মুলায়ম সিং যাদব প্রয়াত। সোমবার সকালে গুরুগ্রামের মেদান্ত হাসপাতালে দেহান্ত হয় মুলায়মের। তিরাশিতেই এসে থেমে গেল ‘হিন্দি ভারতের’ অন্যতম বর্ণময় ও বিতর্কিত এই নেতার জীবনরথ। গত দুই বছর ধরেই তবিয়ত ভাল যাচ্ছিল না ইউপি-র যদুকুলপতির। নিজের হাতে গড়া দল সমাজবাদী পার্টির রাশ পুত্র অখিলেশের হাতে তুলে দিয়ে মোটের উপর নিভৃতবাসই বেছে নিয়েছিলেন মুলায়ম সিং যাদব। দল পরিচালনায় বেটা যে সর্বদা বাপের কথায় কান দিয়েছে, তেমন নয়। বরং বহুবার বাপ-বেটার মনোমালিন্যের কানাঘুষো মিডিয়ার মুখরোচক খাবারে পরিণত হয়েছে।
১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়া জেলার সাইফাই গ্রামে মুলায়ম সিং যাদবের জন্ম। বাবার নাম সুঘর সিং যাদব। মা মূর্তি দেবী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। আগ্রার ‘বিআর কলেজ’ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার আগে শিকোহাবাদের ‘একে কলেজ’ থেকে বিটি ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন তিনি। ছাত্রজীবনে কুস্তি লড়তেন মুলায়ম। ১৯৬২-তে কুস্তির আখড়া থেকেই রাজনীতির আখড়ায় প্রবেশ যশবন্তনগরের সোস্যালিস্ট নেতা নত্থু সিংয়ের হাত ধরে। সংযুক্ত সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের প্রখ্যাত সমাজবাদী নেতা রামমনোহর লোহিয়ার নজরে পড়ে যান যুবক মুলায়ম। সেই থেকেই লোহিয়াকেই নিজের রাজনৈতিক গুরু মানতেন তিনি।
১৯৬৭-তে যশবন্তনগর কেন্দ্র থেকে জিতে প্রথমবার উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় যান মুলায়ম সিং যাদব। এই কেন্দ্র থেকেই মোট আটবার নির্বাচিত হয়েছেন মুলায়ম। ৭৫-এ জরুরী অবস্থা জারি হলে মুলায়মকে জেলে যেতে হয়। ১৯ মাস কারান্তরালে ছিলেন। সাতাত্তরের মার্চে জনতা পার্টি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে। তার কয়েক মাস পরেই উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যশবন্তনগর কেন্দ্র থেকে জিতেই জীবনে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হন মুলায়ম সিং যাদব। রাজনীতির মঞ্চে দল ভাঙা-গড়া, ছাড়াছাড়ির খেলায় সাবলীল খিলাড়ি ছিলেন মুলায়ম। জনতা পার্টি থেকে চরণ সিংয়ের লোকদল। ১৯৮৫-তে লোকদল ছেড়ে গড়েন নিজের পার্টি ক্রান্তিকারি মোর্চা। ১৯৮৯-য়ে ভিপি সিংকে সামনে রেখে জনতা পরিবার ফের একত্রিত হলে উত্তরপ্রদেশে জনতা দলের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন মুলায়ম সিং যাদব। ১৯৯০-য়ের মার্চে বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশ থেকে সাফ হয়ে যায় কংগ্রেস। জনতা দল পরিচালিত সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন মুলায়ম। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি উত্তরপ্রদেশের যদুকুল শিরোমণিকে।
উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি বরাবরই প্রবলভাবে জাতপাত কেন্দ্রিক। নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে যাদব-দলিত-মুসলিম ভোটের সিংহভাগকে নিজের দিকে টেনে আনতে সফল হন মুলায়ম। যদিও পরে মুলায়মের দলিত ও মুসলিম ভোটে থাবা বসান বিএসপি-র মায়াবতী। এই কারণেই উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে মুলায়ম-মায়াবতী ঠোকাঠুকি কখনও চাপা দিয়ে রাখা যায় নি। ৯১-এর মধ্যবর্তী নির্বাচনে হার স্বীকার করতে হয় মুলায়মকে। লখনউয়ের তখতে বসেন বিজেপির কল্যাণ সিং। ৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ। কল্যাণ সিংয়ের সরকার বরখাস্ত। ইউপিতে রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু। ৯৩-এর নভেম্বরে আবার মধ্যবর্তী নির্বাচন। তার এক বছর আগেই চন্দ্রশেখরের সমাজবাদী জনতা দল ছেড়ে নিজের সমাজবাদী পার্টি গড়েন মুলায়ম সিং যাদব। ভোটের আগে মুলায়ম বহুজন সমাজ পার্টির সঙ্গে জোট গড়ায় যাদব-দলিত-মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের পুরোটাই যায় সপা-বসপা জোটের ঘরে। ফের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন মুলায়ম সিং যাদব। তবে মায়াবতীর সঙ্গে মুলায়মের দোস্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। দেড় বছরের মাথাতেই কুর্সি ছাড়তে হয় মুলায়মকে।
