স্বাধীনতার পর দুটি আইন হয়েছে কিন্তু হাত দিয়ে ময়লা সাফ করার মতো জঘন্য পেশা বন্ধ করা যায় নি। এখনও দেশে ৫৮ হাজার মানুষ আছেন, যাঁরা হাত দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করেন। এবার দেশের শীর্ষ আদালত সরকারের কাছে জানতে চাইল, ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজিং’ বন্ধ হবে কবে?
বিশেষ প্রতিবেদন: হাতে করে ময়লা পরিষ্কার বন্ধ করতে ২০১৩ সালে আইন এনেছিল কেন্দ্র। ওই আইনে ময়লা-আবর্জনা সাফাইয়ের একশো শতাংশ কাজ যান্ত্রিক উপায়ে করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আইন পাশের দশ বছর পরেও দেশ থেকে ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজিং’ বা মানুষের মাধ্যমে ময়লা সাফাইয়ের কাজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা যায় নি। ২০১৩ সালের আইন (Prohibition of Employment as Manual Scavengers and their Rehabilitation Act, 2013) কতটুকু কার্যকর হয়েছে, এবার তার রাজ্য ওয়াড়ি রিপোর্ট চাইল সুপ্রিম কোর্ট। আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।
দলিত বর্গের নারী-পুরুষকে দিয়ে হাতে করে ময়লা পরিষ্কারের কাজকে পৃথিবীর সবথেকে ঘৃণ্য ও অমানবিক পেশা বলে মনে করা হয়। স্বাধীনতার আগে অস্পৃশ্য দলিতদের ‘হরিজন’ আখ্যা দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু তাতে জমাদার, মেথর বা ধাঙড়দের দুঃখ-কষ্ট ও মানবেতর জীবনযাপনের অবসান হয় নি। স্বাধীনতার পরেও দীর্ঘ সময় লেগে গেছে তাদের নিয়ে সরকারের ভাবতে। ১৯৯৩ সালে দেশে প্রথমবারের মতো আইন জারি করে বর্জ্য পরিষ্কার ও নিষ্কাশনের কাজে মানুষের শ্রম ব্যবহার বন্ধের কথা বলা হয়। এর বিশ বছর পরে ফের নতুন একটি আইন এনে মানুষের মাধ্যমে ময়লা পরিষ্কারের যাবতীয় কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ময়লা পরিষ্কারের কাজে নিযুক্তদের অন্য পেশায় পুনর্বাসনের কথা বলা হয়। আইনটিতে বলা হয়েছিল, ময়লা পরিষ্কার সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ যন্ত্রের মাধ্যমে সারতে হবে। দেশ থেকে খাটা পায়খানা উচ্ছেদের সঙ্কল্প ১৯৯৩-এর আইনেই ছিল।
দেশে এখনও ৫৮ হাজার ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার্স’
কিন্তু সংসদে দু’-দুটি আইন পাশ হয়ে যাওয়ার পরেও দেশ থেকে মেথর, জমাদার বা ধাঙড়ের কাজ লুপ্ত হয়ে যায় নি। আইনগতভাবে এখন দেশে হাতে করে ময়লা পরিষ্কারের কাজ নিষিদ্ধ। কিন্তু এখনও সারা দেশে ৫৮ হাজার ৯৮জন নথিভুক্ত জমাদার আছেন, যাঁরা যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই ময়লা নিষ্কাশনের কাজ করে চলেছেন। বিশেষ করে সেপটিক ট্যাঙ্ক ও ভূ-গর্ভস্থ নিকাশি নালা পরিষ্কারের কাজে এখনও যন্ত্রের পরিবর্তে মানুষের শ্রমকেই ব্যবহার করা হচ্ছে বহু জায়গায়। প্রত্যেক বছর সেপটিক ট্যাংক ও ভূ-গর্ভস্থ নিকাশি নালা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
৫ বছরে ৩০৮জন সাফাইকর্মীর মৃত্যু
২০১৮-২০২২ এই পাঁচ বছরে সেপটিক ট্যাংক ও ভূ-গর্ভস্থ নালা পরিষ্কার করার কালে সারা দেশে ৩০৮জন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী রামদাস আথাওয়ালে। এর মধ্যে তামিলনাড়ুতে ৫২, উত্তরপ্রদেশে ৪৬, হরিয়ানায় ৪০, মহারাষ্ট্রে ৩৮ এবং দিল্লিতে ৩৩টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। দেশের ৪৫ শতাংশ মানুষ এখনও নিকাশি ব্যবস্থার বাইরে আছে বলে একটি সরকারি প্রতিবেদনে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। গত পয়লা ফেব্রুয়ারি সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেট বক্তৃতা দেওয়ার সময় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সেপটিক ট্যাংক ও ভূ-গর্ভস্থ নালা পরিষ্কার সহ ময়লা নিষ্কাশনের যাবতীয় কাজ ১০০ শতাংশ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
সরকার এই ধরণের প্রতিশ্রুতি বিগত দিনগুলিতে অসংখ্য বার দিলেও এখনও কেন হাত দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করার মতো মানবেতর কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয় নি, এই প্রশ্ন তুলেছেন সমাজকর্মীরা। ‘স্বচ্ছ ভারত’ মিশন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রিয় প্রকল্পগুলির একটি। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস আর ভট্ট ও বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রের কাছে জানতে চেয়েছে, সরকারের করা দুটি আইনের কতটা কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে দেশ জুড়ে। খাটা পায়খানা দেশে এখনও কটা আছে। কোন কোন রাজ্যে কী সংখ্যায় আছে। রাজ্যভিত্তিক হাতে ময়লা পরিষ্কার করে এমন কর্মীর সংখ্যা কত। কতজন ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজার’কে এখনও পর্যন্ত পুনর্বাসন দেওয়া গেছে। ময়লা পরিষ্কারের কাজে যন্ত্রের ব্যবহারে কতদূর অগ্রগতি হয়েছে এবং সেপটিক ট্যাংক ও ম্যানহোলে নেমে সারা দেশে কতজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের আদৌ কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কিনা, দিলে কী হারে দেওয়া হয়েছে, সব তথ্য জানতে চেয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। আগামী ১২ এপ্রিল ফের এই সংক্রান্ত শুনানি হবে সুপ্রিম কোর্টের ভিভিশন বেঞ্চে। সে’দিন ডিভিশন বেঞ্চের তোলা যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে।
Feature Image is Representational. Photo Credit- Patriot.