‘সেটিং’ শব্দটা বাংলার রাজনীতিতে নতুন নয়। সেটিং করতেই কি দিল্লি যাত্রা মমতার? সেটিংয়ের কারণে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তও প্রভাবিত হবে? অনেক প্রশ্ন রাজ্য জুড়ে।লিখলেন উত্তম দেব-
চারদিনের সফরে বৃহস্পতিবার বিকেলেই দিল্লি পৌঁছে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিযাত্রায় মমতার সঙ্গে আছেন অভিষেকও। রবিবার নীতি আয়োগের বৈঠকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের মুখোমুখি হবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর আগে একাধিকবার নীতি আয়োগের বৈঠক এড়িয়ে গেছেন মমতা। এবার যেন বৈঠক নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর একটু বেশিই উৎসাহ! শুক্রবার বিকেলে মোদীর সঙ্গে মমতার একান্ত বৈঠকের সূচি চূড়ান্ত। এরপর সদ্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবারের দিল্লি সফর এমন একটা সময়ে, যখন নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রাজ্য সরকার একেবারে নাজেহাল। এগার বছরের রাজত্বে এমন বিপাকে আর কখনও পড়েন নি মমতা। এই পরিস্থিতিতে মমতার দিল্লি সফর নিয়ে খুব সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক তরজা তুঙ্গে।
সেটিং হলে দলেই চাপে পড়বেন সুকান্ত-শুভেন্দুরা
মমতা গেলেন দিল্লি। আর টেনশনে রক্তচাপ বৃদ্ধি বঙ্গ বিজেপির নেতাদের। এমনিতেই যে কোনও চাপের মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি গেলেই কলকাতায় বাম ও কংগ্রেস আওয়াজ তোলে- দিদি মোদীর সঙ্গে সেটিং করতে গেলেন। অন্যবার বাম-কংগ্রেসের সেটিং অভিযোগ রাজ্য বিজেপির নেতারা হেসে উড়িয়ে দিলেও এবার কিন্তু সিরিয়াস। মুরলীধর সেন লেনের গেরুয়া বাড়ির বাসিন্দারা এতটাই সিরিয়াস যে মমতা দিল্লি যাবেন শুনেই অমিত শাহ-জেপি নাড্ডার দরবারে হাজিরা দিয়ে এসেছেন সুকান্ত-শুভেন্দু। আসলে এবার চাপটি বেশ ভালোই টের পাচ্ছেন রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা। শুধু বাম-কংগ্রেস মহলেই নয় দিদি-মোদী সেটিং নিয়ে গুঞ্জন আছে সুকান্ত মজুমদারের নিজের দলেও। মমতা দিল্লি থেকে ফেরার পর নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইডি-সিবিআইয়ের তদন্তের গতি শ্লথ হয়ে গেলে দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে কী জবাব দেবেন তাঁরা, এই চিন্তা চাপে ফেলে দিয়েছে বঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে।
নিয়োগ ঘোটালাও কি সামলে নেবেন মমতা?
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইডি-র হাতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতার ও পার্থ বান্ধবী অর্পিতার দুটি ফ্ল্যাট থেকে কুবেরের ভান্ডার উদ্ধারের ঘটনার রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। চিটফান্ড স্ক্যামের তদন্তভারও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই-ইডির হাতে গিয়েছিল। নারদা তদন্তও কেন্দ্রীয় এজেন্সির হাতে। কিন্তু সারদা-নারদার ধাক্কা বেমালুম হজম করে নিয়েছেন মমতা। এখন একটাই প্রশ্ন- নিয়োগ দুর্নীতির কালিও কি সরকারের গা থেকে একই দক্ষতায় মুছে ফেলতে পারবেন তৃণমূল সুপ্রিমো? চিটফান্ড ঘোটালা ও নারদা স্ক্যামের মতোই এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার তদন্তও আদালতের নির্দেশে ইডি-সিবিআইয়ের হাতে। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এখন একটাই জনরব- বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সক্রিয় না হলে নিয়োগ দুর্নীতির ঝাঁপি খোলা আদৌ সম্ভব হতো না। এসএসসি-র নিয়োগ ঘোটালা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কতটা বিধ্বস্ত করবে তা সময় বলবে। কিন্তু একটা বিষয় পরিস্কার- পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের পর তৃণমূল সরকার ভীষণভাবে বেকায়দায়। এই রকম বিড়ম্বনার মুখোমুখি আগে কখনও হতে হয় নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মমতার মন্ত্রিসভার নম্বর টু। দু’হাতে তিনটি দফতর সামলাতেন পার্থ। ইডি-র খাঁচায় বন্দী হওয়ার পর নম্বর টু-কে সরকার ও দল থেকে বরখাস্ত করা ছাড়া মুখরক্ষার আর কোনও উপায় ছিল না মমতার সামনে।
মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে
ইডি-সিবিআই অবাধে তদন্ত করার সুযোগ পেলে নিয়োগ দুর্নীতিতে সরকার ও শাসকদল আরও বিপাকে পড়বে- এমন ধারণা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ইডি হেফাজতে থাকা পার্থ-অর্পিতা রোজই সংবাদ শিরোনামে। সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমগুলির পেজে পার্থ-অর্পিতা সংক্রান্ত খবরের লিংকের কমেন্ট বক্সে চোখ বোলালেই মানুষের ক্ষোভের আঁচ টের পাওয়া যায়। তৃণমূল সমর্থক নেটিজেনরা যে আত্মপক্ষ সমর্থনে দুটো কথা বলবেন, সেই মুখও তাঁদের নেই। এখনও পর্যন্ত পার্থ-অর্পিতার হেফাজত থেকে যা সম্পদ উদ্ধার হয়েছে তা দেখেই রাজ্যবাসীর চক্ষুস্থির। নগদ টাকা, জমি-বাড়ি-রিসর্ট-ফ্ল্যাট এবং দামি গাড়ি মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া খাজানার পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, এটাই সবার এখন কৌতুহল। রাজ্যে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার কর্মহীন। এসএসসি-র বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা ৫০০ দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে অবস্থানে। ১৪-১৫ লক্ষ টাকায় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বিক্রি করা হয়েছে। প্যানেলের পর প্যানেল ধরে চূড়ান্ত অনিয়ম। তার ফলে যোগ্যরা বঞ্চিত। এখন শোনা যাচ্ছে গোটা শিক্ষা দফতরটাই ঘুঘুর বাসা হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়- সর্বত্র অস্বচ্ছতার বিস্তর অভিযোগ। অবস্থা বেগতিক বুঝে এতদিনে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছে শাসকদল। আর বিরোধীরা রাস্তায়। রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলকে কোনঠাসা করার এত বড় সুযোগ বিরোধীরা আগে পায় নি।
বিরোধীরা সুযোগ নিতে পারছে?
বিজেপি না বাম- নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে কে বেশি আন্দোলনমুখী, এই নিয়েও তরজা চলছে রাজনৈতিক মহলে। বিধানসভার ভেতরে বামেরা শূন্য। বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল। সামাজিক মাধ্যমে বহু নেটিজেনের আক্ষেপ- বিরোধী নেত্রী থাকলে আজকে রাজপথে আন্দোলন কোথায় নিয়ে যেতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! অর্থাৎ মানুষ মনে করছে- সুযোগ পেয়েও সরকারকে চেপে ধরতে ব্যর্থ বিরোধীরা। এই পরিস্থিতিতে মমতার দিল্লি সফর ঘিরে রাজ্য বিজেপি নেতাদের উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। কারণ ইতিমধ্যেই বাম শিবির থেকে কটাক্ষ ধেয়ে আসতে শুরু করেছে। শোনা যাচ্ছে, দিল্লি গিয়ে সুকান্ত মজুমদার ও শুভেন্দু অধিকারী নাকি অমিত শাহকে অনুরোধ করে এসেছেন- মমতার সঙ্গে একান্ত বৈঠক যাতে এড়িয়ে চলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মোদীর সঙ্গে মমতার মুখোমুখি বৈঠক ইতিমধ্যেই নির্ধারিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক অভিযোগ তুলে দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক এড়িয়ে গিয়েছেন। কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই প্রশাসনিক প্রধানের মধ্যে বৈঠক যতই নিয়মমাফিক হোক না কেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিতে মমতা-মোদী একান্ত বৈঠকে রাজনীতির রঙ লাগতে বাধ্য।
বাম-কংগ্রেসের অভিযোগ কি সত্য?
সিবিআই-ইডি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বরাবরই সরব তৃণমূল কংগ্রেস। সিবিআই-এর হাত থেকে আইপিএস রাজীবকুমারকে বাঁচাতে রাস্তায় পর্যন্ত বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই মুহুর্তে শুধু তো এসএসসি নিয়োগ ঘোটালা নিয়েই নয় কয়লা ও গরু পাচার নিয়েও জোরদার তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই-ইডি। সোনা পাচার মামলায় ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার ইডির জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে অভিষেক-রুজিরাকে। পাশাপাশি একশ দিনের কাজ সহ একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা বকেয়া। একশ দিনের কাজ নিয়েও হিসেব না দেখানোর অভিযোগ তুলছে কেন্দ্র। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। তার আগেই একশ দিনের কাজের টাকা হাতে আসা চাই রাজ্য সরকারের। বাম ও প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের অভিযোগ- রাজনৈতিক ভাবে একে অপরকে ব্যবহার করে বিজেপি ও তৃণমূল। রাজনৈতিক স্বার্থেই রাজ্যে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় ইডি-সিবিআইয়ের তদন্তকেও প্রভাবিত করেন মোদী-শাহ।
সেটিং হলে মানুষ বুঝতে পারবে
রাজনীতিতে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ থাকবেই। শুক্রবার বিকেলে মোদীর মুখোমুখি হয়ে মমতা কী কী প্রসঙ্গে আলোচনা করবেন তা নিয়ে আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি। ইডি-সিবিআই তদন্তের কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সত্যিই তুলবেন কিনা তাও আমাদের অজানা। বন্ধ দরজার ভেতরে একান্ত আলোচনায় দুই নেতার মধ্যে এই প্রসঙ্গ উঠলেও আমরা জানতে পারব না। কিন্তু মানুষের চোখকান খোলা। যে কোনও ধরণের সেটিং বা সমঝোতা হলে ঘটনাপ্রবাহ দেখে মানুষ শেষ পর্যন্ত তা অনুভব করতে পারবে। আর এই জায়গাতেই ভয় রাজ্য বিজেপির নেতাদের। নিয়োগ দুর্নীতি রাজ্যের যুব প্রজন্মের একটি বড় অংশের ভবিষৎ অনিশ্চিত করে দিয়েছে। ঘরে ঘরে এটা আঘাত করেছে। অন্তত নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে দিল্লিতে কোনও ধরণের বোঝাপড়া বাংলায় বিজেপির বড় ক্ষতি করবে।
Feature image is file and representational.