মোট তিন দফায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মুলায়ম সিং যাদব। কেন্দ্রে দেবগৌড়া ও গুজরালের মন্ত্রিসভায় এক বছর নয় মাস প্রতিরক্ষামন্ত্রীরও দায়িত্ব সামলে ছিলেন তিনি। রাজনীতির প্যাঁচ কষায় জুড়ি ছিল না। মেঠো বক্তৃতায় মানুষকে মাত করতে জানতেন। চালচলনে দেহাতী হাবভাব বজায় রাখতেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। আরেক যদুকুলপতি লালুর মতোই রসবোধে টইটম্বুর ছিলেন মুলায়ম। বিজেপির সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব ছিল মেরুসদৃশ। কিন্তু বাজপেয়ী-আদবানি-মুরলীমনোহর যোশী এমনকি মোদীর সঙ্গেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল যথেষ্টই মধুর। তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে যতটা সফল, প্রশাসক হিসেবে ততটাই ব্যর্থ মুলায়ম সিং যাদব। পৃথক উত্তরাখণ্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে ১৯৯৪-এর ২ অক্টোবর মুজাফফরনগরে পুলিশের গুলিতে ৭ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়। মুলায়ম সিং যাদবের সরকারকে যা চরম বিড়ম্বনায় ফেলেছিল। মুলায়মের জামানার ‘গুন্ডারাজ’-এর ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় উত্তরপ্রদেশের মানুষকে। বরং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মুলায়মের থেকে অনেক বেশি সফল তার ছেলে অখিলেশ।
মুখে সমাজবাদের কথা বললেও মুলায়মের প্রবৃত্তি ছিল সামন্তপ্রভুর মতো। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন সম্পত্তি মামলায় সিবিআইয়ের জালে ফেঁসে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় কমিশনের কাছে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে জানা যাচ্ছে, মুলায়মের নামে মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১৫ কোটি টাকারও বেশি। ধর্ষণ নিয়ে মুলায়মের মন্তব্য শুনে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন অনেকেই। সমাজবাদী নেতা বলেছিলেন- “ছেলেরা তো ছেলেই হয়। ওরা সময় সময় একটু আধটু ভুল করে ফেলে আর কি।” নিজের দ্বিতীয় বিয়ের কথা দীর্ঘদিন গোপন রেখেছিলেন। প্রথম স্ত্রী মালতী দেবীর মৃত্যুর পরই দ্বিতীয় বিয়ের কথা জনসমক্ষে স্বীকার করেন মুলায়ম। দ্বিতীয় স্ত্রী সাধনা গুপ্তের প্রথম পক্ষের সন্তান প্রতীককে চাপে পড়ে ছেলের স্বীকৃতি দেন তিনি। দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানকে নিয়ে কম জলঘোলা হয় নি মুলায়মের পরিবারের অন্দরে।
উত্তরপ্রদেশের পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতেও ছড়ি ঘোরানোর বেজায় ইচ্ছে করত মুলায়মের। সব সময় সেই ইচ্ছে পূরণ হয় নি। জাতীয় নেতা হতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক দলের কান্ডারী হয়েই তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ভারতে আঞ্চলিক দল মানেই পারিবারিক কোম্পানি। মুলায়ম প্রতিষ্ঠিত সমাজবাদী পার্টিও এর ব্যতিক্রম নয়। বেঁচে থাকতেই দলের হাল ছেলের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন মুলায়ম। ভাই শিবপ্রসাদকে ঘিরে বাপ-বেটার ঝগড়াও প্রত্যক্ষ করেছে ইউপির মানুষ। এক সময় বাপকেই দলের সভাপতি থেকে পদচ্যুত করার কথা ঘোষণা করে বসেন অখিলেশ। শেষমেশ যদিও ছেলের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে দলের গুরুদায়িত্ব তাঁর ঘাড়েই সঁপে দিয়ে আড়ালে চলে যান মুলায়ম সিং যাদব।
Photo Credit-Verified FB page of Mulayam Singh Yadav and Akhilesh Yadav.