বিএনপির সমাবেশ ঘিরে উত্তপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতি, নাক গলানোয় আমেরিকাকে কড়া জবাব হাসিনার - nagariknewz.com

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে উত্তপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতি, নাক গলানোয় আমেরিকাকে কড়া জবাব হাসিনার


সাউথ এশিয়া ডেস্ক: তেইশের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন। যদিও এক বছর আগেই ভোট ঘিরে উত্তপ্ত বাংলাদেশের রাজনীতি। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছে বিএনপি সহ বিরোধীরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সহ আরও কয়েকটি দেশ‌ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়ায় কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। আমেরিকা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত মন্তব্য করছে বলে শুক্রবার ঢাকায় অভিযোগ করলেন বাংলাদেশের সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

বিএনপির শীর্ষ নেতাও গ্রেফতার

নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে নয়টি বিভাগীয় সমাবেশ শেষ করে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করার কথা বিএনপির। যদিও এই মহাসমাবেশ ঘিরে সরগরম বাংলাদেশ। বিএনপি ঢাকার নয়াপল্টনে সভা করতে চাইলে সেখানে সভা করার অনুমতি দেয় নি পুলিশ। গত বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপির দফতর ঘিরে ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে যায়। পুলিশ বিএনপির দফতরের সামনে জড়ো হ‌ওয়া দলটির সমর্থকদের সরিয়ে দিতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিএনপির সমর্থকেরা ইটপাটকেল মারতে শুরু করলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জের পাশাপাশি টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটায়। গোটা চত্বর রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। পুলিশের ছড়রা বুলেটে একজনের মৃত্যু হয়। আহত শতাধিক। নিহত ব্যক্তি তাদের সমর্থক বলে বিএনপির দাবি। এই ঘটনার পরপরই বিএনপির সদর দফতরের ভেতরে ঢুকে দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা সহ পাঁচশোর‌ও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

নয়াপল্টনে বিএনপির বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ছড়রা গুলি ছুঁড়ছে পুলিশ।

পুলিশ সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় তাদের দলের সমর্থকদের উপর হামলা চালিয়েছে বলে‌ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরের অভিযোগ। সংঘর্ষের পর বিএনপির সদর দফতরে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে পুলিশ। বিএনপির দফতরের ভেতর থেকে তাদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে পুলিশের অভিযোগ। যদিও এই অভিযোগ মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বিএনপি নেতৃত্ব। পুলিশ প্রশাসন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা করার সুযোগ দিলেও তাতে রাজি নয় বিএনপি। সভাস্থল নিয়ে টানাপোড়েন চলার মধ্যেই বৃহস্পতিবার শেষ রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাসকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। তারেক রহমান ব্রিটেনে নির্বাসিত। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্বাস্থ্যের কারণে জেল থেকে প্যারোলে ছাড়া পেলেও আইনি জটিলতায় রাজনীতি থেকে দূরে। খালেদা ও তারেক রহমানের অবর্তমানে বিএনপির কান্ডারীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন বর্ষীয়ান নেতা মির্জা ফখরুল আলমগীর‌ই।

