প্রতিপক্ষের কোথায় ঘাটতি, কোথায় ব্যর্থতা- সেটা খুঁজে বের করে প্রত্যাঘাত করার নামই তো রাজনীতি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সেই রাজনীতিটাই সফলভাবে করল বিজেপি।লিখলেন নির্বাণ রায়-
তৈরি হল ইতিহাস। ভারতীয় সাধারণতন্ত্র পেতে চলেছে প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি। দ্রৌপদী মুর্মু- নারী এবং দেশের আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি। দেশ এর আগেও নারী রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছে কিন্তু আদিবাসী ইতিহাসে এই প্রথম। ইলেক্ট্রোরাল কলেজের অঙ্ক অনুযায়ী এনডিএ-র রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর জিত নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু বিজেপি যেই মুহুর্তে দ্রৌপদী মুর্মুর নাম রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে সেই মুহুর্তেই দেশের রাজনৈতিক মহল সমঝে যায়, প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাজিমাত করবে এনডিএ। দ্রৌপদীর মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রার্থী হিসেবে বাছাই ছিল মোদী-শাহ-নাড্ডার এমন একটি মাস্টার স্ট্রোক যার পাল্টা জবাব দেওয়ার কোনও মুরোদই ছিল না বিরোধী শিবিরের। বৃহস্পতিবার গণনার তৃতীয় রাউন্ডেই ম্যাজিক ফিগার পেরিয়ে যান দ্রৌপদী। সব রাউন্ড যখন শেষ তখন দেখা গেল ৬৪ শতাংশ ভোট নিজের ঝুলিতে টেনে নিয়েছেন দ্রৌপদী মুর্মু। বিরোধী শিবিরের প্রার্থী যশবন্তের জুটেছে ৩৪ শতাংশ ভোট।
দ্রৌপদীর সমর্থনে ১৭ সাংসদের ক্রস ভোটিং
দ্রৌপদী মুর্মু পেয়েছেন ৬ লক্ষ ৭৬ হাজার ৮০৩ মূল্যের ভোট। যশবন্ত সিংহ পেয়েছেন ৩ লক্ষ ৮০ হাজার ১৭৭ মূল্যের ভোট। মোট ২ হাজার ৮২৪টি ভোট পেয়েছেন এনডিএ-র প্রার্থী। বিরোধী শিবিরের প্রার্থী পেয়েছেন ১৮৭৭টি ভোট। দ্রৌপদী মুর্মুর পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৫৪০ জন সাংসদ। যশবন্ত পেয়েছেন ২২৮ জন সাংসদের ভোট। তাজ্জবের ব্যাপার হল ১৫ জন সাংসদের ভোট বাতিল করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে ১৭ জন সাংসদের ভোট অতিরিক্ত পান দ্রৌপদী। এই ১৭টি ভোট এনডিএ শিবিরের হিসেবের মধ্যে ছিল না। এনডিএ শিবিরের বাইরে থাকা যে সব দল দ্রৌপদী মুর্মুকে সমর্থন করার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিল তাদের ভোটও এই ১৭- মধ্যে পড়ে না। অর্থাৎ বিরোধী শিবির থেকে ১৭ জন সাংসদ দ্রৌপদীর হয়ে ক্রস ভোট দিয়েছেন। যে ১৫ জন সাংসদের ভোট বাতিল হয়েছে তাঁরাও ইচ্ছে করেই নিজেদের ব্যালট বাতিল করেছেন কিনা এই প্রশ্নও উঠেছে।
বঙ্গেও প্রত্যাশার চেয়ে একটি ভোট বেশি উৎকল কন্যার
দেশের সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে যশবন্ত সিংহ সর্বাধিক ভোট পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায়ও একটি ভোট দ্রৌপদী বাড়তি পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ৭০ জন বিজেপি বিধায়কের ভোট দ্রৌপদী মুর্মুর পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গণনার সময় দেখা গেল ৭১ অর্থাৎ একটি ভোট বেশি পেয়েছেন দ্রৌপদী। যশবন্ত সিংহ পেয়েছেন ২১৬ জন বিধায়কের ভোট। চার বিধায়কের ভোট বাতিল হয়েছে। দ্রৌপদীর অতিরিক্ত একটি ভোট তৃণমূলের কারও ক্রস ভোটিংয়ের পরিণাম বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। ট্যুইট করে তেমনটাই দাবি করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। যে চার বিধায়কের ভোট বাতিল হয়েছে- তাঁরা তৃণমূল না বিজেপির, তা নিয়েও রহস্য আছে। এই বাতিল ইচ্ছাকৃত কিনা তাই বা কে বলতে পারে।
রাজ্যে রাজ্যে বিরোধীদের ভোট দ্রৌপদীকে
শুধু সংসদ কিম্বা পশ্চিমবঙ্গেই নয় রাজ্যে রাজ্যে ব্যাপক ক্রস ভোটিং হয়েছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। এই ক্রস ভোটিং-এর জেরেই প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ভোটমূল্যে দ্রৌপদী মুর্মু জিতেছেন বলে দাবি বিজেপির। বিভিন্ন বিধানসভার কমপক্ষে ১২৫ জন বিধায়ক দ্রৌপদীর পক্ষে ভোট দিয়েছেন বলে অনুমান। এর আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক ক্রস ভোটিং হয়েছিল ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসের মধ্যে বিভাজনের কারণে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর অতি সামান্য ভোটমূল্যের ব্যবধানে কংগ্রেসের অফিসিয়াল প্রার্থী নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে হারিয়ে দিয়েছিলেন ভিভি গিরি। গিরি নির্দল হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তাঁকে মদত দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা দলীয় হুইপ অমান্য করে বিবেক ভোটের ডাক দেওয়ায় কংগ্রেসের বিরাট সংখ্যক জনপ্রতিনিধি গিরিকেই ভোট দিয়েছিলেন। এবারে প্রাক্তন বিজেপি নেতা যশবন্ত সিংহকে বিরোধীরা প্রার্থী ঘোষণা করতেই আস্তিনে লুকোনো তাস বের করেন মোদী-শাহ-নাড্ডা। একজন আদিবাসী মহিলাকে প্রার্থী করে খেলা যে বিজেপি মুঠোর মধ্যে ভরে নিয়েছে এটা বুঝতে দেরি হয় নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাই এনডিএ রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করার দিন কয়েকের মধ্যেই সুর পাল্টে ফেলান তৃণমূল সুপ্রিমো। আগে জানলে তারাও দ্রৌপদী মুর্মুকেই সমর্থন করার কথা ভাবতেন বলে জানিয়ে দেন মমতা।
বিজেপির কৌশলের কাছে আরও একবার ধরাশায়ী বিরোধী শিবির
ভারতের রাজনীতিতে এই মুহুর্তে রণকৌশল নির্ধারণে বিজেপির ধারেকাছে যে কেউ নেই, তা আরও একবার প্রমাণিত হল দেশের পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে। বিজেপির কৌশলের কাছে আরও একবার ধরাশায়ী হল বিরোধী শিবির। বিরোধী শিবির থেকে ভোট ছিনিয়ে এনে দীনদয়াল ভবন দেখিয়ে দিল- তারা চাইলে বিরোধীদের তাঁবু ছত্রখান করে দিতে পারে যে কোনও উপায়ে। লোকসভা নির্বাচনের আর দুই বছরও বাকি নেই। ভারতের রাজনীতিতে অধিকাংশ সময়ই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনটা নিছকই একটা নিয়মরক্ষার লড়াই হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বাইশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকেও রাজনৈতিক লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ বের করে নিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে ভারতের সাংবিধানিক প্রধান হচ্ছেন একজন আদিবাসী নারী। এর আগে আদিবাসী সমাজের থেকে কাউকে রাইসিনা হিলে পাঠানোর কথা ভাবে নি কোনও রাজনৈতিক দল। প্রতিপক্ষের কোথায় ঘাটতি, কোথায় ব্যর্থতা- সেটা খুঁজে বের করে প্রত্যাঘাত করার নামই তো রাজনীতি। পলিটিক্যাল আইকিউতে এখন বিজেপির কাছে বাকিরা শিশু- এটাই প্রমাণিত হল রাষ্ট্রপতি ভোটে।
দ্রৌপদীও সংঘবাদের প্রতীক
দ্রৌপদী মুর্মুর বিপুল বিজয়কে দেশ জুড়ে সাড়ম্বরে উদযাপিত করছে বিজেপি। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের অখ্যাত-অজ্ঞাত, দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে বড় হয়েছেন দ্রৌপদী মুর্মু। সেই মেয়ে আজ ভারতের এক নম্বর নাগরিকের চেয়ারে। যোগী যদি হয় বিজেপির পোস্টার বয় তবে দ্রৌপদী কেন পোস্টার গার্ল নয়? রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ডিভিডেন্ডকে চব্বিশের যুদ্ধে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে বিজেপি দ্বিধা করবে কেন?
Photo Credit- BJP official FB page.