শেখ হাসিনার আমলে হিন্দু শিক্ষকদের উপর নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। অধিকাংশ সময়ই স্থানীয় প্রশাসন নির্যাতনকারীদের হয়ে কাজ করে।বিশেষ প্রতিবেদন-
বাংলাদেশে শিক্ষকতা করা দিন দিন রীতিমতো ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর শিক্ষক-অধ্যাপক যদি হিন্দু হন তবে তো কথাই নেই। মারধর, জুতোর মালা, কান ধরে ওঠবস থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ায় অপরাধে জেল এমনকি প্রাণনাশ- সবই হিন্দু শিক্ষক-অধ্যাপকদের প্রাপ্য। বাংলাদেশের হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকা-অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা এখন রীতিমতো আতঙ্কে থাকেন। নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি দিন অক্ষত দেহে, বিনা অপমানে ঘরে ফিরতে পারলে তাঁরা নিজ নিজ ইষ্টকে প্রাণভরে ধন্যবাদ জানান। উপরওয়ালা ছাড়া তাঁরা আর ভরসা করবেনই বা কাকে! পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধ্যাপককে জুতোর মালা গলায় ধারণ করে উন্মত্ত জনতার হর্ষোল্লাসের মধ্যে হেঁটে যেতে হয় সেই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষককুলের সামনে আর কে আছেন যিনি তাদের মান-ইজ্জত রক্ষা করবেন?
বিচার পান নি শ্যামলকান্তি ভদ্র
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষকদের নিগ্রহ-নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। তবে শেখ হাসিনার জমানায় তা অন্য মাত্রা পেয়েছে। হাসিনা জামানায় হিন্দু শিক্ষক নিগ্রহের প্রথম বড় ঘটনা ছয় বছর আগে-২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল বাগেরহাটের চিতলমারীর হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুই হিন্দু শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী ও অশোককুমার ঘোষালকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মারধর করে স্কুলের লাইব্রেরি রুমে হাত-পা বেঁধে আটকে রেখে পুলিশের হাতে তুলে দেয় গ্রামবাসীরা। এতে সায় ছিল স্কুল পরিচালনা কমিটির প্রভাবশালী সদস্যদেরও। বিনা বিচারেই ওই দুই হিন্দু শিক্ষককে ছয়মাসের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমান আদালত। একই বছরের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কল্যাণদির একটি স্কুলের ঘটনা আরও মর্মান্তিক। ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে স্কুল চত্বরেই শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভদ্রকে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। শতশত পড়ুয়া এবং গ্রামবাসী এই দৃশ্য দেখে পুলকিত হয়। ঘটনাস্থলে সেই সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান। সেলিম ওসমানের নির্দেশেই নাকি হিন্দু শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করতে হয়েছিল। শ্যামলকান্তির সহকর্মী সহশিক্ষকেরাও এই মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী। বাংলাদেশের সবাই জানে, নারায়ণগঞ্জ জেলা জুড়ে এই ওসমান পরিবারের কী বিপুল বিক্রম। সেলিম ওসমানের আরেক ভাই শামিম ওসমানও আওয়ামি লিগের ডাকসাইটে সাংসদ। শিক্ষক যখন মালাউন আর অভিযোগ যখন ধর্ম অবমাননার, তখন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী সাংসদের আর কী বিচার হবে! উল্টে শ্যামলকান্তি ভদ্র জেল খেটে বাড়ি ফেরেন। সাংসদ সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে করা শ্যামলকান্তির মামলা আদালত খারিজ করে দেয়। বাংলাদেশে হিন্দু শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস কারানোটা কোনও অপরাধের মধ্যে পড়েই না। তাই শ্যামলকান্তির আর্তনাদ আদালতের অলিন্দে নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
বিনা দোষে জেল খাটেন হৃদয় মন্ডল
২০২২-এ যেন বাংলাদেশে হিন্দু শিক্ষক নির্যাতনের হিড়িক পড়ে গেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার জন্য একটি অভিযোগই যথেষ্ট- ধর্ম অবমাননা। একবার ধর্ম অবমাননায় অভিযুক্ত হয়ে গেলেই বাংলাদেশে হিন্দু শিক্ষকের পাশ থেকে থানা-পুলিশ-প্রশাসন এমনকি তাঁর ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরাও উধাও হয়ে যায়। মার্চ মাসে মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয়চন্দ্র মন্ডলকে দিয়ে নির্যাতনপর্ব শুরু। ক্লাসে পড়ানোর সময় ওই হিন্দু শিক্ষকের একটি মন্তব্যে তাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে- এই অভিযোগে তুলকালাম কান্ড বাধায় ছাত্রছাত্রীরা। ক্লাস থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে মারধর শেষে হৃদয়চন্দ্রকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ঊনিশ দিন জেলের ঘানি টেনে বাড়ি ফেরেন ওই হিন্দু শিক্ষক। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করে নি প্রশাসন। কল্লা বাঁচিয়ে কর্মস্থলে ফিরতে পারলেও হুমকিধামকি মাথায় নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে হৃদয় মন্ডলের।
হিন্দু অধ্যাপকের প্রাপ্তি জুতোর মালা!
গত ১৮ জুন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপনকুমার বিশ্বাসের লাঞ্ছনার ঘটনা বাকি ঘটনাকে ছাপিয়ে গেছে। ওই হিন্দু অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- ফেসবুকে কলেজের কোনও এক হিন্দু ছাত্রের ধর্মীয় অবমাননা মূলক পোস্টের পেছনে তাঁরও প্রচ্ছন্ন মদত আছে। গলায় জুতোর মালা পড়িয়ে স্বপনকুমার বিশ্বাসকে কলেজ চত্বরে ঘোরানো হয়। সব থেকে বিস্ময়ের ব্যাপার হল, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এলেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে উদ্ধারে কোনও পদক্ষেপ করে নি পুলিশ। পুলিশের সামনেই তাঁকে জুতোর মালা পড়িয়ে ঘোরায় পড়ুয়ারা। এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে অবশেষে খানিকটা নড়েচড়ে বসে সরকার। এক শিক্ষার্থীকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ।
ছাত্র পিটিয়ে মারল শিক্ষক উৎপল সরকারকে
শিক্ষক উৎপলকুমার সরকারের ভাগ্য একদিক দিয়ে ভালই বলতে হবে যে, তাঁকে আর যাই হোক, নিদারুণ অপমান সহ্য করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে না। গত ২৫ জুন আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজি ইউনুস আলি কলেজের মাঠে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে উৎপলকুমার সরকারের হাড়-মাংস দলা পাকিয়ে দেয় তাঁরই ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু। প্রকাশ্য দিবালোকে নিজের শিক্ষককে মাটিতে ফেলে নির্মমভাবে পেটায় আশরাফুল। আশেপাশের অনেকে দেখলেও অসহায় শিক্ষককে বাঁচাতে এগিয়ে আসে নি কেউ। ২৭ জুন হাসপাতালের আইসিইউতে প্রাণত্যাগ করে বাংলাদেশে থাকার ঋণ শোধ করেন ওই হিন্দু শিক্ষক। আশরাফুল ইসলাম জিতু ও তার বাবা উজ্জ্বল হাজিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
শিক্ষক সংখ্যালঘু হলেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ
এপ্রিল মাসে নওগাঁয় দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধানশিক্ষিকা আমোদিনী পালকেও ধর্ম অবমাননার জিগির তুলে বেকায়দায় ফেলানোর চেষ্টা করেছিল একটি মহল। এক ছাত্রী তার ধর্মীয় পোশাক পরে স্কুলে আসায় ওই হিন্দু শিক্ষিকা শাস্তি দিয়েছেন- এই ছিল ছিল অভিযোগ। সামাজিক মাধ্যমে ভুয়ো ভিডিও ভাইরাল করে আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি করা হয়। চাপের মুখে তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রশাসন। তদন্তে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অবশেষে হিন্দু সহকারী প্রধান শিক্ষিকার রেহাই মেলে। জুন মাসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হিন্দু অধ্যাপক উন্মেষ রায় ও সঞ্জয় সরকারের বিরুদ্ধেও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ তোলে শিক্ষার্থীদের একটি মহল। এবং তাতে মদত জোগায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ। এই দুই শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়ে যায় ক্যাম্পাসে।
প্রশাসনও নির্যাতিতদের পাশে নেই
পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে হিন্দু শিক্ষকদের পক্ষে এখন নির্ভয়ে চাকরি করাই মুশকিল। বাংলাদেশে উদার মনোভাবাপন্ন শিক্ষক মাত্রেই মৌলবাদীদের সফ্ট টার্গেট। তার উপর শিক্ষকটি যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে শুধু ধর্মীয় অবমাননার একটা অভিযোগ হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। কর্মস্থলে স্রেফ হয়রানি করার উদ্দেশ্যেও হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার মিথ্যা অভিযোগ সাজানো হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ষড়যন্ত্রের শিকার সংখ্যালঘু শিক্ষকেরা প্রশাসনের কাছ থেকে সুবিচার পান না। উল্টে অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই করার আগেই তাঁদের গ্রেফতার করে জেল ঢোকায় পুলিশ। অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকদের নির্যাতনের ঘটনায় সরকার শুধু নির্যাতিতদের নিরাপত্তা দিতেই ব্যর্থ নয়, অধিকাংশ সময় স্থানীয় প্রশাসন চোখ বন্ধ করে নির্যাতনকারীদের পক্ষেই অবস্থান নেয়।
Feature Image- File and representational.