বিদেশি কূটনীতিকদের ওপর চটেছে ঢাকা

শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে এবং মানুষের মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। বিরোধীরা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও সেই দাবি অসাংবিধানিক বলে উড়িয়ে দিয়েছে সরকার। নির্বাচনের এক বছর আগেই সরকার ও বিরোধীদের এই টানাপোড়েনের জেরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশী রাষ্ট্র‌গুলি মতামত দিতে শুরু করায় শেখ হাসিনার সরকার খানিকটা অস্বস্তিতে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কিছু দিন আগেই ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন নিয়ে করা জাপানি রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে বাংলাদেশে। আঠারোর নির্বাচনে শাসকদল আওয়ামী লীগ ব্যাপক কারচুপি করেছে বলে বিএনপি সহ বিরোধীদের অভিযোগ। বিদায়বেলায় জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি সেই নির্বাচন নিয়ে শ্লেষাত্মক মন্তব্য করায় নিজেদের অসন্তোষ গোপন রাখে নি বাংলাদেশ সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিবৃতি।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ওয়াশিংটন প্রশাসন‌ও যে নজরদারি বাড়িয়েছে, সাম্প্রতিক নানা ঘটনাক্রমেই তা স্পষ্ট। সরকার ও আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপির ভুল ও মিথ্যে তথ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে অযথা মন্তব্য করছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। সাত অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির দফতর ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে একজনের মৃত্যুর পর প্রচারিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ফেসবুক পোস্ট ঘিরে বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগের উষ্মা চরমে পৌঁছেছে। ঢাকার ইউএস অ্যাম্বাসির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ঘটনায় নিহত ব্যক্তি ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন বাংলাদেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বিবৃতিতে বিরোধীদের প্রতি ভয়ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি আইনের শাসনকে সম্মান জানানো, সহিংসতা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান পিটার হাস। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরও যা লেখেন- “সহিংসতার এই খবরগুলোর সুষ্ঠ তদন্ত করতে, এবং মত প্রকাশ, সভা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করতে আমরা সরকারি কর্তৃপক্ষকে উৎসাহিত করছি।”

আমেরিকাকে কাদেরের হুঁশিয়ারি

ফেসবুকে প্রচারিত আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের এই বিবৃতিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলেই মনে করছে বাংলাদেশ সরকার। শুক্রবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “বন্ধুত্বটা নষ্ট করবেন না। আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। আমাদের অতীতের অনেক বেদনা আছে। তারপর‌ও বন্ধুত্ব চাই। কারণ সবার‌ই লেনদেন আছে।” ওবায়দুল কাদের বলেন, “নির্বাচনে জালিয়াতি শুধু বাংলাদেশেই হয় না, এই শব্দ এখন আমেরিকাতেও বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনেও মানুষ মারা গেছে। সেখানে বাসচালক মারা গেছে। কংগ্রেস আক্রান্ত। ন্যান্সি পেলোসি কীভাবে লুকিয়ে ছিলেন, এই দৃশ্য আমরা দেখেছি।” শেখ হাসিনার সরকার অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলায় আমেরিকা সহ কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের কথা শুনেই কাজ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদের হাসিনা সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা। তিনি বলেন, “কার‌ও কথা, কার‌ও ফরমায়েশ, কার‌ও হস্তক্ষেপ শেখ হাসিনা শুনবেন না। তিনি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করেন না।” বিকেলে ঢাকার মহানগর নাট্যমঞ্চে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সভায় ওবায়দুল কাদের ফের আরও একবার বিদেশি রাষ্ট্রগুলির উদ্দেশ্যে বলেন, “বিদেশি বন্ধুদের বলি, আমরা আপনাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না। এখানে দূতাবাসে যাঁরা আছেন, তাঁরা এখানে কার‌ও পক্ষ নেবেন না। আমাদের ঘরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না। আমরা জানি, কীভাবে আমাদের গণতন্ত্র সংরক্ষণ করব।”

আমেরিকার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া দিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবুজ সঙ্কেত ছাড়া ওবায়দুল কাদের মার্কিন প্রশাসনের মুখের ওপর এমন কড়া জবাব দেন নি বলেই মনে করছে ঢাকার রাজনৈতিক মহল। বরাবরই আওয়ামী লীগকে স্বাভাবিক মিত্র বলে মনে করে ভারত। ঢাকায় আওয়ামী লীগের সরকার থাকলে উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকে সাউথ ব্লক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে আমেরিকা বেশি বাড়াবাড়ি করলে শেষ পর্যন্ত দিল্লির কূটনীতিকরা হস্তক্ষেপ করবেনই- এই বিশ্বাস থেকেই শেখ হাসিনা কড়া অবস্থান নিয়েছেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

Images (including feature image) source- Verified FB page of BNP.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *