গুজরাটে বিজেপির বিজয়ের আলোর ছটা এতটাই তীব্র যে ছোট রাজ্য হিমাচল প্রদেশে পদ্মের পরাভবের অন্ধকার তাতে ঢাকা পড়ে গেছে। আরও যা লিখলেন নির্বাণ রায়-
সংবাদ মাধ্যমের কাছে গুজরাটের আরেক নাম ‘মোদীর রাজ্য’। আট বছর আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শি ত্যাগ করে এসে দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন নরেন্দ্র মোদী। তারপরেও গুজরাটের ভোট মানেই মোদীর ভোট। দল বিপদে পড়লে দিল্লি থেকে এসে পার করে দিয়ে যান মোদী। ভোটের প্রচারে বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তুও হন মোদী। গান্ধীনগর ছেড়ে দিল্লিতে আসার তিন বছর পর সতেরোর বিধানসভা ভোটের মুখে বেশ চাপে পড়েছিল বিজেপি। বিপদের আঁচ পেয়ে দলকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন মোদী। মোদী মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়ার পর তিনবার মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ বিজেপি। সত্যি বলতে কি, বিজেপির অনেক নেতা-কর্মীও এই তিন মুখ্যমন্ত্রীর নাম চট করে মনে করতে পারবেন না। তারা গুজরাটকে চেনেন একজনের নামেই- তিনি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।
এই মোদীর রাজ্যেই বৃহস্পতিবার মোদীর রেকর্ড ভেঙেছে মোদীর দল। গুজরাট বিজেপির গড়। ১৯৯৫ থেকে গুজরাটে কোনও নির্বাচনে হারের মুখ দেখে নি বিজেপি। যদিও ঘটনাচক্রে মাঝে ১৯৯৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯৮ সালের ৪ মার্চ পর্যন্ত গুজরাটে বিজেপিকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছিল। ১৯৯৮ থেকে ২০২২- গান্ধী-প্যাটেলের ভূমিতে টানা চব্বিশ বছর সরকারে বিজেপি। দলের প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দিতে ২০০১-এ কেশুভাই প্যাটেলকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। অজ্ঞাতনামা নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীকে দিল্লি থেকে গান্ধীনগরে পাঠান অটলবিহারী বাজপেয়ী। ২০০১-এর অক্টোবরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোদী। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদীকেই প্রধানমন্ত্রীর মুখ করল বিজেপি। ততদিনে মোদী বিনিয়োগবান্ধব গুজরাটের মুখ, এমনকি ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরও। ২০০২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল ১২৭টি আসন। বৃহস্পতিবারের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল গুজরাটে বিজেপির সেরা পারফর্মেন্স। এদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই দুটো রেকর্ড ভেঙে ফেলে গুজরাট বিজেপি। প্রথমে মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বে ২০০২-এর জয়ের রেকর্ড। এরপর ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী মাধবসিংহ সোলাঙ্কির ১৪৯ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার রেকর্ডটিও ব্রেক করে বিজেপি।
বাইশের বিধানসভা নির্বাচনে ১৫৬টি আসনে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে পদ্ম শিবির। পৃথক গুজরাট রাজ্য সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে বিধানসভা নির্বাচনে এত বিপুল সংখ্যক আসন জয় করতে পারে নি কোনও দলই। মোট আসনের ৮০ ভাগই দখল করে নিয়েছে বিজেপি। শতাংশের হিসেবেও রেকর্ড করেছে বিজেপি, যদিও তা ১৯৮৫-তে কংগ্রেসের রেকর্ডকে ভাঙতে পারে নি। সেবার কংগ্রেস পেয়েছিল ৫৫ শতাংশের বেশি ভোট। নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য জানাচ্ছে, এবার বিজেপি পেয়েছে ৫২.৫ শতাংশ ভোট। সতেরোর ৯৯ আসন থেকে বাইশে ১৫৬- ৫৭ আসন বৃদ্ধিকে বিস্ফোরক বললেও কম বলা হয়। আগের বারের থেকে ৩.৪ শতাংশ ভোট বাড়িয়েছে পদ্ম শিবির।
নির্বাচনের আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, ভোট কেটে কংগ্রেসের সর্বনাশ করবে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। ভোটের ফল যা প্রমাণ করল- ভোট কেটে আপ কংগ্রেসের ক্ষতি করেছে বটে কিন্তু হাত আর ঝাড়ু একসাথে লড়লেও পদ্মের বিজয়রথের গতি রোধ রোধ করতে পারত না। বিজেপির ভোট কংগ্রেস-আপের মিলিত ভোটের থেকেও ১২.৩ শতাংশ বেশি। বিজেপির শত্রু এবং মিত্র- দুই দলের কাছেই গুজরাট ‘মোদীর রাজ্য’। গুজরাট ভোটে বিজেপির হার হলে তো কথাই ছিল না, এমনকি অল্প মার্জিনে জিত হলেও তা মোদীর জনপ্রিয়তায় ধ্বস হিসেবে চিহ্নিত করত মিডিয়া। সেই সুযোগ বিরোধী শিবির কিম্বা মিডিয়াকে দিল না গুজরাটের জনগণ। মোদীর রাজ্যে বিজেপির নজির সৃষ্টি করা জয় সঙ্গত কারণেই মোদীর জয় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
হিমাচলের ফল পদ্মের বিজয়োৎসবকে কিঞ্চিত ম্লান করলেও চোনা ফেলতে পারে নি। এবার গুজরাটে বিজেপির বিজয়ের আলোর ছটা এতটাই তীব্র যে ছোট রাজ্য হিমাচল প্রদেশে পদ্মের পরাভবের অন্ধকার তাতে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। বুধবারই আপের কাছে দিল্লি পুরনিগমের কর্তৃত্ব খুইয়েছে বিজেপি। সেই ক্ষতের জ্বালারও উপশম করে দিয়েছে গুজরাটের রেকর্ড জয়। সবথেকে বড় কথা, চব্বিশের যুদ্ধে নামার আগে নিজের রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন সংগ্রহ করে নিলেন নরেন্দ্র মোদী। গান্ধীর গুজরাট বুঝি মোদীকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে তুলল।
Feature Photo Credit- BJP official FB page.