এক সময় যাঁর এক ডাকে দার্জিলিং শহর ভেঙে পড়ত তাঁকে আমরণ অনশনে বসতে দেখেও জনগণের হৃদয় উদ্বেলিত হল না!
ডেস্ক রিপোর্ট : পাহাড়ের চূড়ো থেকে একবার খাদে গড়িয়ে পড়লে ওঠা বড় কঠিন। পাহাড়ের রাজনীতিও কতকটা তেমনই। যে একবার ধপাস হয়ে পড়ে সে আর ওঠে না। বিমল গুরুংয়ের তাড়া খেয়ে দার্জিলিং থেকে পালিয়ে সমতলে আশ্রয় নেওয়ার বছর তিনেক পর সুবাস ঘিসিং পাহাড়ে ফিরতে পারলেও সাম্রাজ্য আর ফেরত পান নি। ১৯৮৮ থেকে২০০৮– টানা কুড়ি বছর ঘিসিংয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো একটা মানুষও দার্জিলিং পাহাড়ে ছিল না। পাহাড়ে সুবাস ঘিসিংয়ের রাজনৈতিক আধিপত্যের শুরু অবশ্য তারও তিন বছর আগে, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নেতৃত্বের মাধ্যমে। বিমল গুরুংয়ের আকস্মিক উত্থানে সুবাস ঘিসিংয়ের আকস্মিক পতন। ১৪ বছরের ব্যবধানে গুরুংয়ের রাজনৈতিক নিয়তিও কি ঘিসিংয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে?
সুবাস ঘিসিংয়ের জামানায় বিমল গুরুংয়ের পরিচিতি সীমাবদ্ধ ছিল দার্জিলিং শহরের চৌহদ্দি পর্যন্ত। ২০০৮-এর মার্চ মাস থেকে তাঁকে চিনল গোটা পশ্চিমবঙ্গ। ঘিসিং জামানার অবসানের পর পাহাড়ে শুরু হয় বিমল গুরুং জামানা। ঘিসিংয়ের কোনও দোসর ছিল না। কিন্তু বিমল গুরুংয়ের সঙ্গে হাইফেন হিসেবে জুড়ে যায় আরও একটি নাম- রোশন গিরি। বিমল গুরুং-রোশন গিরির নেতৃত্বাধীন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দাপটে পাহাড়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়ে। ঘিসিংয়ের জিএনএলএফ রাতারাতি পাহাড় থেকে উবে যায়। সবাই মোর্চায় নাম লেখায়। ঘিসিং নিজের বাড়িতে তিষ্ঠোতে পর্যন্ত পারলেন না, নেমে আসেন জলপাইগুড়িতে।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের মাধ্যমে পাহাড়ে সুবাস ঘিসিংয়ের উত্থান। ঘিসিংয়ের হাত ধরে পাহাড়ের মানুষের প্রাপ্তি দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল( ডিজিএইচসি)। বিমল গুরুংও জমি তৈরি করেন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে হাতিয়ার বানিয়ে। গুরুংয়ের নেতৃত্বে চলা হিংসাত্মক আন্দোলনও গোর্খাল্যান্ডের পরিবর্তে শেষ পর্যন্ত রফা করে জিটিএ ( গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন )- তে। জিটিএ পেয়ে গুরুং মোটের উপর শান্ত ছিলেন পাঁচ বছর। বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়ে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে ফের সুর চড়ান বিমল। সতেরোতেও পাহাড় উঠত-বসত মোর্চা প্রধানের ইশারায়। ভয়ে হোক আর ভক্তিতে বিমল যা বলতেন তাই শুনত পাহাড়ের মানুষ। মোর্চার ডাকা উপর্যুপরি টানা বনধ দার্জিলিঙের অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করে। শৈলরানির পর্যটন ব্যবসা লাটে ওঠে। পেটে টান পড়লেও দাঁতে দাঁত চেপে মোর্চার আন্দোলন মেনে নেন পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। তবে আন্দোলনকে হিংসার রাস্তায় নিয়ে গিয়েও মমতাকে নরম করতে ব্যর্থ হন বিমল গুরুং। বরং সংঘর্ষে রাজ্য পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিকের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা বেকায়দায় ফেলে দেয় বিমলকে। মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে মোর্চা প্রধান গা ঢাকা দিতেই তাঁর হাত থেকে পাহাড়ের রাজনীতির রাশ আলগা হতে শুরু করে।
জমি হারিয়ে দিশেহারা বিমল
বিমল গুরুং- রোশন গিরিকে দৌড়ের উপর রাখার সুযোগে মোর্চায় ফাটল ধরাতে সফল হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু পাহাড়ের মানুষের উপরেই নয় নিজের দলের উপরেও নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে শুরু করে বিমলের। ১৭ থেকে ২২- এই পাঁচ বছরে দিশেহারা বিমল-রোশন প্রথমে অমিত শাহের পায়ে হত্যে দিয়ে পড়েন। উনিশের লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং আসনটি জিতে তার ফয়দা তোলে বিজেপি। একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দিয়ে ফের মমতার সঙ্গে রফা করে পাহাড়ে ফিরে আসেন বিমল গুরুং। কিন্তু ততদিনে বিমলের ম্যাজিক শেষ। বিনয় তামাং, অনীত থাপাকে বশ করে নিয়েছে রাজ্য সরকার। পাহাড়ের রাজনীতিতে বহু বিভক্ত গোর্খা জন মুক্তি মোর্চার প্রাধান্য স্বাভাবিক ভাবেই আর আগের অবস্থায় নেই। বিমলের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস। বিনয় কিম্বা অনীত- কেউই মানুষের মনে দাগ কাটার মতো নয়। গত ফেব্রুয়ারির পুরভোটে দার্জিলিং পুরসভা দখল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় সদ্যজাত হামরো পার্টি। হামরো পার্টির নেতার নাম অজয় এডওয়ার্ড। অজয় দার্জিলিঙের একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁর মালিক। এত দিন নিজের ব্যবসা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। এখন তিনি পাহাড়ের বড় নেতা।
জিটিএ নির্বাচন চান না গুরুং
আগামী ২৬ জুন জিটিএ নির্বাচন। এদিকে গোর্খাল্যান্ড প্রশ্নের স্থায়ী মীমাংসা না করে জিটিএ নির্বাচন চান না বিমল গুরুং। কিন্তু বিমলের কথায় কর্ণপাত না করেই নির্বাচন নিয়ে এগোচ্ছে রাজ্য। মমতার সঙ্গে আপোষ করে পাহাড়ে ফিরে এলেও বিমলের আর আগের দাপট নেই। সতেরো সালের মতো যে জোরালো গণ আন্দোলনে নেমে সরকারকে মোকাবিলা করবেন সেই তাগতও নেই। পায়ের তলা থেকে জনসমর্থন সরে গেছে। কোভিডে প্রায় দুই বছর পর্যটন মার খেয়েছে। সবে সুদিন ফিরেছে। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকেরা ফের আসতে শুরু করেছে। ব্যবসা জমে উঠেছে। বিমল-রোশনের কথায় আত্মঘাতী বনধে নেমে নিজেদের পায়ে আর কুড়ুল মারতে রাজি নয় পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে অগত্যা ভরসা গান্ধীজির অনশন। জিটিএ ভোট ঠেকানোর দাবিতে অনশনে নেমেছেন বিমল গুরুং। কিন্তু বিমলের অনশন ঘিরেও দার্জিলিঙবাসীর তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। রবিবার অনশনের পঞ্চম দিনে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে মোর্চা প্রধানকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে চিকিৎসকদের অনুরোধে হাসপাতালেই অনশন ভাঙেন বিমল।
বিমলকে আর ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না মমতা
অনশন ভঙ্গ না করে বোধ হয় উপায়ও ছিল না বিমল গুরুংয়ের। কারণ বিমলের অনশন মঞ্চের চেহারাই বলে দিচ্ছিল তাঁর প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে মানুষ। এক সময় যাঁর এক ডাকে দার্জিলিং শহর ভেঙে পড়ত তাঁকে আমরণ অনশনে বসতে দেখেও জনগণের হৃদয় উদ্বেলিত হল না! বিমল বাঘ থেকে বিড়ালে পরিণত হয়েছেন বুঝতে পেরেই তাঁর আপত্তিকে পাত্তা না দিয়েই জিটিএ ভোট ডেকে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিমল গুরুং কি তবে সুবাস ঘিসিংয়ের মতোই পাহাড়ের রাজনীতি থেকে চিরদিনের জন্য ধপাস?
Photo Credit- Official FB page of Bimal Gurung.