উত্তম দেব
সোমবার পাটনার রাজভবনে টানা চতুর্থ বারের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন নীতিশকুমার । যদিও ২০০০ সালের পর থেকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন মোট সাতবার । জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন থেকে উঠে আসা যে কয়জন ছাত্রনেতা পরবর্তীতে বিহারের রাজনীতিতে নিজেদের নাম রৌশন করেছেন তাদের মধ্যে নীতিশকুমার অন্যতম এবং লালুপ্রসাদ যাদবের পদস্খলনের পর সবথেকে সফলতমও বলা যায় ।
এক দলে থাকতেই যদুকূলপতি লালুপ্রসাদের সঙ্গে বনিবনা ছিল না কুর্মী সম্প্রদায়ের নীতিশকুমারের । জনতা দলের বিভাজনের পর এক পর্যায়ে লালুর আরজেডি গেল কংগ্রেসের সঙ্গে ঘর করতে । জর্জ ফার্নান্ডেজ , শরদ যাদব ও নীতিশকুমারের জেডিইউ বা জনতা দল ইউনাইটেড গোড়া থেকেই বেছে নিল বিজেপিকে । বরাবরই অটলবিহারী বাজপেয়ীর খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন নীতিশকুমার । বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এনডিএ জামানায় রেল সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন নীতিশ ।
বিহারের রাজনীতিতে লালুর পতনের সাথে সাথেই নীতিশের উত্থান । লালুপ্রসাদ জামানার দুর্নীতি ও অরাজকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ২০০৫ এ নীতিশকুমারকেই কান্ডারী হিসেবে বেছে নেয় বিহারের জনগণ । খোদ লালুপ্রসাদ পশুখাদ্য ঘোটালায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে যাওয়ার পর আরজেডি হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া । অন্যদিকে ক্ষমতায় বসেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নয়নে জোর দেওয়ায় বিহারের মানুষের কাছ থেকে মোটা পলিটিক্যাল ডিভিডেন্ড আদায় করতে সক্ষম হন নীতিশকুমার । এ কথা নীতিশের ঘোর শত্রুও অস্বীকার করতে পারবে না যে তাঁর আমলেই গোটা দেশের কাছে বিহারের ভাবমূর্তি বদলায় । দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি এখনও পর্যন্ত দুর্নীতিমুক্ত । স্বজনপোষনের ব্যারামও তাঁর নেই ।
স্বভাবে একগুঁয়ে নীতিশ প্রায় পনেরো বছর বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শিতে । এই পনেরো বছরে বিজেপির সঙ্গে নীতিশকুমারের সম্পর্ক কখনও উঠেছে কখনও পড়েছে । দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপির লক্ষ্য বিহারের রাজনীতিতে এক নম্বরে উঠে আসা । সুশীলকুমার মোদীর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও নীতিশ বিহার বিজেপির অনেকের কাছেই চক্ষুশূল । ২০১৫তেই এনডিএর ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে আরজেডি সহ অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে মহা গঠবন্ধন তৈরি করে ক্ষমতায় ফিরলেও লালু পুত্র তেজস্বীর সঙ্গে রাজনৈতিক অভিসার সুখের হয় নি নীতিশকুমারের। মাঝ দরিয়ায় মহাগঠ বন্ধন ছেড়ে ফের এনডিএর নৌকায় উঠে পড়েন তিনি ।
দেড় দশক সরকার চালানোর পর প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ার মোকাবিলা করে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন যেকোনও নেতার জন্যই চ্যালেঞ্জের । নীতিশকুমার এবার বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে লড়লেও তাঁর ডানাছাটার সব ব্যবস্থা ভোটের আগেই সেরে ফেলেন বিজেপি নেতৃত্ব । রামবিলাস পুত্র চিরাগকে দিয়ে যেই চালটি মোদী-শাহ-নাড্ডা দিয়েছিলেন তা বুঝেও হজম না করে উপায় ছিল না নীতিশকুমারের। নির্বাচনী যুদ্ধ হাতের বাইরে যাচ্ছে বুঝেই এবার খানিকটা গুটিয়ে যান এই পোড়খাওয়া লড়াকু নেতা । হারা ম্যাচ বের করে আনতে শেষমেশ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপরেই নির্ভর করতে হয় তাঁকে।
এবারের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে নিঃসন্দেহে সবথেকে বেশি লাভবান বিজেপি। একুশটি আসন বাড়িয়ে বিধানসভায় তারা দ্বিতীয় স্থানে। আগের বারের থেকে পাঁচটি কম পেয়ে তেজস্বী যাদবের আরজেডি প্রথম স্থানে । আর ২৬টি আসন হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দল থার্ড পজিশনে। রীতিমতো ফটো ফিনিশে মীমাংসিত এই নির্বাচনে ১২৫ আসন জিতে এনডিএ ক্ষমতায় ফিরলেও নীতিশের গরিমা প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে । প্রাক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে বিজেপি নীতিশকুমারের মাথাতেই মুখ্যমন্ত্রীর তাজ তুলে দিলেও সেটা যে নিছকই দয়ার দান তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সোমবার রাজভবনে নীতিশকুমার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরেই উপমুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন বিজেপির তারাকিশোর প্রসাদ ও রেণুদেবী । দুই পাশে দুই ডেপুটি নিয়ে নীতিশকুমারের মতো একরোখা ও ব্যক্তিত্বশালী নেতা কতদিন সরকার চালাতে পারেন এখন সেই দিকেই তাকিয়ে আছে রাজনৈতিক মহল।
ছবি নীতিশকুমারের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত