু প্রতি দশ লক্ষে মাত্র ১০৭ জনের । যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৪৫ , ফ্রান্সে ৯৬৬, ব্রাজিলে ৮৯৮ , রাশিয়ায় ৩৭৯ আর তুরস্কে ২৩৭ । গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রে হিসেবটা প্রতি দশ লক্ষে ২২৭.৫ । ভারতে কোভিডে মৃত্যু হার আন্তর্জাতিক হারেরও নিচে । ২৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় সকাল ১০টা ৩৪ মিনিট নাগাদ করোনা সম্পর্কিত worldometer এর লাইভ ডাটাবেস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যাচ্ছে সেই মুহুর্ত পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট করোনা সংক্রমিত ৮ কোটি ১৬ লক্ষ ৭২ হাজার ২২৯ । অ্যাক্টিভ পজিটিভ কেস অর্থাৎ এই মুহুর্তে আক্রান্ত ২২ লক্ষ ৯২ হাজার ৪২০ । মৃত ১৭ লক্ষ ৮১ হাজার ৫০৫ ।
ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ায় ঢোকার পর করোনার হনন ক্ষমতা যে যথেষ্ট মাত্রায় সংকোচিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যবেক্ষণও তাই বলছে । এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি মুম্বাইয়ের ধারাবি নিয়ে সরকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার অন্ত ছিল না । কিন্তু ধারাবির দরিদ্র মানুষের জীবনীশক্তির কাছে হার মেনেছে করোনাও । সেখানে সংক্রমণের হার শূন্যে নেমেছে সম্প্রতি । ভারতের মতো দেশে সরকারি পরিসংখ্যানে বাস্তব চিত্র উঠে আসে না সত্যি কথা । তবে কিনা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাদা চোখের পর্যবেক্ষণও পরিসংখ্যানের অনুরূপ । জীবিকার তাগিদে শহরে আসা গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে করোনা নিয়ে তত্ত্ব-তালাশ করতে গেলে হেসে উড়িয়ে দেন তারা । বলে, ‘ ও আপনাদের শহরের রোগ । আমাদের গ্রামে করোনা টরোনা নাই । ‘ অথচ চেনাজানার মধ্যে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে করোনায় । আক্রান্ত হয়ে সুস্থও হয়েছেন অনেকে । আমাদের ছোট্ট জলপাইগুড়ি শহরেই কোভিডের বলি হয়েছেন তিনজন চিকিৎসক । কোভিড কি সমাজের নগরজীবী ধনী , বিলাসি এবং অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মানুষকে বেশি কাবু করছে ? করোনার দংশন কি গরমের চেয়ে ঠান্ডার দেশ গুলোতেই বেশি মারাত্মক ? করোনা কি কালো বা পীতাভ বর্ণের মানুষের চেয়ে শ্বেতাঙ্গদের জন্য বেশি ভয়ঙ্কর ? পরিসংখ্যান এবং পর্যবেক্ষণ কিন্তু এইসব প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষিত রচনা করছে ।
দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র মানুষের জীবনীশক্তির কাছে কি কোভিড কোনঠাসা ? |
বিশেষজ্ঞরা , গবেষকেরা নিশ্চয় প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজবেন । কোভিড মানব সভ্যতার সামনে নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ । সভ্যতা এই ধরণের অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না । তাই কোভিড গোটা বিশ্ব ব্যবস্থাকে একটা গভীর আতান্তরের মধ্যে ফেলে দিয়েছে । করোনার বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে লকডাউনের মতো ইতিহাসে নজীরবিহীন পদক্ষেপ পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়েছে আন্তর্জাতিক সমাজ । যদিও শেষ পর্যন্ত লকডাউনের ফলে করোনা কতটুকু প্রতিহত হয়েছে এই প্রশ্ন থেকেই যায় । লকডাউন কোভিডকে কাবু করতে পারুক আর নাই পারুক বিশ্ব অর্থনীতিকে কাবু করতে পেরেছে । গরীবকে করোনায় ধরুক আর নাই ধরুক লকডাউনে ধরেছে এবং শুধু ধরেই নি ঠেলতে ঠেলতে একটি বড় অংশকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরেছে । প্রাণের ধর্মই হল চঞ্চলতা । ভয় কাটিয়ে ( মানুষের) পৃথিবী আবার কবে পূর্ণদ্যমে প্রাণচঞ্চল হবে কেউ জানে না । আগামী বারোটা মাস ফেলে আসা বারোটা মাসের ধূসরতা কাটিয়ে উঠতে পারবে তো ? আশায় বাঁচে মানবজমিনের চাষা ।
ভয় কাটিয়ে ( মানুষের) পৃথিবী আবার কবে পূর্ণোদ্যমে প্রাণচঞ্চল হবে কে জানে |