আইনের শাসনে সমাজে পুলিশের ভূমিকা অভিভাবকের। তাই পুলিশকে বলা হয় আইনের রক্ষক। গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ কোনও রাজা-জমিদারের পেয়াদা নয়। পুলিশের কাজ আইন মেনে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য! স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও দেশের পুলিশ পড়ে রয়েছে লর্ড কর্ণওয়ালিসের জমানায়। কেউ কেউ মনে করেন, রাজ্যে পুলিশের অবস্থা উপনিবেশিক যুগের থেকেও শোচনীয়। ইংরেজ আমলে পুলিশ আর যাই করুক, শাসকদলের প্ররোচনায় নিরীহকে গাঁজা কেসে জেলে ভরে দিত না।
পুলিশ আইনের পালক। পুলিশ কারও বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দেবে কেন? পুলিশ মিথ্যে মামলার ভয় দেখিয়ে নাগরিকের কাছ থেকে ঘুষ খাবে কেন? এই প্রশ্নগুলি সমাজে উত্থাপন করলে লোকে এখন হাসাহাসি করে। আসলে যা হওয়া কদাচ কাম্য নয়, সমাজে তাই যখন রেওয়াজে পরিণত হয় তখন যা প্রার্থিত তাই হয়ে যায় তামাশার বস্তু। পুলিশ ঘুষ খাবে না। পুলিশ মিথ্যে মামলা দিয়ে নাগরিককে হয়রানি করবে না- এটাই আইনের শাসনে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হওয়া উচিত। কিন্তু অনুচিতটাই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হওয়ায় নাগরিকেরাও উচিত প্রশ্নগুলি করতে লজ্জা পায়।
এটা সত্যি, সমস্ত পেশাতেই খারাপ লোক আছে। দুর্নীতি একা পুলিশ করে না। কিন্তু পুলিশের ব্যাপার একটু আলাদা। যাদের হাতে সমাজ, রাষ্ট্র এবং সংবিধান শাসনদন্ড তুলে দিয়েছে তারাই যদি অন্যায়ের আশ্রয় নেয় তবে নাগরিকবৃন্দের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। লোকে পুলিশকে ভয় পায়, ভক্তিও করে। কারণ পুলিশের হাতে শাসনের ভার, শৃঙ্খলা রক্ষার ভার। ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ’- ব্রিটিশ আমলে প্রবাদটির জন্ম তো আর এমনি এমনি হয় নি। স্বাধীন দেশে পুলিশের যদিও নাগরিকদের সুহৃদ হওয়ারই কথা। আইনভঙ্গকারী না হলে কেউ পুলিশকে ভয় পাবে কেন? কিন্তু মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার করার ভয় দেখিয়ে উৎকোচ আদায় যদি দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ আধিকারিকদের রোজগারের পথ হয়ে দাঁড়ায় তবে জনগণ পুলিশের প্রতি প্রীতিবর্ষণ করবে কীভাবে?
আজ বাংলায় কান পাতলেই শোনা যায়- পুলিশ অমুককে গাঁজা কেসে জেলে ভরে দিয়েছে, তমুকের নামে চারটে মিথ্যে মামলা দিয়েছে। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব তো আছেই। বিরোধী দলের কর্মী হলে এক রকমের দাওয়াই। শাসকদলের হলে আরেক রকম। মাথায় মামলার বোঝা যে কী জিনিস তা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানে। সেই মামলা যদি মিথ্যে বা হয়রানিমূলক হয় গৃহস্থ মানুষ তো বাঁচার তাগিদে ঘটিবাটি বেচে হলেও অসৎ পুলিশ অফিসারের অন্যায় দাবি মেটাবে। শেষ ভরসা আদালত। বৃহস্পতিবার ভরসা করার মতোই একটি রায় দিল কলকাতা হাইকোর্ট। নদীয়া জেলার চাপড়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর চন্দন সাহাকে অবিলম্বে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। এই সাব-ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি আমাদের এক সহনাগরিকের কাছে এক লক্ষ টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। ঘুষ না দিলে মাদক মামলায় তাঁকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন আইনের ওই রক্ষক। সহনাগরিকটি ভয় না পেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। অভিযোগকারীর হাতে ছিল ফোন কলের রেকর্ডিং। পরীক্ষায় কল রেকর্ডিং আসল প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্ত সাব-ইন্সপেক্টর চন্দন সাহাকে অবিলম্বে বরখাস্ত করতে রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি ও বিচারপতি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ। অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকের বিরুদ্ধে দেরি না করে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করার নির্দেশও ডিজিকে দিয়েছে আদালত।
মিথ্যে মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি করার ভুড়ি ভুড়ি অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা! তাই অনেকেই অভিযোগ করেও শেষে প্রত্যাহার করে নেন। বহু ভুক্তভোগী অভিযোগ পর্যন্ত করার সাহস পান না। নীরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে উপরওয়ালার কাছে বিচার দেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে সুবিচার মেলে কদাচিৎ। পুলিশের উপরমহল যদি থানার অসৎ আধিকারিকদের শাসন করতে পারত তবে কি আর আজ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে লাগে? কলকাতা হাইকোর্টের এই রায় নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষকে ভরসা জোগাবে। পুলিশি জুলুমের শিকার হয়ে ন্যায়াধীশদের কাছে নালিশ জানালে অবশেষে সুবিচার মেলে- এই বার্তাটি বৃহস্পতিবার দুপুরে কলকাতা হাইকোর্টের অলিন্দ থেকে রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল।
Feature image is representational.